আউটসোর্সিংয়ে সফল তিন নারী

মুমিতা মেশকাতমুমিতা মেশকাতসন্ধ্যা রায়
ঘরে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাজ করে দেওয়া—এর পোশাকি নাম ‘ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং’। বেশ কয়েক বছর ধরে 
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এ পেশায় সাফল্য পেয়েছেন। মুক্ত পেশাজীবী (ফ্রিল্যান্সার) হিসেবে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছেন। নারীদের অংশগ্রহণও এতে বাড়ছে ধীরে ধীরে। দেশের সফটওয়্যার ব্যবসা খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) ২০১১ সাল থেকে আউটসোর্সিং পুরস্কার দিয়ে আসছে। চলতি বছর নারীদের বিভাগে এই পুরস্কার পাওয়া তিনজন—সন্ধ্যা রায়, অজন্তা রেজওয়ানা মির্জা ও মুমিতা মেশকাতের সফল হওয়ার কাহিনি নিয়ে এই প্রতিবেদন। লিখেছেন নুরুন্নবীচৌধুরী
পরিচিতদের কাজ শেখান মুমিতা
পুরস্কার বিজয়ী ফ্রিল্যান্সার মুমিতা মেশকাতের শুরু ২০১২ সালে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় থেকেই কিছু করার চিন্তা ছিল। তবে ফ্রিল্যান্সিংয়ে যে সফলতা আসবে, সেটি তখনো বুঝতে পারেননি মুমিতা। স্বামীর আগ্রহ ও সহযোগিতায় যুক্ত হয়ে যান ফ্রিল্যান্সিংয়ে। শুরুতে ভিয়েতনামের একজনকে অনলাইনে অ্যানাটমি বিষয়ে পড়ানোর কাজ শুরু করেন মুমিতা। বলেন, ‘এরপর ব্লগ লেখা শুরু করলাম। বর্তমানে সাধারণ নিবন্ধ, স্বাস্থ্য নিবন্ধ, কারিগরি নিবন্ধ, ডেটা মাইনিং ও প্রেজেন্টেশন, চিকিৎসা গবেষণা, ডেটাবেইস তৈরি ইত্যাদির কাজ করছি।’ জন্ম কুমিল্লায়, তবে বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করছেন।
প্রতিদিন প্রায় আট ঘণ্টা কাজ করা মুমিতা এরই মধ্যে প্রায় দুই হাজার ঘণ্টা কাজ করেছেন। দেশে নারী ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা এখনো বেশি নয়। এর কারণ হিসেবে মুমিতা বলেন, ‘আমাদের এখনো ফ্রিল্যান্সিং কাজ বললেই অনেকে শুধু কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পেশাজীবীদের কাজ বলে মনে করেন। বিষয়টা ঠিক নয়। নানা ধরনের কাজ আছে, যার জন্য ইংরেজি জ্ঞান ও কম্পিউটারে দক্ষতাই যথেষ্ট। এর পাশাপাশি পরিবারের সহযোগিতাটা জরুরি।’
নারীদের এ কাজে আগ্রহী করা বা সহযোগিতা করার স্বপ্ন দেখছেন মুমিতা। আশাবাদী, একদিন এ কাজেও সফল হবেন তিনি। ফার্মেসি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মুমিতার বাবা মীর মোশাররফ হোসেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী। মা জিলুন নাহার সব সময় শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহ দেন। ল্যাবএইড ফার্মাসিউটিক্যালসে কর্মরত স্বামী মোস্তফা আল ইমরানের অনুপ্রেরণায় ভালোভাবে কাজ করে যেতে পারছেন বলে অভিমত মুমিতার। পুরস্কার পাওয়ার ব্যাপারে মুমিতা বলেন, ‘খুব খুশি লাগছে। এ পুরস্কার নিজের কাজকে আরও ভালোভাবে করার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জোগাবে।’ ইতিমধ্যে নিজের পরিচিত অনেককেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু করেছেন তিনি। এ কাজ করে যেতে চান। একলা পথে হাঁটতে হলেও এগিয়ে যেতে চান সবাইকে নিয়ে সামনের দিকে।
সন্ধ্যা স্বপ্ন দেখেন অনেকের কর্মসংস্থানের
২০১১ সাল থেকে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছেন সন্ধ্যা রায়। যখন তিনি ছাত্রী, তখন থেকেই আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চিন্তা করেন। আর সেই চিন্তা থেকে আউটসোর্সিংয়ে আসা। মূলত ওয়েবসাইট তৈরি (ওয়েব ডেভেলপমেন্ট) ও সফটওয়্যারের মান নিশ্চিত করার কাজ করেন সন্ধ্যা রায়। স্মার্টফোনের বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের প্রতিটি সংস্করণের বিশ্লেষণও করে দেন।
এরই মধ্যে প্রায় সাত হাজার ঘণ্টা কাজ করেছেন সন্ধ্যা। তিনি বলেন, ‘এখন লোকাইয়াক নামের একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের রিলিজ ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছি।’ তাঁর বাবা শ্যামচরণ রায় সরকারি চাকুরে এবং    মা গোপালী রায় গৃহিণী। তিন ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্ধ্যা কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে স্নাতক করেছেন ঢাকা সিটি কলেজ থেকে। আছেন ঢাকাতেই। ঢাকায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠা।
নিজের কাজের ক্ষেত্রে স্বামী সুমন সাহার সমর্থন এবং সহযোগিতাকে এগিয়ে রেখেছেন সন্ধ্যা রায়। বলেন, ‘আমার কাজের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান আমার পরিবারের। এখনো নারীদের ফ্রিল্যান্সিংকে পেশা হিসেবে নেওয়ার বিষয়টি কম। অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা ফ্রিল্যান্সিংকে পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে নেওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চয়তার অভাব বোধ করেন। আরেকটা বিষয় হলো শেখা ও জানার আগ্রহ কম থাকা। এটা বদলালে নারীরাও এ খাতে ভালো করতে পারবেন।’
সন্ধ্যা রায় স্বপ্ন দেখেন আগামী দুই বছরের মধ্যে নিজের প্রতিষ্ঠানে ২০০-এর বেশি লোকের কর্মসংস্থান হবে।
অজন্তা রেজওয়ানা মির্জা l ছবি: সাহাদাত পারভেজসাত দিনেই অজন্তা পেয়েছিলেন প্রথম কাজঅজন্তা রেজওয়ানা মির্জা। থাকেন ঢাকায়। কিন্তু চাকরিটা করেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (এসইও) প্রতিষ্ঠানে। পদের নাম ‘রাইটার ম্যানেজার’। মূলত তিনি একজন ফ্রিল্যান্সার। ২০১৩ সালে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শুরু করেছেন। আর দুই বছরের মধ্যেই পেলেন পুরস্কার।
আগে জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগে চাকরি করতেন অজন্তা। আউটসোর্সিংয়ের প্রথম কাজ পেতে সময় লেগেছিল মাত্র সাত দিন। বলেন, ‘আমার ভাগ্য ভালো, প্রথম কাজটা পেয়েছি ট্রান্সক্রিপশনের (ধারণ করা কথা শুনে লিখে দেওয়া)। কাজটা ছিল ২৫ মিনিটের অডিও শুনে লিখে দেওয়া। ভালো করে লিখে দেওয়ায় যাঁর কাজ, তাঁর কাছ থেকে দারুণ মন্তব্য পেয়েছি।’ এরপর দ্রুত এগিয়ে গেছেন অজন্তা। এখন একজন লেখক, সম্পাদক ও অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন অজন্তা। নিজের কাজ সম্পর্কে বললেন, ‘কাজ হিসেবে আমি ৫ থেকে ৩০ হাজার শব্দের ই-বুক, নিবন্ধ, ব্লগ, ওয়েবসাইটের লেখা লিখি।’ ৯০টি ই-বুক লিখেছেন তিনি। ইংরেজিভাষী না হওয়ায় শুরুর দিকে কাজ অনুযায়ী কম পারিশ্রমিক পেতেন। তবে এখন এ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে।
নারীদের ফ্রিল্যান্সিংয়ে আসার ব্যাপারে নানাভাবে সহায়তা করছেন অজন্তা। কীভাবে কাজ শুরু করতে হয়, কীভাবে ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসে প্রোফাইল তৈরি করতে হয়, এ বিষয়গুলো শেখাচ্ছেন নারীদের। পাশাপাশি নিজে কাজ নিয়ে কয়েকজন নারীকে দিয়েও করাচ্ছেন তিনি। বাবা মির্জা আবুল খায়ের ব্যবসায়ী এবং মা সেহেলা পারভীন গৃহিণী। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বামী রাশিদুল হাসান এবং দুই বছর বয়সী মেয়ে আয়েশাকে নিয়ে তাঁর সংসার। নিজের কাজে স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতা পাচ্ছেন নিয়মিত। ইচ্ছে আছে মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদেরও ফ্রিল্যান্সিং কাজে সাহায্য করার।

Comments