চাকরির জন্য বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ

চাকরি করছেন অথবা নতুন চাকরি খুঁজছেন? উভয়ের জন্যই দুঃসংবাদ। কারণ, চাকরির জন্য বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ ১০টি দেশের একটি বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গ্যালাপের করা এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গ্যালাপের গবেষণার ভিত্তিতে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল চাকরির জন্য সবচেয়ে ভালো এবং সবচেয়ে খারাপ দেশগুলোর একটি ক্রমতালিকা (র্যাঙ্কিং) করেছে। তাতে খারাপের দিক থেকে ১০ নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ। গবেষণা প্রতিবেদনটি বলছে, বাংলাদেশে চাকরিজীবীদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ মানুষ নিজ নিজ চাকরি নিয়ে পরিপূর্ণভাবে সন্তুষ্ট। আর মোটের ওপর সন্তুষ্ট কর্মজীবীদের ১০ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৫ কোটি ৪১ লাখ লোক বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। যদিও গ্যালাপের গবেষণা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যাঁদের বড় অংশই কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট নয়।
বিশ্বের ১৫৮টি দেশের কর্মজীবী মানুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে গ্যালাপ। একজন চাকরিজীবী তাঁর নিজের চাকরিকে কতটা উপভোগ করেন, কতটা তিনি তাঁর কাজের সঙ্গে মানসিকভাবে সম্পৃক্ত হতে পেরেছেন—এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এ গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়, যাতে বাংলাদেশের ফলাফল খুবই হতাশাজনক।
বাংলাদেশ ছাড়াও গবেষণা প্রতিবেদনটিতে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ২২টি দেশের পরিস্থিতিও তুলে ধরা হয়েছে। তাতে ভারতে ২৫ শতাংশ, পাকিস্তানে ২২ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ২০ শতাংশ, ভুটানে ১০ শতাংশ চাকরিজীবী তাঁদের চাকরি নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
গবেষণাটির সুবিধার্থে চাকরিকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর একটি হলো ভালো চাকরি বা গুড জব, অন্যটি হলো খুবই ভালো বা গ্রেট জব। চাকরিতে কত ঘণ্টা কাজ করতে হচ্ছে, নিয়মিত বেতন মিলছে কি না—এসব বিষয়ও চাকরির ভালো-মন্দ নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে। 
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর র্যাঙ্কিংয়ে বলা হয়েছে, চাকরির জন্য বিশ্বের সবচেয়ে ভালো দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পানামা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরিজীবীদের মধ্যে ১৩ শতাংশ তাঁদের চাকরি নিয়ে খুব সন্তুষ্ট। আর ৪৪ শতাংশ বলেছে, তারা মোটের ওপর সন্তুষ্ট। পানামায় এ হার যথাক্রমে ১৩ ও ৩১ শতাংশ। অর্থাৎ দেশটির ১৩ শতাংশ চাকরিজীবী তাঁদের কাজ নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট আর ৩১ শতাংশ মোটের ওপর সন্তুষ্ট।
অপরদিকে, চাকরি করার জন্য খারাপ ১০টি দেশের মধ্যে আটটিই আফ্রিকা মহাদেশের। আর বাকি দুটি এশিয়ার। চাকরির জন্য খারাপ দেশের তালিকার শীর্ষে রয়েছে আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসো। দেশটিতে চাকরিজীবীদের মধ্যে ৫ শতাংশ লোক তাঁদের কাজ নিয়ে মোটামুটি সন্তুষ্ট। আর ১ শতাংশ খুবই সন্তুষ্ট বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। চাকরি নিয়ে দেশটির এ দুরবস্থার জন্য দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশটির মোট জনসংখ্যার মধ্যে ১ শতাংশেরও কম লোকের উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের ডিগ্রি রয়েছে।
গ্যালাপের প্রতিবেদন বলছে, চাকরি করার জন্য সবচেয়ে ভালো মহাদেশ হলো উত্তর আমেরিকা। এ মহাদেশে ৪৩ শতাংশ মানুষ নিজের চাকরি নিয়ে সন্তুষ্ট। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে ৪০ শতাংশ, ইউরোপে ৩৪ শতাংশ, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দেশগুলোয় ২৮ শতাংশ, এশিয়ায় ২৫ শতাংশ, মধ্যপ্রাচ্যে ১৯ শতাংশ ও আফ্রিকা মহাদেশে ১১ শতাংশ মানুষ নিজেদের চাকরি নিয়ে সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন গবেষকদের কাছে। 
খুব ভালো চাকরি বা গ্রেট জবের ক্ষেত্রেও শীর্ষ মহাদেশ হলো উত্তর আমেরিকা। গ্রেট জবের গুরুত্ব সম্পর্কে গবেষণায় বলা হয়েছে, এ ধরনের কাজই সারা বিশ্বে নতুন চাকরি তৈরির ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করে।
চাকরির জন্য ভালো দেশের তালিকার শীর্ষে না থাকলেও শতাংশের হিসাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৫৮ শতাংশ মানুষ ভালো চাকরি করেন। তবে খুব ভালো বা গ্রেট জব করেন এমন মানুষের সংখ্যা ১০ শতাংশ।
গ্যালাপের গবেষণায় বলা হয়েছে, একটি দেশের অর্থনীতি যত বেশি শক্তিশালী, সে দেশে ভালো ও খুব ভালো চাকরির সংখ্যা বেশি। গুণগত শিক্ষা, আইনের শাসন, কম দুর্নীতি একটি দেশে ভালো চাকরির প্রাপ্যতা বাড়ায়। যেসব দেশের মাথাপিছু আয় বেশি, সেসব দেশে ‘খুব ভালো’ চাকরি বেশি পাওয়া যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত—এ দেশ তিনটি উচ্চ মাথাপিছু আয়ের কারণে ভালো চাকরির তালিকার শীর্ষ দশে রয়েছে। দেশগুলোর মাথাপিছু আয় ৫০ হাজার থেকে ৬৭ হাজার ডলার। অন্যদিকে খারাপ চাকরির দিক দিয়ে শীর্ষ দশে থাকা প্রতিটি দেশেরই মাথাপিছু আয় তিন হাজার ডলারের কম।
শিক্ষার হার ও মানকে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণায়। চাকরির জন্য ভালোর তালিকায় শীর্ষ যে ১০টি দেশ রয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিতে শিক্ষার হার কমপক্ষে ৯৪ শতাংশ।
এদিকে, শিক্ষার অভাবে যে ভালো চাকরি মেলে না, সেটি দেশীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক সাম্প্রতিক গবেষণাতেও উঠে এসেছে। সিপিডির গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের একটি বড় অংশ অদক্ষ, তারা ইংরেজিতে ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। শুধু ইংরেজি বলতে না পারার কারণে বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা একই কাজ করেও অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের চেয়ে কম বেতন পান। শিক্ষার অভাবে তাই বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা উন্নত চাকরি পান না। 
জানতে চাইলে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ গবেষণায় বাংলাদেশের কর্মপরিবেশের বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে। একদিকে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা শ্রমঘন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করেন, অপরদিকে তাঁদের দক্ষতার সমস্যা আছে। উৎপাদনশীলতা, কর্মপরিবেশ, দক্ষতা বৃদ্ধি—এ তিনটি ক্ষেত্রে উন্নতি করতে না পারলে এসব র্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি হবে না।’ ভালো চাকরির জন্য শিক্ষার মান বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি।

Comments