প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বরেকর্ড

এক : জাতিসঙ্ঘের ৭০তম অধিবেশনে যোগ দিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখন নিউ ইয়র্কে। এ নিয়ে মোট ১০ বার জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়লেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বের উন্নয়নশীল বা উন্নত কোনো দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান তার মতো এতবার জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে যোগদান করার রেকর্ড অর্জন করেননি। শুধু জাতিসঙ্ঘে যোগদানই নয়, সর্বাধিক দুই শতাধিক সফরসঙ্গী নিয়ে জাতিসঙ্ঘে গিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসেও সৃষ্টি করেছেন আরেক নতুন রেকর্ড। এ ছাড়া ১৯৩ সদস্যের সাধারণ পরিষদের কোনো দেশেরই রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের প্রতি বছর সাধারণ পরিষদে যোগদানেরও কোনো নজির নেই। এ ক্ষেত্রেও যোগ হবে আরেকটি রেকর্ড।
দুই : জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের অংশগ্রহণে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ২০০৪ থেকে ২০১৪ দুই মেয়াদে মাত্র তিনটি অধিবেশনে যোগ দেন। বাকি সাতটি অধিবেশনে অংশ নেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এবং এস এম কৃষ্ণা। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ আমাদের প্রতিবেশী দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব, এমনকি জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধিরা সাধারণ পরিষদে সেসব দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। বিএনপির সময়ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোর্শেদ খান ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমান সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদকালে ১৯৯৮ ও ২০০০ সালে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুুস সামাদ আজাদ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা পাওয়ার পর সেই থেকে সাংবার্ষিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে একাধিক্রমে পাঁচবারসহ টানা সাতবার সাধারণ পরিষদে প্রতিনিধিত্বসহ কোনো দেশের সরকারপ্রধান হিসেবে সর্বাধিক ১০ বার যোগদান করে বিশ্বরেকর্ড করলেন।
তিন : বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের ১৩৬তম সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এর এক সপ্তাহ পর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাধারণ পরিষদের দীর্ঘ ৭০ বছরের ইতিহাসে ১৯৮৬ সালে ৪১তম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। এ ছাড়া প্রতি বছরই নিছক একধরনের আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা করা ছাড়া জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আমাদের অংশগ্রহণ বড় কোনো ধরনের জাতীয় সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়নি।
চার : আধুনিক সিঙ্গাপুরের অবিসংবাদী নেতা লি কুয়ান ইউ তার আত্মজীবনীমূলক এক গ্রন্থ লিখেছেন। বইটির নাম হচ্ছে, ‘ফ্রম থার্ড ওয়ার্ল্ড টু ফার্স্ট; দ্য সিঙ্গাপুর স্টোরি : ১৯৬৫-২০০০’। লি কুয়ান তার আত্মজীবনী গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে ৩৬৩-৩৬৪ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কাছ থেকে দেখার একটি স্মৃতির কথা বলেছেন এভাবে- 
‘অটোয়া সম্মেলনের সময় আরেকজন মানুষকে দেখার কথা স্মরণ করতে পারি, প্রাইম মিনিস্টার শেখ মুজিবুর রহমান।... পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশে রূপান্তরের নেতা। তিনি নিজস্ব বিমানে চড়ে বেশ ভাব নিয়ে অটোয়ায় এসে পৌঁছান। একটি পাবলিক বিমানে করে আমি যখন ওখানে ল্যান্ড করলাম, গায়ে ‘বাংলাদেশ’ খচিত একটি বোয়িং ৭০৭ থামানো দেখলাম। সম্মেলন শেষে যখন অটোয়া ছেড়ে যাচ্ছিলাম, বিমানটি তখনো ওখানে ঠায় দাঁড়িয়েছিল। আট দিন ধরে এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বিমান! কোনো উপার্জন ছাড়া অনর্থক ও বেকার পড়ে থাকা। ফেরার সময় যখন এয়ারপোর্টের উদ্দেশে হোটেল ছেড়ে বের হচ্ছিলাম বাংলাদেশী বিমানটার জন্য জিনিসপত্র দিয়ে দুইটা বিশাল ভ্যান বোঝাই করা হচ্ছিল। অথচ সম্মেলনে মুজিবুর রহমান তার দেশের জন্য শুধু সাহায্য আর অনুদান চেয়েই কথা বলছিলেন।’
পাঁচ : একসময় রাজা-বাদশাহরা শখ করে হাতির দল পুষতেন। প্রজাদের খাজনার টাকায় পোষা হাতিরা রাজাদের মনোরঞ্জনের নানারকম খেলাও দেখাতো। এখন আর রাজা-বাদশাহরা হাতির দল পোষেণ না। এখন গরিব দেশের সরকারপ্রধানরা বিদেশ সফরে নিয়ে যান শত শত সফরসঙ্গীর বহর। হাততালি আর বাহবা পাওয়ার জন্য বিদেশ ভ্রমণের এসব সফরসঙ্গী জনগণের কষ্টের টাকায় শ্রাদ্ধ করা বৈ দেশের কোনো উপকারে আসেনি আজ পর্যন্ত কোনো সরকারের আমলেই। সাত তারকা হোটেলে বিলাসবহুল অবকাশ, লাগেজ ভর্তি ব্র্যান্ডেট শপিং আর প্রধানমন্ত্রীর সাথে সেলফি তোলার সুযোগ হাতছাড়া না করলেও বিদেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো প্রকার সুযোগ আজ পর্যন্ত এসব সফরসঙ্গী সৃষ্টি করতে পারেনি। এবার ২২১ জনের বিশাল বহর নিয়ে নিউ ইয়র্কে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। গতবার অবশ্য এ সংখ্যা ছিল ১৮০। এবার গড়লেন একাধিক বিশ্বরেকর্ড। গরিব দেশের মানুষের টাকার মচ্ছব হলে তাতে কার কি বা আসে যায়! 
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ 
e-mail: drtuhinmalik@hotmail.com

Comments