সোনালি কাবিনের কথা

ওমর বিশ্বাস
আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ এর বিশ্লেষণ নানাভাবে হতে পারে। ৪১টি কবিতা নিয়ে সোনালি কাবিন গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে একটি কবিতা ‘সোনালি কাবিন’ এবং এই কাব্য শিরোনামে গ্রন্থটির নামকরণ করা হয়। প্রকাশের পর গ্রন্থটি যত না আলোচনায় আসে তারচেয়ে অনেক বেশি আলোচনায় স্থান দখল করে নেয় সোনালি কাবিন কবিতাটি। কবিতাটি গ্রন্থভুক্ত হয়ে প্রকাশের অনেক আগেই বাংলা কাব্য সাহিত্যে আলোড়ন তোলে। সামগ্রিক বিচারে বাংলা কাব্য সাহিত্যে ‘সোনালি কাবিন’ নামটিই অধিক আলোচনার বিষয়স্তুতে পরিণত হয়। কবিতাটি ১৪টি সনেট দিয়ে সাজানো। কাজেই কাব্যগ্রন্থ হিসেবে ‘সোনালি কাবিন’ ও ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ স্বতন্ত্র গুরুত্ব বহন করে। সনেট গুচ্ছের আকর্ষণ কাব্যপ্রেমীদের কাছে নানাভাবে অনস্বীকার্য। নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণও। সার্বিক দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থটির আকর্ষণের পিছনে সোনালি কাবিনের সনেটগুচ্ছের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি।

আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতা কোনটি তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তেমনি বিতর্ক হতে পারে তার শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ কোনটি তা নিয়েও। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা যে ‘সোনালি কাবিন’ তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আর বলা যায় ‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থটি শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ গুলোর মধ্যে একটি। তবে আল মাহমুদ তার এই কাব্যগ্রন্থের নাম প্রথমে সোনালি কাবিন রাখতে চাননি।

সোনালি কাবিন আল মাহমুদকে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। তার কাব্যখ্যাতি, যশ, কাব্যপ্রতিপত্তির সাথে মিশে আসে সোনালি কাবিন। আল মাহমুদ নিজেও জানতেন তার এই কাব্যগ্রন্থটি জনপ্রিয় হবে। বাস্তবে হয়েছেও তাই। তার এই বইটির নাম প্রথমে তিনি ঠিক করেছিলেন ‘অবগাহনের শব্দ” নামে। তবে পরবর্তীতে তিনি তার এই নামটি পরিবর্তন করেন।

তার প্রিয়তমা নারীর উদ্দেশ্যে লেখা ১৪টি সনেট কাব্যসাহিত্যে অমর হলেও কবির পরিকল্পনা ছিল ২৫টি সনেট দিয়ে সোনালি কাবিন কবিতাটি সাজানো। তবে তিনি বিভিন্ন সময়ে বলেছেন যে, ১৪টি সনেট লেখার পর তার পক্ষে কোনোভাবেই বাকি সনেটগুলো লেখা আর সম্ভব হয়নি। এই ১৪টি সনেটের ভিতর তিনি প্রেম, কামনার বিষয়কে এনেছেন। আস্থা ছিল সমাজতান্ত্রিক সাম্যব্যবস্থার প্রতি, স্বজাত্যবোধও ছিল। এটাও যুক্ত হয়েছে কবিতাটিতে। তবে আল মাহমুদ জানিয়েছেন তার এই স্বজাত্যবোধ লাগাম ছাড়া জাতীয়তাবাদ নয়।

সোনালি কাবিনে নর-নারীর চিরায়ত সম্পর্কের মাধ্যমেই বলা হয়েছে অনেক কথা। এসেছে অনেক দিক। এইসব সামগ্রিক বিষয় নিয়েই সোনালি কাবিন। সনেটগুচ্ছে আবহমান বাংলার চিত্র উঠে এসেছে। সনেটে ঐতিহ্য, সংগ্রাম, বিপ্লব প্রতিলিপি আছে। তবে এসবের বিষয়-আশয় খোঁজা হয়েছে পরে, বিশেষ করে সনেটগুচ্ছে কাব্যগুণ বর্ণনা করতে যেয়ে। সনেটগুচ্ছে বক্তব্যের বিষয়বস্তু যেমন আকর্ষণীয় তেমন আকর্ষণীয় এর উপস্থাপনার কৌশল। একই সঙ্গে তা চিত্তাকর্ষকও বটে। আল মাহমুদের উপস্থাপনা কৌশলে বরাবর কুশলী। নিজের স্বীকৃত আন্ধা হলেও তার বর্তমান সময়ের কবিতাগুলোও নতুনের গন্ধ বিলোয়। বাস্তবেও তিনি চোখে তেমন দেখেন না বললেও চলে, তবে তার অন্তর দৃষ্টি এখনো তীক্ষ্ম। আর সেই যৌবন তারুণ্যে কাব্যজয়ী কবির সনেট এখনো যেন নতুনই রয়ে গেছে।

সোনালি কাবিনের আকর্ষণ হচ্ছে প্রেমময় কাব্যকলায় সমর্পণের ভাষা। নদীর জোয়ারের মতো এ ভাষার টান। এই টান স্বাভাবিকভাবে উপেক্ষার নয়। যে কোনো কাব্যপ্রেমিকের কাছে এর আকর্ষণ শক্তি প্রবল। তারুণ্যের হৃদয়কে টানে আরো প্রবলভাবে। এই টান যে কোনো প্রেমিক-প্রেমিকার কাছেই আকর্ষণীয় হওয়ারই কথা। কে উপেক্ষা করতে পারে সোনালি কাবিনের এই ভাষা:

সোনার দিনার নেই, দেনেমাহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি,
(সোনালি কাবিন-১)

তার ভাষার গভীরতা ছিল মাটি মাতৃকা কেন্দ্রিক। ফুটে ওঠে চিরায়ত জীবনের রূপ। বংশধারা আকাক্সক্ষার তীব্রতা, যা কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার নয়। বধূবরণের ক্ষেত্রে যে কবুল একান্ত জরুরি তা কি ভাবে উপেক্ষিত হতে পারে নারীকুলের সম্মানার্থে কবিতায়:

বধূবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকুল
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্য কবুল, কবুল।
(সোনালি কাবিন-১৩)

আবার বলা হয় বৃষ্টির দোহাই দিয়ে, তিলবর্ণ ধানের দোহাই দিয়ে, দুগ্ধবতী হালাল পশুর দোহাই দিয়ে:

বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই
দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর,
লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই
হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে না কসুর।
(সোনালি কাবিন-১৪)

সামগ্রিক অর্থে কবি আল মাহমুদের একটা পর্যায় হলো সোনালি কাবিন কবিতাটি। তবে সোনালি কাবিন ছাড়া আল মাহমুদ অপূর্ণ। সোনালি কাবিন সৃষ্টির পর থেকে অপূর্ণ। কবিতাটি আল মাহমুদকে কাব্য অধিপতির যে আসনে উচ্চতিক করেছে সেখান থেকে তাকে আর নামানো সম্ভব নয়। সনেটগুচ্ছ আল মাহমুদকে শক্তিশালী করেছে। কবি হিসেবে খ্যাতির জন্য এরকম একটি কবিতাই অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট। কিন্তু তারপরও বলতে হয় আল মাহমুদের অন্যান্য অনেক কবিতা আছে যেগুলো যে কোনো কবির জন্যই শ্রেষ্ঠত্ব বয়ে আনে।

কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি রাবেয়া রাবেয়া
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!
........................................
কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।
(কবিতা এমন: সোনালি কাবিন)

কিংবা যখন বল হয়,

দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে। বৈঠকখানা থেকে আব্বা
একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন,
ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান.......।
(প্রত্যাবর্তনের লজ্জা: সোনালি কাবিন)

সোনালি কাবিন আল মাহমুদকে প্রেম ও প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে গেছে। কবিতা হিসেবে মানে উত্তীর্ণ বলেও হয়তো এর প্রতি পাঠকের আকর্ষণ ও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে খুব স্বাভাবিক অর্থেই। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নানাভাবে নানা আঙ্গিকে দেয়া যায়। মার্কসবাদের আকর্ষণও কম অনুভূত হয়নি অনেকের কাছে। তবে কারো কারো কাছে উপেক্ষিত ছিল কি না ‘কাবিন’ বা ‘দেনমোহর’ এর মধ্যে গন্ধমিশ্রিত শব্দগুচ্ছ। তবুও তো সময়ের নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে সোনালি কাবিনের স্বতন্ত্র কাব্যমর্যাদা সকল শ্রেণিকরণের ও বিভক্তির পরও আজো টিকে আছে সকলের কাছে।

তবে এক পক্ষের সুবিধা হয়েছে তারা সোনালি কাবিনের সনেটের মোড়কে আল মাহমুদকে বন্দি করে রাখতে চায়। অন্যপক্ষ খোলস ছাড়িয়ে বের করে আনতে। কিন্তু খোলসের ভিতর বাহির নিয়েই তো আল মাহমুদের সোনালি কাবিন।

২.
‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় প্রগতি প্রকাশন থেকে আশ্বিন ১৩৮০ সালে; ইংরেজির ১৯৭৩ সালে। দাম রাখা হয়েছিল সাড়ে পাঁচ টাকা। প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন যৌথভাবে ড. নওয়াজেস আহমদ ও কালাম মাহমুদ। উৎসর্গ করা হয়েছিল সমকালীন কাব্যহিংসার তিন কবি শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন ও শহীদ কাদরীকে এবং তাদের উদ্দেশ্যে লেখা ছিল, ‘‘আমাদের এক কালের সখ্য ও সাম্প্রতিক কাব্য হিংসা অমর হোক’’। পরবর্তীতে অবশ্য অন্য আরো প্রকশনী থেকে বিভিন্ন সংস্করণ বেরিয়েছে।

সন তারিখের হিসেবে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সোনালি কাবিন তার ৪০ বছর পূর্তি করে। আশ্বিন ১৩৮০ সালে প্রকাশ কাল হলে বাংলা সনের ‘আশ্বিন’ ইংরেজির ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত। সেই হিসেবে ২০১৩ সালের ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থের ৪০ বছর পূর্তি হয়েছে। এই দীর্ঘ ৪০ বছরে সোনালি কাবিন নানাভাবে পঠিত হয়েছে। এর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। ভবিষ্যতেও এর কাব্যপ্রিয়তা অমর হয়ে থাকবে বলে আশা করা যায়।

১৯৬৭-৬৮ সাল ছিল আল মাহমুদের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য বছর। এই সময়টা তাকে নানা কারণে বিক্ষুদ্ধ করে আবার অমর কাব্য সৃষ্টির জন্য উদ্বুদ্ধও করে। এই সময়টা কবির জীবনে নানা কারণে ঘটনা বহুল মনে হয় আমাদের কাছে। তার বিখ্যাত অনেক কবিতাই রচিত হয়েছে এই সময়গুলোতে। সোনালি কাবিনের ১৪টি সনেট ৬৮ সালেই লেখা। সনেটগুচ্ছ ছাড়া এই গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই রচিত হয়েছে ৬৭ সালে।

৩.
বলা দারকার, আল মাহমুদ আল মাহমুদই। তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। কাব্যিক বাছ-বিচারকে স্বতন্ত্র রেখেই বলা যায় একটি জনপ্রিয়, পাঠকপ্রিয় সোনালি কাবিন প্রকাশের আগেই তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৬৮ সালে। এর আগে তার ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৬৩ ও ১৯৬৬ সালে। সোনালি কাবিন মিনিবুক হিসেবে পাঠকের হাতে আসে ১৯৭১ সালে। কলকাতা থেকে সন্দ্বীপন চৌধুরীর প্রকাশনায় সপ্তম মিনিবুক হিসেবে প্রকাশ পায়। দাম ছিল দুই টাকা। এর আগে সোনালি কাবিনের সাতটি সনেট ‘সমকাল’ পত্রিকায় ছাড়া হয়। এর অনেক পরে ১৯৭৩ সালে পুরো কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।

কাব্যের কোনো ব্যাখ্যা হয় না - আল মাহমুদ একথা মাঝে মধ্যেই বলে থাকেন। তারপরও মানুষ ব্যাখ্যা করে। নানা ভাবেই ব্যাখ্যা করে। নানা আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করে। নিজের মতো করেই করে। ভালো লাগা, মন্দ লাগা প্রকাশ করে। সে বিবেচনায় সোনালি কাবিন অবশ্যই একটি আলোচিত গ্রন্থ। সোনালি কাবিন আল মাহমুদের একটি বিখ্যাত ও শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। সোনানি কাবিন বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

আল মাহমুদ চেয়েছিলেন সনেটের মাধ্যমে প্রেমের কবিতা লিখতে। তার নিজেরও বিশ্বাস ছিল এটি তাকে বাংলা সাহিত্যে অমরতা দেবে। সোনালি কাবিন প্রেমের কবিতা হিসেবে খ্যাত। সেই প্রেমকে তিনি সাজিয়েছেন নানা ভাবে নানা মোড়কে। করেছেন কাব্যটিকে কালোত্তীর্ণ।

Comments