ধানের শীষের কেন এ পতন?

ধানের শীষের দুর্গ হিসেবে খ্যাতি রয়েছে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্মভূমি বগুড়ার। কিন্তু সদ্য অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে ৯টি পৌরসভার মধ্যে ৫টিতেই বিজয়ের পাল উড়িয়েছে নৌকা। বগুড়ায়  
 ধানের শীষের কেন এ পতন? নির্বাচনের দিন সন্ধ্যার পর থেকে এ নিয়ে বগুড়ার মানুষ এখন আলোচনা-সমালোচনায় মুখর। চলছে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ। নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের আলোচনায় উঠে আসছে ৭টি কারণ। সেগুলো হচ্ছে- কৌশলী জালিয়াতি, আওয়ামী লীগের কৌশল বুঝতে ব্যর্থতা, জোটের শরিক দল জামায়াতের অসহযোগিতা, দলের অন্তর্কোন্দল, নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতি, ভুল মনোনয়ন ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মতপরিবর্তন। জেলা ও পৌর বিএনপির একাধিক নেতাই ফলবিপর্যয়ের এসব কারণের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন।
বিগত উপজেলা নির্বাচন ও সিটি নির্বাচনে সহিংসতা এবং প্রকাশ্য জালিয়াতির সমালোচনার কারণে বগুড়ায় এবার নতুন কৌশল নেয় আওয়ামী লীগ। বাইরের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রেখেই সম্পন্ন করা হয় সেই জালিয়াতি। সকাল থেকে পরিবেশ এতটাই শান্তিপূর্ণ রাখা হয় যে, বেশির ভাগ পৌরসভায় জালিয়াতির কৌশলটি ধরতেই পারেনি বিএনপি প্রার্থীরা। দুপুর ১২টা পর্যন্ত তাই তারা খুব একটা অভিযোগই করেননি। পরে অভিযোগ ওঠে বগুড়ার সারিয়াকান্দিসহ অনেক পৌরসভায় কিছু কিছু কেন্দ্রে আগের রাতেই ৩০০ করে ব্যালেটে নৌকা প্রতীকে সিল মেরে রাখা হয়। ওইসব কেন্দ্রে ভয় দেখিয়ে বা কৌশলে বের করে দেয়া হয় ধানের শীষের এজেন্ট। সকাল থেকে ভোটগ্রহণ করা হয় ধীরগতিতে। কোথাও দুপুর একটার পর কোথাও দুটার পর আধঘণ্টা সেটা করা হয় আরও ধীর। ওই সময় বাইরে তৎপর থাকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। ভেতরে রাতে সিল দেয়া ব্যালটগুলো ভরা হয় বাক্সে। সারিয়াকান্দির অনেক কেন্দ্রেই বুথের কাস্ট ও প্রিসাইডিংয়ের সরবরাহকৃত ব্যালটের হিসাবে অনিয়ম ধরা পড়ে প্রার্থীদের অনুসন্ধানে।   
দলের প্রতিষ্ঠাতার জন্মভূমি হলেও বর্তমানে অন্তর্কোন্দলে জর্জরিত বগুড়া বিএনপি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলামের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে জেলার সিনিয়র নেতাদের। তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে এ ব্যবধান আরও বেশি। দূরত্বের কারণ হিসেবে সবাই চি?হ্িনত করছেন কমিটি গঠনে অর্থনৈতিক লেনদেনকে। জেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবে ইতিমধ্যে বিভিন্ন উপজেলা ও পৌর বিএনপির কমিটি গঠন করেছেন তিনি। ফলে পৌর নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার দায়িত্ব না পেলেও প্রভাব বিস্তার করেছেন তিনি। যেখানে তার পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন পেয়েছে সেখানে অন্য গ্রুপের নেতাকর্মীরা বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি। অন্যদিকে যেখানে তার মতামতের বাইরে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে সেখানে তার গঠিত কমিটির লোকজন কোথাও ধানের শীষের প্রার্থীর সরাসরি বিরোধিতা ও কোথাও পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় ছিলেন। বিশেষ করে ধুনটে উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল ইসলাম মামুন, শিবগঞ্জে জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক মীর শাহে আলম ছিলেন বিরোধিতায় সক্রিয়। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট একটি বৈঠকে শাহে আলমের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তির প্রস্তাবও উত্থাপিত হয়েছে। পৌর নির্বাচনে উত্তরাঞ্চলে প্রচারণায় এসেছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বগুড়া জেলা বিএনপির উপদেষ্টা মোহাম্মদ শোকরানার মালিকাধীন হোটেল নাজ গার্ডেনে তার সামনেই ঘটে এক অনভিপ্রেত ঘটনা। পৌর নির্বাচনে বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় মনিটরিং টিম-১ এর প্রধান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হন ভিপি সাইফুল। অবশ্যই দলের এ অন্তর্কোন্দলে জেলার সিনিয়র নেতাদের ভূমিকাও কম নয়। দলীয় সিদ্ধান্তের চেয়ে নিজের স্বার্থ ও প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারেই ব্যস্ত তারা। আর এ কারণেই সাম্প্রতিক বছরগুলোর আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথ ছেড়ে গলি-ঘুপচি কেন্দ্রিক রাজনীতিকে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন কর্মী-সমর্থকরা। 
বগুড়ার শিবগঞ্জে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন সাবেক পৌর মেয়র মতিউর রহমান। কিন্তু তার এ মনোনয়ন মেনে নিতে পারেননি জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মীর শাহে আলম। প্রকাশ্যেই তিনি এ নিয়ে বিরোধিতা করেন। পরে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেন বিএনপি নেতা তাইজুল ইসলামকে। পরে তিনি নির্বাচনে প্রকাশ্যে নিষ্ক্রিয় হলেও ব্যালটে তার প্রতীক থেকে যায়। তাইজুল নিষ্ক্রিয় হলেও শাহে আলম নির্বাচনে মাঠে সক্রিয়ভাবে বিএনপি প্রার্থীর বিরোধিতা করেছেন তিনি। দলীয় কোন্দলের কারণেই বিএনপির হাতছাড়া হয়েছে ঐতিহাসিকভাবে শীষের শক্ত এ ঘাঁটি। অন্যদিকে আগে থেকেই আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান রয়েছে ধুনটে। ২০০১ সালে দলীয় বিরোধের জের ধরে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৭ বছরের সাধারণ সম্পাদক আলিমুদ্দিন হারুন মণ্ডল। জাতীয় নির্বাচনে এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হলেও উপজেলা নির্বাচনে জিতেছেন ধানের শীষের প্রার্থী। কিন্তু অতীতের বিরোধ ভুলে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেননি স্থানীয় বিএনপি। শক্তিশালী প্রার্থী হারুন মণ্ডলের বিরোধিতা করেন ধুনট উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল ইসলাম মামুন। অন্যদিকে নির্বাচনে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় ছিলেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর প্রশাসক আকতার আলম সেলিম এবং পৌর যুবদলের সভাপতি মশিউর রহমান পলাশ। ধুনটে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর দ্বৈরথে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও দলের নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে হেরেছেন বিএনপি প্রার্থী। বগুড়ায় ধানের শীষের অন্যতম এক দুর্গ নন্দীগ্রাম। সেখানে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন সাবেক মেয়র সুশান্ত কুমার সরকার শান্ত। দীর্ঘদিনের এ জনপ্রতিনিধি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। বিএনপির নতুন প্রজন্মের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তৈরি হয়েছে তার দূরত্ব। সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হন নন্দীগ্রাম পৌর বিএনপির সহ-সভাপতি এ কে এম ফজলুল হক কাশেম ও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত সাবেক মেয়র কামরুল হাসান সিদ্দিকী জুয়েল। বিএনপির সাবেক স্থানীয় এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোস্তফা আলী মুকুল কাহালুতে প্রচারণা চালালেও পা ফেলেননি নন্দীগ্রামে। নির্বাচনে মাঠে দলের নেতাকর্মীহীন সুশান্ত সরকার হেরেছেন মাত্র ৯৭ ভোটে। তবে সরাসরি না হলেও বহিষ্কৃত নেতার হাত ধরে এ পৌরসভায় বিজয়ী হয়েছে বিএনপি। বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলা বিএনপির পাশাপাশি জোটের শরিক দল জামায়াতের রয়েছে শক্ত অবস্থান। মহাজোট সরকারের আমলে বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন ও ঘটনা-দুর্ঘটনায় তার প্রমাণ দিয়েছে জামায়াত। বিগত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী থাকার পরও নন্দীগ্রামে বিজয়ী হয়েছে জামায়াত। পৌর নির্বাচনে জামায়াত কোনো প্রার্থী না দিলেও নন্দীগ্রামে তাদের ভূমিকা ছিল নিষ্ক্রিয়। ভোটের মাঠে শেষ মুহূর্তে তারা ঝুঁকে পড়ে বিএনপির বহিষ্কৃত ও বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে। একইভাবে জামায়াতের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে শিবগঞ্জে। বিগত উপজেলা নির্বাচনে সেখানে বিজয়ী হয় জামায়াতের প্রার্থী। কিন্তু পৌর নির্বাচনে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় ছিল দলটির নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে কাহালুতে বিগত পৌর নির্বাচনে বিএনপির দুই প্রার্থীর ভোট ভাগাভাগির ভেতর সামান্য ব্যবধানে জিতেছিল আওয়ামী লীগের হেলাল কবিরাজ। সেবার বিএনপি ও জামায়াতের তিন প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ছিল বিজয়ী প্রার্থীর দ্বিগুণ। জামায়াত প্রার্থী ভোট পেয়েছিল প্রায় ৫০০। প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও এবার সেখানে প্রার্থী দেয় জামায়াত। বগুড়ার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত পৌরসভা শেরপুর। পৌরসভার ২১ হাজার ভোটের মধ্য ৭ হাজারই সংখ্যালঘু ভোট। সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজনের হাতেই ধানের শীষ প্রতীক দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু সাবেক মেয়র স্বাধীন কুমার কুণ্ডু ধরে রাখতে পারেনি বিজয়। বিগত পৌর নির্বাচনে প্রার্থীর কারণেই এ পৌরসভার হিন্দু প্রধান ভোট কেন্দ্রগুলো একচেটিয়া ভোট পেয়েছিলেন স্বাধীন কুণ্ডু। তবে দলীয় নির্বাচনে এবার মার্কাই কাল হয়েছে তার। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন প্রার্থীর চেয়ে মার্কা হিসেবে বেছে নিয়েছেন নৌকা। শেরপুরে বিএনপির পরাজয়ের প্রধান কারণ সংখ্যালঘুদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থতা। কাহালুতে ভুল প্রার্থীর হাতে দেয়া হয় ধানের শীষ প্রতীক। সেখানে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন দলে নতুন যোগ দেয়া ব্যবসায়ী আবদুল মান্নান। এককালে তিনি জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখানে উপজেলা ও পৌর বিএনপির ত্যাগী ও সিনিয়র নেতাদের বঞ্চিত করে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়। স্থানীয় নেতারা দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও মাঠে ছিলেন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। এছাড়া ৪-৫ বছর আগে এক স্কুলছাত্রকে হত্যার পর পুড়িয়ে ফেলা হয় আবদুল মান্নানের ইটের ভাটায়। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পেলেও পলাতক রয়েছেন তার ছেলে। এ ঘটনা কাহালুবাসীর মনে এতটাই রেখাপাত করেছে যে ভোটের মাঠে যা আলোচনার ঝড় তোলে।
পৌর নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র পাহারা দেয়ার ঘোষণা এসেছিল বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের তেমন নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু মাঠের চিত্র ছিল ভিন্ন। বিএনপির দুর্গ হিসেবে খ্যাত বগুড়ায় দলটির নেতাকর্মীদের চোখে পড়েনি ভোটের মাঠে। কোনো পৌরসভার একটি কেন্দ্রের কাছেও ছিল না ধানের শীষের ক্যাম্প। ধানের শীষের ব্যাজ লাগানো একজন সমর্থককেও চোখে পড়েনি কেন্দ্রের আশপাশে। উল্টো কেন্দ্রের চারপাশে অবস্থান নিয়ে পাহারায় ছিল আওয়ামী লীগের লোকজন। ফলে অরক্ষিত কেন্দ্রে জালিয়াতির ঘটনাগুলো হাতেনাতে তা ধরে ফেলা বা প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ মেলেনি তাদের। বিএনপি প্রার্থীরা এর কারণ হিসেবে চি?হ্িনত করেছেন সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের হামলা ও প্রশাসনের হয়রানির ভয়কে। কিন্তু এই দুই ভীতিকে জয় করার ন্যূনতম চেষ্টাও বিএনপির তরফে দেখা যায়নি। আবার প্রতিটি পৌরসভায় বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীরাও। নিজেদের ভোট নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তারা। তবে দলীয় প্রতীকে পৌর নির্বাচনের সিদ্ধান্তে কারও কপাল খুললেও পুড়েছে কারও কপাল। শেরপুরে কেবল নৌকা প্রতীকের কারণে বিএনপি প্রার্থীর নিশ্চিত জয় চলে গেছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ঘরে। অন্যদিকে নৌকা প্রতীকের কারণে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার পাল্লা ভারী হলেও হেরেছেন বগুড়া সদর আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী। পৌর নির্বাচনে বগুড়ায় ভুল প্রার্থীর হাতে উঠেছে নৌকা প্রতীকও। তৃণমূল নেতাকর্মীদের মতামতকে উপেক্ষা করে দেয়া ধুনট ও নন্দীগ্রামে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারেনি। এ জন্য নেতাকর্মীরা দায়ী করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে। 

Comments