আমেরিকা মোটেও শিক্ষা নেয়নি

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র ও পেন্টাগন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার তিন দিন পর মার্কিন কংগ্রেস তাড়াহুড়া করে প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা দিয়েছিল ‘যেসব জাতি সংগঠন বা ব্যক্তি সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা, অনুমোদন, সংঘটিত অথবা সহায়তা করেছে বলে তিনি নির্ধারণ করবেন, সেগুলোর বিরুদ্ধে সব প্রয়োজনীয় ও যথাযথ শক্তি প্রয়োগ’ করার জন্য।
কংগ্রেসের সে সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হতে পারত। তবে মাত্র একজনের ভিন্নমতের কারণে তা সম্ভব হয়নি। তিনি হলেন, প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য বারবারা জে. লি। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সামরিক প্রতিশোধ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না।’ বারবারা বলেছিলেন, ‘আমরা যে অশুভ শক্তির নিন্দা করছি, কাজে নেমে নিজেরাই যেন তা হয়ে না যাই।’
আমেরিকা মোটেও শিক্ষা নেয়নি
তখন হয়তো সহকর্মীদের মনে হয়েছিল, বারবারা লি ‘অতিমাত্রায় সাবধানী কিংবা বাস্তববাদী নন’। আমেরিকার যে নাগরিকেরা সে সময়ে দম বন্ধ করে আশঙ্কা করছিলেন ৯/১১-এর প্রতিশোধের, তারা হয়তো বারবারাকে দেশপ্রেমবর্জিত বলে ভাবছিলেন। তবে তা ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি কর্ণপাত করা হলে অনেক মিলিয়ন জীবন রক্ষা করা সম্ভব হতো।
তবুও বিস্ময়ের ব্যাপার, গত চৌদ্দ বছরেও আমেরিকানরা কাজের পরিণামের ব্যাপারে সে ঘটনা থেকে কোনো কিছুই শিখেনি । যুক্তরাষ্ট্রের ঔদ্ধত্যপূর্ণ অহঙ্কারের প্রতিক্রিয়ার কথা বিন্দুমাত্রও স্বীকার করে না আমেরিকানরা। আমাদের চিন্তা ও কর্মের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেয়ার অক্ষমতা দায়েশ, অর্থাৎ আইসিস, আইসিল বা আইএস-এর উত্থান ঘটিয়েছে। একই কারণে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়াসহ বহু অঞ্চলে বিপজ্জনক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। অতীত থেকে শিখতে না চাওয়ারই প্রতিফলন ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে Hate Crime বা বিদ্বেষমূলক অপরাধের মাত্রা তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়ে যাওয়ার মধ্যে।
গত ২ ডিসেম্বর সান বার্নার্ডিনোতে দায়েশের ‘সমর্থক’ দু’ব্যক্তি গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করেছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘হেইট ক্রাইম’ নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। এসব অপরাধের কারণ হলো- কারো ধর্ম ও মূল পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞতাপ্রসূত ভুল ধারণা এবং মতান্ধতা। এ ক্ষেত্রে ভীতি প্রদর্শনের জন্য আশ্রয় নেয়া হয় সহিংসতার। মাত্র গত এক সপ্তাহে মুসলমানদের টার্গেট করে সন্ত্রাসী ঘটনার যে জোয়ার উঠেছে, তাতে ঘটছে আফ্রো-আমেরিকানদের অতীতে আতঙ্কিত করার ব্যাপকভিত্তিক অপসংস্কৃতির প্রতিফলন। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে বিংশ শতাব্দীতে এটা ঘটেছিল।
বিদ্বেষাত্মক প্রপাগান্ডা এখন এত বেশি যে, এ দেশের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের বৃহত্তম সংগঠনটি তাদের ওয়েবসাইটকে প্রচারণা ঝড়ের উপযোগী রাখার জন্য এর সার্ভারগুলোকে আপগ্রেড করতে হয়েছে।
এসব কিছুর গোড়া হচ্ছে, ‘অন্যের ব্যাপারে’ চরম ভীতি। Xenophobia (জেনোফোবিয়া) হলো, বিদেশী বা নবাগতের ব্যাপারে অযৌক্তিক ভীতি বা ঘৃণা। সহিংস কর্মের কারণ হতে পারে, এমন বিপজ্জনক অনেক ‘ইজম’-এর উৎস এই জেনোফোবিয়া।
স্বীকৃতি পাচ্ছে মতান্ধতা
জেনোফোবিয়া সাধারণ মানুষের কালচারে এত মারাত্মকভাবে অনুপ্রবেশ করছে যে, এর টার্গেট যারা নন, তারা এর উপস্থিতি সম্পর্কে অসচেতন। তারা প্রায় সময়েই জেনোফোবিয়ার অস্তিত্ব অস্বীকার করে থাকেন। এ থেকে বুঝা যায়, বর্ণবাদ একটা ব্যবস্থা বা সিস্টেমের রূপ নিয়েছে। আমেরিকানদের বিরাট অংশই মেকি সহিষ্ণুতার আবরণ সরিয়ে নিচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো পাবলিক ফিগার জনগণের কাছে আবেদন রাখছেন, যাতে পারস্পরিক সহনশীলতা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।
হঠাৎ দেখা যাচ্ছে, অন্ধবিশ্বাস নগ্নভাবে শুধু গ্রহণযোগ্যতাই পাচ্ছে না; এটাকে ‘স্বাভাবিক’ বলেও মনে করা হচ্ছে। কিন্তু এটা না গ্রহণীয়, আর না স্বাভাবিক ব্যাপার।
ট্রাম্প বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে সব মুসলমানকে নিষিদ্ধ করো।’ আর এ দিকে ক্যালিফোর্নিয়ায় গুলিতে হত্যাযজ্ঞ ঘটার পর সংঘটিত বিদ্বেষাত্মক অপরাধ বেড়েই চলেছে। এসব কিছ কোনোমতেই মেনে নেয়া যায় না।
ঘটনার বিশদ বয়ান
১২/৪ : পাম বিচ ইসলামিক সেন্টারের জানালাগুলোয় প্রায় অর্ধেকই রাতারাতি ভেঙেচুরে দেয়া হয়; আসবাবপত্র ছিল ওল্টানো।
১২/৪ : সেন্ট লুইসে কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন্স (CAIR)- এর কাছে পাঠানো ভয়েস মেল থেকে জানা গেছে, এক ব্যক্তি হুমকি দেয় যে, তার বাড়িতে মুসলমানেরা যদি আসে, তাহলে ওদের মাথা কেটে ফেলা হবে। এফবিআই এ ঘটনায় সন্দেহভাজন এক লোককে গ্রেফতার করলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হবে বলে মনে হয় না। 
১২/৫: কুইন্স এলাকায় একজন মুসলিম দোকানিকে ঘুষি মেরে এক ব্যক্তি চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘আমি মুসলমানদের খুন করি!’ পুলিশ ঘটনাটির তদন্ত করছে ‘হেইট ক্রাইম’ হিসেবে।
১২/৫ : ইন্ডিয়ানা থেকে নির্বাচিত মুসলিম কংগ্রেস সদস্য হত্যার হুমকি পেয়েছেন। 
১২/৫: হিজাব পরিহিত এক মহিলা নিউ ট্যাম্পা মসজিদ থেকে কার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক ব্যক্তি তার গাড়িকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়তে থাকে। এতে গাড়িটি রাস্তা থেকে ছিঁটকে পড়ার উপক্রম হয়।
১২/৬ : ক্যালিফোর্নিয়াতে শিখ মন্দিরের গায়ে ইসলামকে হেয় করে দেয়াল লিখন দেখা যায়।
১২/৬ : একটি পার্কে কয়েকজন মুসলমান নামাজ পড়ছিলেন। এমন সময়ে জনৈক মহিলা জোরে ইসলামবিরোধী ধ্বনি দিয়ে তাদের প্রতি গরম কফি নিক্ষেপ করে।
১২/৭ : গুইনেট কাউন্টি এলাকায় একজন শিক্ষক তার ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার কাঁধের ব্যাগে কি বোমা আছে?’ ১৩ বছর বয়সী মেয়েটি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। 
১২/৭ : নিউ ইয়র্ক ম্যানহাটানে একটি রেস্তরাঁয় এক ব্যক্তি কর্মচারীদের কাছে জানতে চায়, তারা মুসলমান কি না। সে তাদের একজনকে চড় মারতে উদ্যত হয়। পরে সে ফিরে এসে দোকানটির একটি কাচের পার্টিশন ভেঙে ফেলে। এর বিরুদ্ধে হেইট ক্রাইম-এর অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
১২/৭ : নিউ জার্সির একটি মসজিদে কয়েকটি চিঠি এসেছে যাতে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। একটি চিঠিতে মুসলমানদের অভিহিত করা হয়েছে ‘শয়তান’ হিসেবে। 
১২/৮ : ফিলাডেলফিয়ার আল আকসা ইসলামিক সোসাইটি ভবনের বাইরে শূকরের মাথা পড়ে থাকতে দেখা যায়। রাতে একটি ট্রাক থেকে কেউ এটা ছুড়ে ফেলেছিল। এফবিআই এবং পুলিশ এ ব্যাপারে তদন্ত চালাচ্ছে।
১২/৯ : সিয়াটল শহরে একজন ট্যাক্সিচালককে কয়েকজন যাত্রী প্রহার করে বলে, ‘তুমি একজন সন্ত্রাসী।’ পুলিশ ঘটনাটিকে হেইট ক্রাইম হিসেবে গণ্য করেছে।
১২/৯ : এক লোক নিউ ইয়র্ক ব্রুকলিনের একটি বাস স্টপেজে জনৈক মহিলার পথ চলা আটকে দিয়ে বলেছে, ‘তোমাদের মতো আবর্জনাগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্র কবে মুক্ত হবে, সে জন্য আমি অপেক্ষা করতে পারছি না।’ এরপরই মহিলাকে সে লাথি মারে। পুলিশ তদন্ত করছে এ ব্যাপারে।
১২/১০ : কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশন্সের অফিসগুলো খালি করে দিতে হয়। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানের কাছে একটি চিঠি আসে যার সাথে ছিল সাদা পাউডার এবং চিঠিতে লেখা : মুসলমানেরা, তোদের কষ্টকর মৃত্যু হোক।’ অবশ্য এই পাউডার বিপজ্জনক নয় বলে প্রমাণিত।
১২/১০ : ফিনিক্স এলাকার ইসলামিক কমিউনিটি সেন্টারের জানালাগুলো ও একটি বাতি চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়া হয়। তবে এ ঘটনার কোনো তদন্ত হয়নি।
১২/১০ : নর্থ ডাকোটা রাজ্যের গ্রান্ড ফর্কসে একটি সোমালি রেস্তরাঁয় আগুন লাগানোর অভিযোগ আনা হয় এক লোকের বিরুদ্ধে। এর কয়েক দিন আগে দোকানটির গায়ে নাৎসিদের প্রতীক এঁকে লিখে দেয়া হয়েছিল, ‘ঘরে ফিরে যাও।’
১২/১০ : একজন মুসলিম নারী ট্যাম্পা এলাকায় মসজিদ থেকে যাচ্ছিলেন কার চালিয়ে। এ সময়ে গাড়িটির ওপর বন্দুকের গুলিবর্ষণ করা হয়। ফ্লোরিডার কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশন্স এ তথ্য দিয়েছে।
১২/১০ : একটি মুসিলম পরিবার সম্প্রতি টেক্সাসের প্লানো এলাকায় বসবাস শুরু করেছে। ছ’সপ্তাহ পরই, মাত্র দু’দিনে তাদের ঘরের জানালা দু’বার ভাঙা হয়েছে।
১২/১১ : ২৩ বছরের এক যুবক ক্যালিফোর্নিয়ার কোচেলা এলাকার ইবরাহীম মসজিদ পুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টার দায়ে গ্রেফতার ও অভিযুক্ত হয়েছে।
১২/১২ : টেক্সাসের ডালাসে মসজিদের বাইরে ২০ জনের মতো লোক সশস্ত্র অবস্থায় বিক্ষোভ করে ভীতি প্রদর্শন করেছে।
১২/১২ : গ্রান্ড র‌্যাপিডস এলাকায় একজন পাঞ্জাবি কর্মচারীর মুখে গুলি করা হয়। দৃশ্যত ডাকাতি হলেও এ ঘটনায় হামলাকারী তাকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে অভিহিত করেছে। তদুপরি, সে বলেছে, ‘আমি তোদের মতো লোকদের ইরাকে হত্যা করেছি। এ জন্য আমার কোনো সমস্যা হয়নি।’ এসব কথা তাৎপর্যপূর্ণ হলেও পুলিশ তদন্তের সময় বলেছে, ‘এটাকে হেইট ক্রাইম বলতে আমরা রাজি নই।’
১২/১৩ : ক্যালিফোর্নিয়ার হ’থর্নে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের প্রার্থনাগারের ভেতরে ‘যিশু’ লেখা হয় এবং হ্যান্ড গ্রেনেডের প্লাস্টিক নির্মিত প্রতিকৃতি পাওয়া যায়। এ ছাড়া স্থানীয় ইসলামিক সেন্টারের সামনে লিখে দেয়া হয়, ‘যিশুই অনুসরণীয়।’
এ দিকে দেখা যায়, অন্যান্য সম্প্রদায় সম্পর্কে অজ্ঞতার দরুণ এমন মানুষেরাও টার্গেট হচ্ছেন যাদের এসব ভিত্তিহীন ঘৃণার পাত্র হওয়ার কথা নয়। যেমন- মুসলমানের সাথে শিখরাও শিকার হচ্ছেন কখনো কখনো। অথচ ইসলাম ও শিখ ধর্ম পরস্পর থেকে ভিন্ন। উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরা মস্তকের আবরণ ব্যবহার করলেও দু’য়ের চেহারা এক নয়।
‘সন্ত্রাসবাদ’ কথাটার মতো এর বিরুদ্ধে লড়াই করার ব্যাপারও হাস্যকর আর অস্বচ্ছ। এই গলদ পূর্বোক্ত বারবারা জে. লি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। উল্লিখিত ধরনের অপরাধ অব্যাহত থাকার মধ্যে বেদনাদায়ক পরিহাস হলো- ‘অন্য’রা হতে পারে সন্ত্রাসী- এই মজ্জাগত ভীতি তাদেরকেই সন্ত্রাসীতে পরিণত করছে যারা এই শঙ্কায় সন্ত্রস্ত।
ভাষান্তর- মীযানুল করীম
-

Comments