মামলা যদি করতেই হয়, ১৬ কোটি মানুষের নামেই মামলা করো।
বাংলার মাটিতে জরায়ুও আজ নিরাপদ নয়। বাঙালির আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে যোগ হলো এক নতুন দৃষ্টান্ত। জন্মের মাস খানেক আগেই মায়ের পেটে বুলেটবিদ্ধ হলো বেবি অব নাজমা বেগম। এ নামটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তারদের দেওয়া। ছাত্রলীগের গোলাগুলির শিকার বলে তাকে বুলেট বেগম নামেও ডাকা যেতে পারে।
মাগুরার কোথাকার কোন নাজমা বেগমের গর্ভের সন্তান গুলিবিদ্ধ হলো, কে তা নিয়ে মাথা ঘামাত। নাজমা বেগম ও তাঁর সন্তানের পাশে মিডিয়া ও ডাক্তাররা না দাঁড়ালে মা ও মেয়ে মারা গেলেই বা কার কী আসত-যেত। কত তরতাজা মানুষই তো প্রতিদিন প্রহরে প্রহরে মারা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে গত এক দশকে যত কথিত ক্রসফায়ার হয়েছে, তাদের মধ্যে যথার্থ ও নিখাদ ক্রসফায়ারের শিকার বেবি অব নাজমা বেগম। অন্য ক্রসফায়ারগুলো নিয়ে মানুষের যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থাকলেও বুলেট বেগমের ঘটনাটিতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। ঘটনাটিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করলে তা হবে গুরুতর অন্যায়। গোলাগুলি ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে হয়েছে না তিন পক্ষের মধ্যে হয়েছে, তা কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। বাস্তবতা হলো, সন্ত্রাস প্রতিটি জনপদে পাড়ায়–মহল্লায় বিস্তৃত হয়েছে। এক মাননীয় মন্ত্রী প্রতিদিন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় জঙ্গিবাদ জঙ্গিবাদ করেন। মাগুরা শহরের দোয়ারপাড়ের আধিপত্য বিস্তারের প্রয়োজনে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে যে যুদ্ধ, তার চেয়ে বড় জঙ্গিবাদ আর কাকে বলে। বুলেট বেগমের এক আত্মীয়া শিউলি বেগম বুধবার এটিএন নিউজের প্রতিবেদককে বললেন, যখন দুই পক্ষের মধ্যে প্রবল গোলাগুলি বিনিময় হচ্ছে, তখন মনে হলো ‘দুনিয়াতে কেয়ামতই শুরু হয়্যা গেছে।’
কেয়ামতের দিন আকাশ খান খান হয়ে ভেঙে পড়বে, মাটি চৌচির হয়ে যাবে, কিন্তু গোলাগুলি হবে না। দেশের অবুঝ জনগণকে বুঝ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে অনেক কিছু করতে হয়। দোয়ারপাড়ে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদের ১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে না ১৭ জনকে আসামি করা হয়েছে, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাদের দুজন গ্রেপ্তার হয়েছে না একজন আটক হয়েছে, তা বিবেচ্য বিষয় নয়। তাদের কিঞ্চিৎ সাজা হলো কি না হলো, তা কোনো ব্যাপার নয়। আসল ব্যাপার হলো, নাজমা বেগম বাংলা মায়ের প্রতীক। বাংলা মা আজ বুলেটবিদ্ধ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমি বেবি অব নাজমা বেগমকে দেখেছি হাত নাড়তে। এক চোখ পিট পিট করে কিছু বলার চেষ্টা করছে। যদি সে মিনিট দুই কথা বলতে পারত, তা হলে বলত, তোমরা যাদের নামে নামকাওয়াস্তে মামলা করেছ, আমি তাদের কাউকে চিনি না। তাদের সাজাটাজা কিছুই হবে না। তাদের আসামি করার প্রয়োজন নাই। তোমাদের পুলিশ তো বিরোধী দলের আন্দোলনের সময় হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা আসামির নামে মামলা করে। আমার আততায়ী যেহেতু আমারও অজ্ঞাত, আমি অনুরোধ করব, মামলা যদি করতেই হয়, ১৬ কোটি মানুষের নামেই মামলা করো। তোমরা ১৬ কোটি মানুষই আসামি।
ডাক্তাররা মাধ্যমতো চেষ্টা করছেন ওকে বাঁচিয়ে তুলতে। বেকায়দায় পড়ে জন্মের যথাসময়ের এক মাস আগে ওকে পৃথিবীতে আসতে হয়েছে। ওর ক্ষুদ্র শরীরে চারটি ক্ষতস্থানে ২১টি সেলাই পড়েছে নাকি ২০ বা ২২টি সেলাই দেওয়া হয়েছে, তা কোনো ব্যাপার নয়। জন্মের আগেই তাকে আমরা জখম করেছি। ডাক্তারদের পুরো টিম কাজ করছে। কথা হলো শিশু বিভাগের অধ্যাপক মো. আবিদ হোসেন মোল্লা, শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আশফাক উল হক, নিওনেটাল ও পেডিয়াট্রিক সার্জন অধ্যাপক আবদুল হানিফ, মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক মো. ইসমাইল খান, সার্জন কানিজ হাসিনা প্রমুখ চিকিৎসকের সঙ্গে। এখনো বাচ্চাটি আশঙ্কামুক্ত নয় বলে তাঁরা জানালেন। বাচ্চাটির প্রয়োজন ছিল মায়ের দুধ। মা থেকে ও বিচ্ছিন্ন, ওকে আমরা দিয়েছি টিনের দুধ।
বুলেটবাজদের সামনে ঠেলে দিয়ে নাটের গুরুরা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছেন। প্রশাসনের লোকেরা রুটিন কাজ করছেন। পুলিশ প্রমোশন, বদলি ইত্যাদির কথা বিবেচনা করে যতটুকু না করলে নয় তাই করছেন ‘সর্বোচ্চ’ দক্ষতা প্রদর্শন করে। বড়ই শ্রুতিমধুর শব্দ জনপ্রতিনিধি। এই পৈশাচিক ঘটনার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। মাননীয় এমপির কী ভূমিকা, উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের ভূমিকা কী? রাজনৈতিক দলের নেতাদের ভূমিকা কী? কোনো অপদেবতা অদৃশ্য স্থান থেকে বাংলার বুকে বুলেট ছুড়বে আর সবাই আমরা বসে বসে তা উপভোগ করব, এই কি ১৬ কোটি মানুষের নিয়তি।
বুলেট বেগম সুস্থ হয়ে মায়ের কোলে ফিরে যাক, এই কামনা করি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
মাগুরার কোথাকার কোন নাজমা বেগমের গর্ভের সন্তান গুলিবিদ্ধ হলো, কে তা নিয়ে মাথা ঘামাত। নাজমা বেগম ও তাঁর সন্তানের পাশে মিডিয়া ও ডাক্তাররা না দাঁড়ালে মা ও মেয়ে মারা গেলেই বা কার কী আসত-যেত। কত তরতাজা মানুষই তো প্রতিদিন প্রহরে প্রহরে মারা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে গত এক দশকে যত কথিত ক্রসফায়ার হয়েছে, তাদের মধ্যে যথার্থ ও নিখাদ ক্রসফায়ারের শিকার বেবি অব নাজমা বেগম। অন্য ক্রসফায়ারগুলো নিয়ে মানুষের যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থাকলেও বুলেট বেগমের ঘটনাটিতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। ঘটনাটিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করলে তা হবে গুরুতর অন্যায়। গোলাগুলি ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে হয়েছে না তিন পক্ষের মধ্যে হয়েছে, তা কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। বাস্তবতা হলো, সন্ত্রাস প্রতিটি জনপদে পাড়ায়–মহল্লায় বিস্তৃত হয়েছে। এক মাননীয় মন্ত্রী প্রতিদিন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় জঙ্গিবাদ জঙ্গিবাদ করেন। মাগুরা শহরের দোয়ারপাড়ের আধিপত্য বিস্তারের প্রয়োজনে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে যে যুদ্ধ, তার চেয়ে বড় জঙ্গিবাদ আর কাকে বলে। বুলেট বেগমের এক আত্মীয়া শিউলি বেগম বুধবার এটিএন নিউজের প্রতিবেদককে বললেন, যখন দুই পক্ষের মধ্যে প্রবল গোলাগুলি বিনিময় হচ্ছে, তখন মনে হলো ‘দুনিয়াতে কেয়ামতই শুরু হয়্যা গেছে।’
কেয়ামতের দিন আকাশ খান খান হয়ে ভেঙে পড়বে, মাটি চৌচির হয়ে যাবে, কিন্তু গোলাগুলি হবে না। দেশের অবুঝ জনগণকে বুঝ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে অনেক কিছু করতে হয়। দোয়ারপাড়ে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদের ১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে না ১৭ জনকে আসামি করা হয়েছে, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাদের দুজন গ্রেপ্তার হয়েছে না একজন আটক হয়েছে, তা বিবেচ্য বিষয় নয়। তাদের কিঞ্চিৎ সাজা হলো কি না হলো, তা কোনো ব্যাপার নয়। আসল ব্যাপার হলো, নাজমা বেগম বাংলা মায়ের প্রতীক। বাংলা মা আজ বুলেটবিদ্ধ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমি বেবি অব নাজমা বেগমকে দেখেছি হাত নাড়তে। এক চোখ পিট পিট করে কিছু বলার চেষ্টা করছে। যদি সে মিনিট দুই কথা বলতে পারত, তা হলে বলত, তোমরা যাদের নামে নামকাওয়াস্তে মামলা করেছ, আমি তাদের কাউকে চিনি না। তাদের সাজাটাজা কিছুই হবে না। তাদের আসামি করার প্রয়োজন নাই। তোমাদের পুলিশ তো বিরোধী দলের আন্দোলনের সময় হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা আসামির নামে মামলা করে। আমার আততায়ী যেহেতু আমারও অজ্ঞাত, আমি অনুরোধ করব, মামলা যদি করতেই হয়, ১৬ কোটি মানুষের নামেই মামলা করো। তোমরা ১৬ কোটি মানুষই আসামি।
ডাক্তাররা মাধ্যমতো চেষ্টা করছেন ওকে বাঁচিয়ে তুলতে। বেকায়দায় পড়ে জন্মের যথাসময়ের এক মাস আগে ওকে পৃথিবীতে আসতে হয়েছে। ওর ক্ষুদ্র শরীরে চারটি ক্ষতস্থানে ২১টি সেলাই পড়েছে নাকি ২০ বা ২২টি সেলাই দেওয়া হয়েছে, তা কোনো ব্যাপার নয়। জন্মের আগেই তাকে আমরা জখম করেছি। ডাক্তারদের পুরো টিম কাজ করছে। কথা হলো শিশু বিভাগের অধ্যাপক মো. আবিদ হোসেন মোল্লা, শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আশফাক উল হক, নিওনেটাল ও পেডিয়াট্রিক সার্জন অধ্যাপক আবদুল হানিফ, মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক মো. ইসমাইল খান, সার্জন কানিজ হাসিনা প্রমুখ চিকিৎসকের সঙ্গে। এখনো বাচ্চাটি আশঙ্কামুক্ত নয় বলে তাঁরা জানালেন। বাচ্চাটির প্রয়োজন ছিল মায়ের দুধ। মা থেকে ও বিচ্ছিন্ন, ওকে আমরা দিয়েছি টিনের দুধ।
বুলেটবাজদের সামনে ঠেলে দিয়ে নাটের গুরুরা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছেন। প্রশাসনের লোকেরা রুটিন কাজ করছেন। পুলিশ প্রমোশন, বদলি ইত্যাদির কথা বিবেচনা করে যতটুকু না করলে নয় তাই করছেন ‘সর্বোচ্চ’ দক্ষতা প্রদর্শন করে। বড়ই শ্রুতিমধুর শব্দ জনপ্রতিনিধি। এই পৈশাচিক ঘটনার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। মাননীয় এমপির কী ভূমিকা, উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের ভূমিকা কী? রাজনৈতিক দলের নেতাদের ভূমিকা কী? কোনো অপদেবতা অদৃশ্য স্থান থেকে বাংলার বুকে বুলেট ছুড়বে আর সবাই আমরা বসে বসে তা উপভোগ করব, এই কি ১৬ কোটি মানুষের নিয়তি।
বুলেট বেগম সুস্থ হয়ে মায়ের কোলে ফিরে যাক, এই কামনা করি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
Comments
Post a Comment