গোপনে দেশ ছাড়লেন টুটুল একই পথে অনেকে
কাউকে শনাক্ত বা গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এরই মধ্যে অনেকটা নীরবে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন হামলায় আহত শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল। দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন লেখক-ব্লগার রণদীপম বসুও। আর চাপাতির আঘাত নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এখনও দিন পার করছেন আরেক ব্লগার তারেক রহিম। লেখক-ব্লগার-প্রকাশকরা বলছেন, সবার মনের মধ্যেই নিরাপত্তাহীনতা জেঁকে বসেছে। তাই গোপনে অনেকেই দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন। যার যেখানে আত্মীয়-স্বজন রয়েছে বা সুযোগ-সুবিধা মিলছে, তারা সেখানেই পাড়ি জমাচ্ছেন। তাদের দাবি, একের পর এক হামলা আর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও পুলিশ হামলাকারীদের ধরতে পারছে না। এ কারণে হামলাকারীদের পরবর্তী টার্গেট হতে পারেন এই আশঙ্কায় তারা দেশ ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
গত ৩১শে অক্টোবর দুপুরে প্রায় একই সময়ে লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর ও শাহবাগের আজিজ মার্কেটের জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়। একই দিনে দুই প্রকাশনা কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও শাহবাগ থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের হয়। দুটি মামলাই তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি। লালমাটিয়ার শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে হামলা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপকমিশনার (পশ্চিম) সাজ্জাদুর রহমান বলেন, আমরা হামলাকারীদের শনাক্ত করতে চেষ্টা করছি। প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ও গুপ্তচর লাগিয়ে হামলাকারীদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। শাহবাগ আজিজ মার্কেটের জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে এর মালিক ফয়সল আরেফিন দীপনকে গলা কেটে হত্যার ঘটনার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপকমিশনার (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, দীপনের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার জোর প্রচেষ্টা চলছে। পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি তদন্ত করছে বলেও জানান তিনি।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, মোবাইল ফোনের কললিস্ট ও একটি ভিডিও ফুটেজ যাচাই-বাছাই করে খুনিদের শনাক্ত করতে চেষ্টা চলছে। ডিবির দুটি পৃথক ইউনিট দুই মামলার তদন্ত করলেও পারস্পরিক তথ্য আদান-প্রদান ও সমন্বয় করেই মামলা দুটির তদন্ত চলছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, পৃথক গ্রুপ দুই প্রকাশনা কার্যালয়ে হামলা চালালেও তাদের নির্দেশদাতা একই ব্যক্তি। এ কারণে যে কোনো একটি গ্রুপের কাউকে শনাক্ত করতে পারলে অপর হামলাকারী গ্রুপটিকেও শনাক্ত করা যাবে তারা মনে করছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ঘটনার আগে ও পরে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট ও লালমাটিয়ার শুদ্ধস্বরের কার্যালয় এলাকার সব মোবাইল অপারেটরের কললিস্ট সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে সামনে রেখে মামলার তদন্ত কাজ চলছে। আনসারুল্লাহর বিভিন্ন স্লিপার সেলের সদস্যদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে ডিবি পুলিশ ও র্যাব কিছু সন্দেহভাজনদের মুখচ্ছবি শনাক্ত করে তাদের বিস্তারিত পরিচয় উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছেন। মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ভিডিও ফুটেজ থেকে ৬ সন্দেহভাজনের যে ছবি দেয়া হয়েছিল তাদের বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
জানতে চাইলে নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অনারারি শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, এ নিয়ে কি বলবো? পুলিশ কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে জানায়নি। আমি কি করবো? আমার কিইবা করার রয়েছে।
দেশ ছাড়লেন টুটুল, রণদীপম বসুও ছাড়বেন: এদিকে হামলার শিকার প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল সপ্তাহখানেক আগে ঢাকা মেডিক্যাল থেকে রিলিজ নিয়ে নিজ বাসায় ফেরেন। এর দুদিনের মাথায় অনেকটা গোপনেই তিনি চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। টুটুলের ঘনিষ্ঠ এক প্রকাশক শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী রবীন আহসান জানান, টুটুল দেশ ছেড়ে আমেরিকায় চলে গেছে। তার স্ত্রী-সন্তানও চলে গেছে আমেরিকায়। তবে টুটুলের ঘনিষ্ঠ আরেক লেখক বন্ধু জানান, টুটুল হাসপাতালেও প্রতিটা মুহূর্তে আতঙ্কে ছিল। ঘাতকরা তাকে আবারো হত্যা চেষ্টা করতে পারে। এ কারণে হাসপাতাল ছাড়ার দুদিনের মাথায় সে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়। তার স্ত্রী-সন্তান এখনও দেশে রয়েছে। তবে তাদের আমেকিরায় নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান তিনি। তবে টুটুলের স্ত্রী শামীমা রুনার যোগাযোগের নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। টুটুলের ওই লেখক বন্ধু জানান, রণদীপমও দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রণদীপমেরও প্রতিটা মুহূর্ত আতঙ্কে কাটছে। সবসময় ভীতি কাজ করে তার মধ্যে। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরাও করতে পারছেন না তিনি।
তারেক এখনও হাসপাতালে: এদিকে শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে হামালার শিকার হওয়া প্রকৌশলী ও ব্লগার তারেক রহিম এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১৬ নম্বর কেবিনে চলছে তার চিকিৎসা। গতকাল তারেকের কেবিনে গিয়ে দেখা যায় তিনি ঘুমাচ্ছেন। কেবিনের সামনে রয়েছেন দুই পুলিশ সদস্য। তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে বাম হাতে আরও একটি অপারেশন করাতে হবে বলে জানিয়েছেন তার ভাই ইমরান। দুর্বৃত্তদের চাপাতির কোপ ঠেকাতে হাত এগিয়ে দেয়ায় তার হাতের আঙুলে অন্তত ৬টি কোপ পড়েছিল। তারেকের আরেক ভাই আদেল জানান, তারা এখনও আতঙ্কে রয়েছেন। দুর্বৃত্তরা তারেককে আবারও হামলা করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
গোপনে দেশ ছাড়ছেন অনেকেই: এদিকে ধারাবাহিকভাবে খুন, হামলা আর হুমকিতে থাকা অনেক ব্লগার-প্রকাশক-লেখক গোপনে দেশ ছাড়ছেন। এরই মধ্যে হুমকি পাওয়ার পর সময় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ ভারতে অবস্থানে করছেন বলে জানা গেছে। হুমকি পাওয়ার গত ২৮শে আগস্ট মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করেছিলেন ব্লগার শাম্মী হক। তিনি সম্প্রতি গোপনে জার্মানি পাড়ি জমান। দুই প্রকাশকের কার্যালয়ে অনেকের মধ্যেই আতঙ্ক ভর করেছে। এ কারণে গোপনে অনেকেই দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিষয়টি একান্ত ঘনিষ্ঠ স্বজন ছাড়া কারও সঙ্গে শেয়ার করছেন না তারা। কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করছেন, বিদেশে গিয়ে যেখানে থাকবেন সেখানেও হামলা হতে পারে। এ কারণে বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি গোপন রাখা হচ্ছে।
ভারতে সময় প্রকাশনীর মালিক
কোথাও আশ্রয় চাওয়ার কথা চিন্তা করছি না
তবে হুমকি প্রতিদিনই বাড়ছে
ঢাকায় এক প্রকাশককে কুপিয়ে হত্যার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে সময় প্রকাশনীর মালিক ও প্রকাশক ফরিদ আহমেদ হুমকির মুখে ভারতে অবস্থান করছেন। এ মাসের শুরুর দিকে তাকে হুমকি দেয় নতুন উগ্রপন্থি আল আহারা (ইউকে)। এ খবর দিয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া। খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার ফরিদ আহমেদকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে। কিন্তু এরপরও প্রকাশকদের যেভাবে টার্গেট করেছে জঙ্গিরা, তাতে তিনি উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, শুরুর দিকে ব্লগার ও লেখকদেরই টার্গেট করা হয়েছিল যারা উদারপন্থি ও সৃজনশীল চিন্তাধারার বিকাশ ঘটাতেন। কিন্তু এখন প্রকাশকদেরও হত্যা শুরু করেছে তারা, যাতে বিরুদ্ধ মতের কিছু প্রকাশিত না হয়।
ফরিদ আহমেদের সময় প্রকাশনী দেশের অন্যতম বৃহৎ প্রকাশনা সংস্থা। এখান থেকে এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখা শ’ শ’ বই ছাপানো হয়েছে। তিনি বলেন, জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সাল আবেদিন দীপনকে তার অফিসে নিষ্ঠুর কায়দায় হত্যার পরই এটা শুরু হয়। ১লা নভেম্বর আমি মোবাইলে একটি বার্তা পাই অপরিচিত নম্বর থেকে। সেখানে বলা হয়, ‘অনেক বই ছেপেছো। তোমার অনেক পাপ জমেছে। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।’ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আগের হত্যার দায় স্বীকার করলেও, ফরিদ আহমেদকে বার্তাটি পাঠিয়েছে নতুন সংগঠন আল আহারা (ইউকে)। মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধ সমপর্কে ১২ খণ্ডের বই ছাপানো ছাড়াও, গত তিন দশকে প্রায় ১২০০ বই ছাপিয়েছে সময় প্রকাশন। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধ ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে রচিত বই আমি প্রকাশ করে আসছি। যারা এ ভাবধারার বিরোধী, তাদের অনুভূতিতে হয়তো আঘাত লাগতে পারে। কিন্তু উদারপন্থি চিন্তাধারার প্রবাহ বন্ধ করার জন্য এটি কোন কারণ হতে পারে না। এর আগে অভিজিৎ রায়ের মতো ব্লগারদের হত্যার দায় নিয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। কিন্তু এরপরও কৌশল পাল্টে প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে স্তব্ধ করার পথে হাঁটে সংগঠনটি। যেদিন দীপনকে হত্যা করা হয়েছিল, তখন আরেক প্রকাশক আহমেদ রশিদ টুটুলকেও আঘাত করা হয়েছিল তার কার্যালয়ে। তিনি সহ আরও দুইজনকে মারাত্মক আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ওই খবর ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশের প্রকাশকরা প্রতিবাদের ডাক দেন। ফরিদ বলেন, ওই ঘটনাও হয়তো মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর ক্ষোভের কারণ হতে পারে। প্রকাশকদের ফোরাম বাংলাদেশ জ্ঞ্যান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাবেক সাধারণ সমপাদক ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, ব্লগার ও প্রকাশকদের হুমকি দিতে ওই গোষ্ঠীগুলো প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এসব মূলত স্থানীয় কিছু সংগঠন। সরকারের মতো তিনিও এ হুমকির সঙ্গে আইএস’র কোন সহযোগী সংস্থার সমপর্ক তৈরিতে রাজি হননি। বৃহসপতিবার বগুড়ায় একটি শিয়া মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর হামলার দায় স্বীকার করে আইএস। ফরিদ বলেন, কোথাও আশ্রয় চাওয়ার কথা আমি চিন্তা করছি না, যদিও হুমকি প্রতিদিনই বাড়ছে। তিনি নিজে কোন নিরাপত্তা সংস্থার দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছেন। তিনি বলেন, আমার প্রচেষ্টা সবসময়ই ছিল উদারপন্থি চিন্তাধারার প্রকাশ। কিন্তু প্রকাশকরা যদি দেশ ছেড়ে যায়, তবে সন্ত্রাসীরা মুক্ত হয়ে যাবে।
Comments
Post a Comment