‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ’

হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন ‘পুলিশের নির্যাতনের শিকার’ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাস। পাশে বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন স্ত্রী সরস্বতী রানী দাস। ছবিটি শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তোলা। ছবি: আবদুস সালামহাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন ‘পুলিশের নির্যাতনের শিকার’ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাস। পাশে বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন স্ত্রী সরস্বতী রানী দাস। ছবিটি শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তোলা। ছবি: আবদুস সালাম
‘মোটরসাইকেল থেকে নামাইয়া স্যারেরে প্রথমে কপালে বাড়ি মারছে। স্যারের পিছনে লাথি মারছে। আর খারাপ ভাষায় গালিগালাজ করছে। গলা টিপ্পা ধইরা কইতাছে, “মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ।” এই হলো তাগো অবস্থা।’ রাজধানীর মীর হাজীরবাগ এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাসকে পুলিশের বেধড়ক পেটানোর দৃশ্য দেখেন একজন নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মী। ঘটনার সময় কিছু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে তিনি দাবি করেন।
আজ শুক্রবার সকালে বিকাশ চন্দ্রের স্বজনেরা তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু অবস্থা আরও খারাপ হলে বিকাশকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বিকেলে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে আইসিইউ খালি না থাকায় ল্যাবএইড হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিকাশের ভাই লিটন দাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দয়াগঞ্জে নিজের বাড়ি থেকে সায়েদাবাদ এলাকায় কর্মস্থলে যাওয়ার পথে গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর রাত চারটার দিকে এ ঘটনা ঘটে বলে তিনি সেখানে অবস্থানরত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাছ থেকে শুনেছেন। পুলিশ লাঠি ও পিস্তলের বাঁট দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করেছে। তাঁরা গিয়ে দেখেছেন যাত্রাবাড়ী থানার এএসআই আকাশ ও রাসেল বিকাশকে পেটান। আর দূর থেকে তা দেখেন এসআই মনোজ।
লিটনের ভাষ্য, মীর হাজীরবাগ এলাকায় সাদা পোশাকধারী পুলিশে চারজন সদস্য তাঁকে থামার সংকেত দেন। তিনি ছিনতাইকারী ভেবে মোটরসাইকেল টান দেন। পরে পুলিশ সন্দেহভাজন ভেবে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করেই তাঁকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকে। এরপর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়ার পর পুলিশ বিকাশকে পেটাতে থাকে। মারের একপর্যায়ে সিটি করপোরেশন থেকে দেওয়া বিকাশের ব্যবহৃত ওয়্যারলেস সেটটি পড়ে যায়। কিন্তু এরপরও বিকাশকে মারতে থাকে পুলিশ।
লিটনের দাবি, এ সময় বিকাশের চিৎকার শুনে আশপাশের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এগিয়ে আসেন। পরে পুলিশ সদস্যরা চলে যেতে চাইলে পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যবহৃত গাড়ি রাস্তায় আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে পুলিশকে আটকে রাখেন তাঁরা। পরে যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) অন্য সদস্যরা এসে ওই চারজন পুলিশকে নিয়ে যান। আর ওই সময় অচেতন অবস্থায় ভ্যানগাড়িতে পড়ে ছিলেন বিকাশ।
বিকাশের স্ত্রী সরস্বতী দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘গিয়া দেখি লাশ যেভাবে ফেলা রাখা হয়, সেইভাবে মালটানা ভ্যানগাড়িতে ওরে ফেলাইয়া রাখা হইছে। এটা দেখে আমার ছেলে তো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। এরপর সেখানে সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও আইছে। এক বড় স্যারের গাড়িতে করে ওরে হাসপাতালে আনছি।’ তিনি বলেন, ‘লেবাররা বলছে—ওরে পুলিশ প্রথমে মোটরসাইকেল থামাতে বলে, ও থামায়ও। কিন্তু ওরে তো জিজ্ঞাসা করবে আপনি কোথায় যাবেন, কী করেন? কিছু জিজ্ঞাসা না কইরাই মারা শুরু করছে। প্রথমে ঘাড়ে বাড়ি মারার সঙ্গে হোন্ডা থেইকা পইড়া গেছে। হোন্ডা থেকে পইড়া যাওয়ার পর পিছনে, পায়ে বুট জুতা দিয়া সমানে লাথি মারছে।’ এ সময় তিনি প্রশ্ন করেন, ‘ইটটু-আটটু মারলে কি নাক দিয়া গলগলাইয়া রক্ত পড়ে?’
সরস্বতী বলেন, ‘সঠিক বিচার না পাইলে অবশ্যই মামলা করব। একজন নির্দোষ মানুষরে এভাবে পিটাইলে কি মামলা করমু না?’ বিকাশ-সরস্বতী দম্পতির নোবেল ও পিয়া নামের দুটি সন্তান রয়েছে। ১৫ বছর ধরে সিটি করপোরেশনে কর্মরত রয়েছেন বিকাশ।
ঘটনার বিষয়ে যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অবনীশঙ্কর কর প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওটা ছিনতাইপ্রবণ এলাকা। সেখানে পুলিশের সাদা পোশাকধারী দলের টহলের প্রয়োজন ছিল। চারজন সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিল।’ এক প্রশ্নের জবাবে অবনীশঙ্কর কর বলেন, ‘যদি অন্যায়ভাবে তারা মেরে থাকে, তবে সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। পুলিশ সদস্যরা অন্যায়ভাবে যদি মেরে থাকে বা দোষী সাব্যস্ত হয়, তবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী পুলিশি নির্যাতনের শিকার হলে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

Comments