ভাল নেই স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ীরা
- উপার্জন দিয়ে সংসারই চলছে না
- রাজনৈতিক মাস্তানদের চাঁদাবাজিতে অতীষ্ঠ
- অস্বাভাবিক বেড়েছে লাইসেন্স ফি
- অনেকেই বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন
ইবরাহীম খলিল : রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল এ- কলেজের সামনের রাস্তায় ব্যবসা করেন জামালপুরের হারুণ মিয়া। ছোট্ট দোকানের আয় দিয়েই চালাতেন পাঁচ সদস্যের সংসার। কিন্তু হরতাল অবরোধ না থাকলেও দেশে এক ধরণের অস্থিরতা থাকায় বেচা-বিক্রি একদম কমে গেছে। এই আয় দিয়ে সংসার চালানো দূরের কথা, দোকানের ব্যয়ই মেটাতে পারছেন না তিনি। হারুন মিয়া বলেন, সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষরাই ফুটপাতে কেনাকাটা করেন। সরকার হঠাৎ করে গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বেড়েছে বাসা ভাড়া, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ। বাড়ানো হয়েছে গাড়ি ভাড়াও। ফলে সাধারণ মানুষের ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু আয় বাড়েনি। অনেক গার্মেন্টস বন্ধ হওয়ায় শ্রমিকরাও বেকার হয়ে পড়েছে। ব্যবসায় মন্দার কারণে অনেকে ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না। ফলে সীমিত আয় দিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষদের সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। খেয়ে-পরে বাঁচার পর সঞ্চয় না থাকলে মানুষ কাপড়-চোপড় কিনবে কীভাবে? এ কারণে ফুটপাথের বেচাকেনা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে।
রাজধানীর মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টন, দৈনিক বাংলা, চাঁদনী চক, ফার্মগেট বা নিউ মার্কেটের ফুটপাতের স্বল্প পূঁজির ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানকার ব্যবসায়ীরা সবাই বিভিন্ন এনজিও ও সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেন। প্রতিদিন লাভের একটা অংশ দিতে হয় এসব সংস্থাকে। কিন্তু অনেকেই তা দিতে পারছেন না। খরচ জোগাতে পারছেন না পরিবারেরও। মানুষের মধ্যে অজানা কারণে নতুন করে ব্যবসায় যেতে ভয় পাচ্ছেন।
তাদের মতে, মানুষ এখন নিজের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদার জন্যই কেনাকাটা করেন। একটু বিলাসী বা কম প্রয়োজনীয় পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন না। ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বেচাকেনা কমে গেছে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ এবং হকারদের অস্থায়ী স্বল্প পূঁজির ব্যবসায়ীর সংখ্যা আড়াই লাখেরও বেশি। এসব ব্যবসার সঙ্গে আরও ৫ লাখের বেশি মানুষ কাজ করে থাকেন। তাদের একজন রাজধানীর রাজারবাগে ফাস্টফুডের দোকান চালান নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, হোটেল ম্যানেজমেন্টে পড়াশোনা করে ব্যাংক থেকে সামান্য ঋণ নেয়া টাকার সঙ্গে বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে ধার দেনা করে একটা ছোট ফাস্টফুডের দোকান দিয়েছিলাম। কয়েক দিন পরপর মোবাইল কোর্টের অভিযান, স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের মাস্তানি আর চাঁদাবাজিতে ব্যবসা পরিচালনা করাই কঠিন হয়ে পড়ছে। তিনি জানান, ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে ফাস্ট ফুড দোকানের ট্রেড লাইসেন্স ফি। একদিকে ব্যবসা না হওয়ার পরও আবার ট্রেড লাইন্সেস নবায়ন করতে হয়েছে।
মুগদাপাড়ার বড় বাজার কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা লোকমান হোসেন জানান, সবজির দাম বেশি হওয়ায় এখন বেচাবিক্রি কমে গেছে। দাম কম থাকলে বেশি সবজি নিত ক্রেতারা। এখন দাম বেশি হওয়ায় নিচ্ছে কম। ফলে আমাদের মুনাফা কমে গেছে। মতিঝিলের ফুটপাথের কাপড় ব্যবসায়ী রাজীব জানান, আগে এই সময়ে শীতের কাপড় বিক্রি অনেক বাড়ত। কিন্তু এখন বিক্রি হচ্ছে খুবই কম। কমলাপুর স্টেশনের পাশে বিরিয়ানি দোকানের মালিক রফিকুল ইসলাম দৈনিক সংগ্রামকে জানান বেচাবিক্রির যে অবস্থা তাতে আর সংসার চলছে না। চিন্তা করছি দেশে গিয়ে গরুর খামার কিংবা অন্য কিছু করবো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে হরতাল অবরোধ না থাকলেও অনির্দিষ্টকালের অস্থিরতায় স্বল্পপূজির ব্যবসায়ীরা সরাসরি আক্রান্ত হচ্ছেন। বেচাকেনা কম হওয়ায় তাদের মুনাফা কমে গেছে। পুঁজি আটকে যাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে পারছেন না, অন্যদিকে ঋণের কিস্তিও দিতে পারছেন না। ফলে স্বল্পপূঁজির ব্যবসায়ীরা এখন ভালো নেই।
তারা বলছেন, ঢাকার আশপাশের সেতুগুলোর টোলের পরিমাণ বেড়েছে। ট্রেড লাইসেন্স ফি ও লাইসেন্স নবায়ন ফি এক লাফে বহুগুণ বেড়েছে। একদিকে বেচা-বিক্রি কমে যাওয়া অন্যদিকে নানা খাতে বাড়তি ব্যয়ের চাপ সামলাতে গিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিবর্তে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। দৈনন্দিন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে না পেরে অনেক ছোট ব্যবসায়ী ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা। ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, দেশে যে কোনো সমস্যায় বড় শিল্পোদ্যোক্তা সরকারের কাছ থেকে সুবিধা পেলেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কোনো সুবিধা পায় না। তাছাড়া ট্রেড লাইসেন্স ফি ও নবায়ন ফি বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের অনেক বড়তি ব্যয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এতদিন ফাস্টফুড দোকানের লাইসেন্স ফি ছিল ৩০০ টাকা। ফি বাড়িয়ে এখন করা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। কনফেকশনারির ট্রেড লাইসেন্স ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে দুই হাজার টাকা। মুদি দোকানের ট্রেড লাইসেন্স ফি ৩৫০ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে এক হাজার টাকা। মাছের দোকানের ফি ৩০০ থেকে করা হয়েছে চার হাজার টাকা। সেলুনের ফি ৩০০ থেকে এক হাজার, মুরগির দোকানের ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া তরকারির দোকানের ট্রেড লাইসেন্স ফি ২৫০ থেকে ৫০০, চায়ের দোকানের ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির হেলাল উদ্দিন বলেন, গত বছর যেখানে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে লেগেছে ৯০০ টাকা, এবার খরচ হচ্ছে ১১ হাজার টাকা। তাছাড়া গত পাঁচ বছরের বকেয়া ভ্যাট একসঙ্গে দিতে হয়েছে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ব্যবসায় মানুষ ফিরবে না বলেও মনে করেন এখাতের সঙ্গে জড়িতরা। এছাড়া বড় ব্যবসায়ীদের মতো স্বল্পপূঁজির ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর কথা বলেন ব্যবসায়ীরা।
Comments
Post a Comment