কী করছি, কী করবো, কী করবো না:



কী করছি, কী করবো, কী করবো না:
অধ্যাপক ড. আমানুল্লাহ ফেরদৌস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৩/৪/২০২০

শখের লম্বা লম্বা নখগুলা কেটে ফেলুন। এদের চিপাচোপায় করোনা লুকিয়ে থাকতে পারে।
লেবু, জাম্বুরা, কামরাঙা, লাইম, আনারস, কমলা, ম্যান্ডারিন, রসুন, এভোকাডো, আম, তেঁতুল ইত্যাদি টকজাতীয় খাবার বেশী বেশী খান। এদের pH লেভেল করোনার pH লেভেল থেকে বেশী। যারা মধু, কালোজিরা খেতে চান, খান। আমি সারা বছরই খাই কতোদিন খাবো এগুলো? উত্তর জানি না। হয়তো ২০২০ সাল পুরোটাই! এখানকার হামলাটা কখন হবে বুঝতে পারছি না। তবে সুনামি না হলেও হামলা একটা হবে এটা জানি।
কোয়ারেন্টিন ভালোভাবে মানুন। সম্পর্কের চেইন ভেঙে
যারা বলছেন আমাদের গন ইমিউনিটি আছে, এখানে হামলা হবে না তারা হয়তো বোকার স্বর্গে বাস করছেন। অনেকে বলছেন হামলা নয়, ভারতীয় উপমহাদেশে হলে হবে সুনামী। যারা বলছেন বিসিজি টিকা দেয়া আছে তারা হয়তোবা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। আমি নিশ্চিত সেটা ২০২২ এর আগে না। তাই যদি হয় তাহলে ধরে রাখুন বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক এবং অত্যন্ত গরীব দেশগুলো করোনা ইফেক্টে একদম ভঙ্গুর হয়ে যাবে। ইতোমধ্যেই আপনি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছেন। সেটার পরিমাণ কতো তা বুঝতে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র ৪ সপ্তাহ!
গতকাল দ্য ইকোনোমিস্ট বলেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির দিকে যাচ্ছে এবং আমাদের প্রবৃদ্ধি ৩.৫ এ নেমে আসতে পারে। অর্থমন্ত্রী এবং এডিপি বলেছে প্রবৃদ্ধি ১.৫ থেকে ২.৫ কমে যেতে পারে। এর মানে কি জানেন তো? এর মানে নতুন চাকুরি গোল্লা মারেন বরং ৮০-৯০ লক্ষ লোক তাদের বর্তমান চাকুরি হারাবে। ১ কোটি টাকার ফ্ল্যাট আপনি ৪০ লাখ টাকায়ও ক্রেতা খুঁজে পাবেন না। পঞ্চাশ লক্ষ টাকা কাঠা জমির মূল্য হবে ১০ লক্ষ টাকা। ব্যাংকের সুদের হার নেমে আসতে পারে ৩% থেকে ৪% এ। রেমিটেন্স এবং গার্মেন্টস অর্ধেক হয়ে যেতে পারে।
 এতে বাংলাদেশের মানুষ হয়তো না খেয়ে মারা যাবে না
কিন্তু এদেশটাকে যেমন দেখছেন এখন আপনি হয়তো সেরকম আর দেখবেন না বহুদিন। এককভাবে কোন একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে হয়তো এটাকে সামাল দেয়া সম্ভবপর নাও হতে পারে। একটা সর্বদলীয় কোয়ালিশানে যেতে হতে পারে।
তবে আমি মনে করি বাংলাদেশ ঠিকে যাবে শুধুমাত্র ১ কোটি ১০ লক্ষ প্রবাসীর জন্য, ২.৫ কোটি কৃষকের জন্য, ৪০ লক্ষ মাছ চাষীর জন্য আর ৩০ লক্ষ গার্মেন্টস কন্যার জন্য। ধান, সবজি, মাছ, লবণ আর পোলট্রি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য।
আরেকটা কথা, ইউএনের বরাতে বিবিসি, দ্য অস্ট্রেলিয়ানসহ বিশ্বের বহু গনমাধ্যম জানাচ্ছে যে বাংলাদেশে ৫-৭ কোটি লোক করোনায় আক্রান্ত হবে এবং ২০ লক্ষ লোক মারা যাবে। আমি এই প্রজেকশনে বিশ্বাস করি না। বিশ বছর ধরে পাবলিক হেলথ, এপিডেমিওলোজি, ইমারজিং এবং রিইমার্জিং এপিডেমিক এবং ভাইরাস পড়াই ক্লাসে। এদেশের ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩টি পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্ট আমার হাতে কিংবা প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তৈরি করা। ফলে এখানে কী হতে পারে সেটা আমরা বুঝি। প্যানিক করার দরকার নেই।
দরকার শুধু ভালন্যারেবল জনগুষ্টির দিকে নজর রাখা যেমন ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা, ৯০ হাজার কারাবন্দি, ৫০/৬০ লক্ষ বস্তিবাসী এবং বিদেশ থেকে আগত লোকজন। র‌্যাপিড এন্টিবডি টেস্টের দিকে আমাদের যেতেই হবে, পরে কনফার্মেটরি পিসিআর টেস্ট। গনস্বাস্থ্য যেটা করতে চাচ্ছে বা সাউথ কোরিয়া যেটা করেছে সেটাকে সরকার গ্রহণ করলে ভালো হবে।
 তবে সঠিক টেস্টের কোন বিকল্প নেই। আগামী দিনগুলোতে আমাদের প্রতিদিন প্রায় ১০,০০০ টেস্ট করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে খুবই সাবধানতার সহিত। মনে রাখতে হবে সরকার যে ২০টি পিসিআর ল্যাব করতে যাচ্ছে এবং প্রাইভেটে যে আরো ১০ টার মতো পিসিআর ল্যাব আছে সেগুলো কিন্তু WHO এর বায়োসেফটি লেভেল-২ দ্বারা পরিচালিত।
এগুলোর সেফটি লেভেল অবশ্যই লেভেল-৩ এ তুলতে হবে। নতুবা বিপদ ঘটে যেতে পারে। আর ভেন্টিলেটর আনতে হবে মিনিমাম ৫০০০। গাজীপুরের আমাদের ম্যাশিন টুলস ফ্যাক্টরি ভেন্টিলেটর বানাতে পারবে বছরে ১০,০০০। আমি দাবী করেছিলাম দিনে ২,০০০ টেস্ট করার জন্য, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দিনে ১,০০০ টেস্ট করার জন্য।
এই টেস্টগুলো যেন আব্দুল টেস্ট না হয়। আব্দুল টেস্ট কি?
 বরিশাল বি এম কলেজের রসায়ন বিভাগের একসময় ল্যাব বিয়ারার ছিল নাম আব্দুল। সে Salt জিহবায় স্পর্শ করে বলতে পারত কোন Salt, যার নাম আব্দুল টেস্ট। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী লগ্নে এসেও আমরা এখনও যেন আব্দুল টেস্টেই না থাকি (আব্দুল টেস্টের কথা আমার এক আমলা বন্ধুর পোস্ট থেকে নেয়া)।
বিশ্ব কতোদিনের জন্য থেমে গেলো সেটা এখন বলা যাচ্ছে না। অনেকে বলছেন স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি কবে খুলবে?
আমি আসলে জানি না। ঈদের আগে তো অবশ্যই না। আমেরিকা এবং ইউরোপের মহামারীর চিত্র যতদিন লোকজন টিভিতে দেখবে ততদিন তারা তাদের বাচ্চাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো বন্ধ রাখবে এটা ধরে নিতে পারেন।
 জোর করে অফিস আদালত খুলে দিতে পারেন কিন্তু অনেক কিছুই আনসার্টেন হয়ে পড়েছে। তাই বাচ্চাকে বাসায় লম্বা সময় পড়ানোর প্রিপারেশান নিন।
আর ম্যাডাম/স্যারদেরকে বলছি, ইয়ে বাচ্চেকি খেল নেহি হ্যায়। প্রনোদনা দিতে হবে। ১০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে প্রস্তুত হোন।
বিশ্ব ব্যাংক-এডিপির কাছে টাকা চেয়েছেন শুনলাম। তাড়াতাড়ি টাকাটা ছাড় করান। ২ লক্ষ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি কাটছাঁট করে সেখান থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে আসুন।
অবশ্য এই টাকাও তো মানুষের পকেটে। মানুষ এই বিপদে টাকা দিবে কিনা সেটাও বলা যাচ্ছে না।
ইনকাম না থাকলে মানুষ ট্যাক্স দিবে কোথা থেকে?
আমরা আশা করি এই দুর্যোগ আমরা সামাল দিতে পারব। কিন্তু আমরা শুধুমাত্র আশার উপর বিশ্বাস করে কাজ করলে হবে না।
আমাদের আরো আগে জাম্প দেয়া দরকার ছিলো, আমরা সময় নষ্ট করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি বলে আর সময় নষ্ট করার সময় আমাদের হাতে নেই।
এগুলোর উত্তর আমরা আজকে নয়, আগামীকাল নয়, এগুলোর উত্তর আমরা খুঁজবো অনেক পরে, সময় আছে সেটার। এখন একজন আরেকজনকে ব্লেম দেয়ার সময় নয়।
এখন সময় কাজের। মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর উচিত সব বিরোধী দলের সাথে বসে একটা সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা।
একই সঙ্গে করোনা থেকে মুক্তি এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান, এই সুযোগ প্রকৃতি উনাকে করে দিয়েছে, এটাকে কাজে লাগানো দরকার।
আপনাদের সবার মঙ্গল কামনায়।

Comments