রাজনের মৃত্যুর মতো; আশঙ্কা হয়, বহু মৃত্যু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সলিলসমাধি তো শুরু হয়েই গেছে, গৃহযুদ্ধ ছাড়াই।
ভাবি না যে কিছু হবে। তবে আশা করতে, স্বপ্ন দেখতে বাধা কোথায়? দেশটা ভালো হবে অর্থাৎ দেশ পরিচালনায় সব না হলে অনেক নিয়মনীতি মেনে চলা হবে, নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং সর্বোপরি ভালো কিছু করার তাড়না থাকবে। দেশ পরিচালনায় জবাবদিহি থাকবে—সাদা-কালো, ভালো-মন্দ ইত্যাদির মধ্যে ফারাক-তফাত থাকবে। আজকাল দৃষ্টির সমস্যা থাকলেও বেশ কিছু নতুন নতুন সমাধানও বেরিয়েছে। যেমন কম্পিউটার আইপ্যাড আপনাকে পড়ে শোনাবে, নিজে নিজে পড়তে হয় না।
ছোটবেলা পড়েছিলাম, হঠাৎ মনে পড়ল বহু বছর পর। আইপ্যাডকে পড়তে বললাম। মতেঁস্কুর ফার্সী চিঠি। দুই ফারসি/উজবেক যুবক তাদের পরিবার-পরিজন ফেলে ফ্রান্সে আসে এবং প্রায় ১০ বছর ধরে (১৭১১ থেকে ১৭২০) ইউরোপের রাষ্ট্র পরিচালনা, রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন, বিচার ইত্যাদি নিয়ে ইরানে তাদের বন্ধুদের কাছে দেড় শর কিছু বেশি চিঠি লেখে। কাল্পনিক চিঠিগুলোর সংকলন ফার্সী চিঠি নামের বইয়ে সংকলিত। আধুনিক (অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে) পশ্চিমা সভ্যতায় রাষ্ট্র, রাষ্ট্রচিন্তা ‘সেপারেশন অব পাওয়ারস’ আইন-বিচার ইত্যাদি ব্যাপারে শিক্ষিতজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পঠিত লেখক/দার্শনিক সম্ভবত মতেঁস্কু। বিংশ শতাব্দীতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সোভিয়েতদের প্রভাব-বলয়ের কারণে বিশ্বের সব আনাচকানাচে হেগেল-মার্ক্স ভীষণভাবে পঠিত হয়েছিলেন এবং বিংশ শতাব্দীর বহু দশক মতেঁস্কুর কদর কার্ল মার্ক্স থেকে কম ছিল। কিন্তু অধুনা এককালের ‘বাকশাল’-এর মতো মার্ক্স এখন পরিত্যক্ত।
আমাদের এককালের বাকশাল, ইরাকের বাথ পার্টি, সিরিয়ার বাবা আসাদ (এখন ছেলে বাশার প্রেসিডেন্ট), লিবিয়ার গাদ্দাফি, মিসরের একদলীয় প্রেসিডেন্টরা, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণসহ অনেক নেতা—দেশ মার্ক্সের বিকটসম ব্যাখ্যার কল্যাণে বিভিন্ন জাতে সামঞ্জস্যতান্ত্রিক—একদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। অনেক দেশে ওই গোছের গণতন্ত্র চলেছিল ২০-৩০-৪০ বছর। বলা বাহুল্য, পশ্চিমা-বুর্জুয়া-বহুদলীয় গণতান্ত্রিকদের চরম দুশমন ছিলেন ওই সব একদলীয় সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রপন্থী দেশ ও নেতারা। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ বিতাড়িত হলেন সেনাবাহিনী দ্বারা। চিলির সমাজতান্ত্রিক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে শুধু বিতাড়িতও হলো না, দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান সালভাদর আয়েন্দে সদলবলে নিহত হলেন সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে—ঠিকই ধরেছেন, আমেরিকা-সমর্থিত সেনাবাহিনীর হাতে। আমাদের ১৫ আগস্ট ১৯৭৫।
ইরান চালিয়ে যাচ্ছে ওদের একদলীয় গণতন্ত্র। হটানো যাচ্ছে না। ইরাক-সিরিয়ার একদলীয় বাথ পার্টিকে ধ্বংস করতে গিয়ে—যেভাবে যে কারণেই হোক না কেন—ইতিমধ্যে নিহত হয়েছে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। লিবিয়ার সরকার বলতে কিছু নেই।
৩০০ বছর আগের মতেঁস্কুর কেচ্ছা বলতে বলতে অনেক দূরে সরে গেছি। বলা বাহুল্য মতেঁস্কু ফ্রেঞ্চ ভাষায় লিখেছিলেন। অধমের দৌড় তার ইংরেজি অনুবাদ পর্যন্ত। পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞান আইনে নেতাদের বারবার ভার্চুয়াস কাজ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ওদের রাষ্ট্রচিন্তা নেতাদের জন্য ভার্চু একটা বড় স্থান দখল করে আছে। ‘ভার্চু’কে বাংলায় ‘সদ্গুণ’ বলা যায়, কিন্তু ‘ভার্চুয়াস অ্যাক্ট’-এর জুতসই বাংলা খুঁজে পাচ্ছি না। মোস্তাফা নূরউল ইসলাম বা আনিসুজ্জামান স্যারদের তো সামান্য একটা ইংরেজি শব্দের বাংলা কী হবে, সে জন্য বিরক্ত করা যায় না। ইংরেজি-বাংলা অভিধানে আছে ‘উৎকৃষ্ট’। জুতসই হচ্ছে না।
ইরান থেকে ফ্রান্সে ভ্রমণ করতে আসা ওই দুই ইরানি যুবা দেশে তাদের বন্ধুবান্ধবদের লেখা চিঠিগুলোর বেশ কয়েকটিতে লিখেছিল—জানো, জানো, এ দেশের (অর্থাৎ ফ্রান্সের) অনেক নেতাই ‘ভার্চুয়াস’ না, তারা ‘ভার্চু’র ধার ধারে না। তারা মেতে আছে নিজের ঘাট নিয়ে, পথ নিয়ে, ক্ষমতা নিয়ে, ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। সমাজে প্রত্যেকেই যেকোনো মূল্যেই হোক নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। ফলে পুরো সমাজে অনাচার-অবিচারই প্রধান। একজন অন্যজনের স্ত্রীকে ধর্ষণ করছে, অপহরণ-নির্যাতন হচ্ছে আর সর্বোপরি সমাজপতি বিচার করে না, কেউ বিচার পায় না।
বলা বাহুল্য মতেঁস্কুর বইটা প্রথমবার ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছিল। হাজার হলেও প্রায় ৩০০ বছর আগের কথা। তখন সংবিধান, বাক্স্বাধীনতা ইত্যাদি শব্দগুলোও কোনো অভিধানে ছিল না। ফার্সী চিঠির প্রায় সিকি শতাব্দী পরে মতেঁস্কুর সবচেয়ে বিখ্যাত বই দ্য স্পিরিট অব দ্য ল’স। ফরাসি বিপ্লব আর যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ওই বইটির প্রায় ৫০ বছরের পরের ঘটনা। আজতক যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় দেশে রাষ্ট্রচিন্তা, রাষ্ট্র-পরিচালনায় সিরিয়াস কোনো কথাবার্তা মতেঁস্কুর চিন্তাকে বাদ দিয়ে হয় না। ভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কারণে যুক্তরাজ্যে মতেঁস্কুর প্রভাব কিছুটা কম। ফরাসিদের কাছ থেকে ‘বুদ্ধি-বিদ্যা’ ধার করেছে—এটা ইংরেজরা কখনো সহজে স্বীকার করতে চায় না। ‘ভার্চুয়াস অ্যাক্ট’-এ ফিরে আসি। আর সেই সঙ্গে এ লেখার শিরোনাম কিছুতেই তো কিছু হয় না।
চৌধুরী মায়া সাহেবের দুর্নীতি, আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত, দীর্ঘমেয়াদি কারাদেশ—এটা দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক সেটা বহাল রাখা হলো—আপিলে না-ওল্টানো পর্যন্ত সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী। অথচ বহাল তবিয়তে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের শুধু মিনিস্টারই না, ঢাকা মহানগরের দলীয় নেতাও বটে।
পচা গম নিয়ে সপ্তাহ তিনেক ধরে সব ধরনের গণমাধ্যমে ধিক্কার, ছি ছি। আজ পুলিশ ওই গম খাবে না, সরকারি সাংসদ তাঁর এলাকার গুদামে গম ঢুকতে দেবেন না, হাইকোর্টে রিট, এই পরীক্ষা, সেই পরীক্ষা। মাননীয় মন্ত্রীর মহান চেয়ারে (‘পদ’ বললে বোধ হয় ‘পদ’ শব্দটার মানহানি হবে) তাঁর অবস্থানের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না।
আরেকজন ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণ নিশ্চিত করার মন্ত্রী, দীর্ঘ বছর ছয়েক ধরে। গত কয়েক মাস ইউরোপজুড়ে হুলুস্থুল হচ্ছে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে উত্তর আফ্রিকা থেকে আসা শরণার্থীদের নিয়ে। লিবিয়ায় এখন সরকার বলতে কিছু নেই বললেই চলে। বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর হানাহানিতে অকাতরে মারা যাচ্ছে নাগরিকেরা। জান বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে তিন বছরের বেশি সময় ধরে। মারা গেছে আড়াই লক্ষাধিক লোক। কমবেশি ২০ লাখ লোক আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে, তারা উদ্বাস্তু। সুদানেও কমবেশি একই অবস্থা। আছে আল-শাবাব গোষ্ঠী। নাইজেরিয়ার বোকো হারাম।
অর্থাৎ এসব দেশের লোকেরা ভাবছে, দেশে থাকলে হানাহানিতে নির্ঘাত মারা যাবে। তার চেয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করলেও মারা যাওয়ার আশঙ্কা প্রচুর। তবে সমুদ্রযাত্রায় সলিলসমাধি নাও হতে পারে, বেঁচেও তো যেতে পারি। রোহিঙ্গাদেরও অবস্থা প্রায় তদ্রুপ। তারা গুলি-কামানে বেঘোরে মারা না পড়লেও তিলে তিলে অত্যাচারে, অনাচারে, না-খেয়ে, কাজকর্ম না পেয়ে মরছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়ও প্রাণ হারাচ্ছে। তাই লিবিয়া, উত্তর নাইজেরিয়া, সিরিয়া, ইরাক, সুদান, সোমালিয়ায় একেবারে উপায়বিহীন মানুষগুলোর মতো রোহিঙ্গারাও বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে অজানার বিপৎসংকুল সমুদ্রযাত্রা।
তার সঙ্গে প্রবাসে গিয়ে কল্যাণ পেতে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশিরাও। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার গণকবরে স্থান মিলেছে শত শত বাংলাদেশির। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাগরগুলোতে সলিলসমাধি হয়েছে আরও শত শত স্বদেশির। আর বিশ্ব গণমাধ্যমে এখন সিরিয়া-লিবিয়া-রোহিঙ্গা-বাংলাদেশ—সব একই কাতারের, বসবাসের অযোগ্য দেশ।
প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর কল্যাণে বছর তিনেক ধরে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ। ফলে মানব পাচারকারীদের জন্য উন্মোচিত হয়েছে পাচারের অপরাধমূলক দুয়ার। আর কক্সবাজারসহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নৌ ও সীমান্ত কর্তৃপক্ষ এদের প্রত্যক্ষ–পরোক্ষ সহায়তা ছাড়া হাজার হাজার লোক কোনোভাবেই এভাবে সমুদ্রযাত্রা করতে পারে না। এখন দু-চারটা জেলার দু-চার-দশজন ‘মানব পাচারকারী’কে আটক করে অসংখ্য মৃত্যুর দায়িত্ব রাষ্ট্র এড়াবে।
আর ‘ভার্চুয়াস অ্যাক্ট’? কল্যাণকারী মন্ত্রী প্রমোশন পেয়েছেন, বিরাটভাবে। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতা—অর্থাৎ সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদককে দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি অরাজনৈতিক কাজের দায়িত্ব, অর্থাৎ জনপ্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার দায়িত্ব। এর ধারাবাহিকতায় অন্য প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা না আবার মৎস্য ও পশু প্রজনন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পান!
মোদ্দাকথা, আমাদের রাজনীতিতে ‘ভার্চুয়াস অ্যাক্ট’ বলে কিছুই নেই। ভাসা-ভাসা মনে পড়ছে, অ্যারিস্টোটলও ‘ভার্চু’ আর ‘ভার্চুয়াস অ্যাক্ট’-এর কথা বলেছিলেন সুখী হওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে। সুখী হতে হলে ‘ভার্চুয়াস অ্যাক্ট’ করতে হবে। গ্রিসে সম্প্রতি একেবারে সাত দিনের নোটিশে গণভোট হয়ে গেল। আমাদের প্রতি দশকেও একবার যদি ভোটাভুটি হয়, তাহলেই আমরা হব ভাগ্যবান। আমাদের রাজনীতি থেকে ভার্চু আর ভার্চুয়াস অ্যাক্ট চলে গেছে। ফলাফল—রাজনের মৃত্যুর মতো; আশঙ্কা হয়, বহু মৃত্যু আমাদের জন্য
অপেক্ষা করছে। সলিলসমাধি তো শুরু হয়েই গেছে, গৃহযুদ্ধ ছাড়াই।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।
ছোটবেলা পড়েছিলাম, হঠাৎ মনে পড়ল বহু বছর পর। আইপ্যাডকে পড়তে বললাম। মতেঁস্কুর ফার্সী চিঠি। দুই ফারসি/উজবেক যুবক তাদের পরিবার-পরিজন ফেলে ফ্রান্সে আসে এবং প্রায় ১০ বছর ধরে (১৭১১ থেকে ১৭২০) ইউরোপের রাষ্ট্র পরিচালনা, রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন, বিচার ইত্যাদি নিয়ে ইরানে তাদের বন্ধুদের কাছে দেড় শর কিছু বেশি চিঠি লেখে। কাল্পনিক চিঠিগুলোর সংকলন ফার্সী চিঠি নামের বইয়ে সংকলিত। আধুনিক (অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে) পশ্চিমা সভ্যতায় রাষ্ট্র, রাষ্ট্রচিন্তা ‘সেপারেশন অব পাওয়ারস’ আইন-বিচার ইত্যাদি ব্যাপারে শিক্ষিতজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পঠিত লেখক/দার্শনিক সম্ভবত মতেঁস্কু। বিংশ শতাব্দীতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সোভিয়েতদের প্রভাব-বলয়ের কারণে বিশ্বের সব আনাচকানাচে হেগেল-মার্ক্স ভীষণভাবে পঠিত হয়েছিলেন এবং বিংশ শতাব্দীর বহু দশক মতেঁস্কুর কদর কার্ল মার্ক্স থেকে কম ছিল। কিন্তু অধুনা এককালের ‘বাকশাল’-এর মতো মার্ক্স এখন পরিত্যক্ত।
আমাদের এককালের বাকশাল, ইরাকের বাথ পার্টি, সিরিয়ার বাবা আসাদ (এখন ছেলে বাশার প্রেসিডেন্ট), লিবিয়ার গাদ্দাফি, মিসরের একদলীয় প্রেসিডেন্টরা, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণসহ অনেক নেতা—দেশ মার্ক্সের বিকটসম ব্যাখ্যার কল্যাণে বিভিন্ন জাতে সামঞ্জস্যতান্ত্রিক—একদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। অনেক দেশে ওই গোছের গণতন্ত্র চলেছিল ২০-৩০-৪০ বছর। বলা বাহুল্য, পশ্চিমা-বুর্জুয়া-বহুদলীয় গণতান্ত্রিকদের চরম দুশমন ছিলেন ওই সব একদলীয় সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রপন্থী দেশ ও নেতারা। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ বিতাড়িত হলেন সেনাবাহিনী দ্বারা। চিলির সমাজতান্ত্রিক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে শুধু বিতাড়িতও হলো না, দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান সালভাদর আয়েন্দে সদলবলে নিহত হলেন সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে—ঠিকই ধরেছেন, আমেরিকা-সমর্থিত সেনাবাহিনীর হাতে। আমাদের ১৫ আগস্ট ১৯৭৫।
ইরান চালিয়ে যাচ্ছে ওদের একদলীয় গণতন্ত্র। হটানো যাচ্ছে না। ইরাক-সিরিয়ার একদলীয় বাথ পার্টিকে ধ্বংস করতে গিয়ে—যেভাবে যে কারণেই হোক না কেন—ইতিমধ্যে নিহত হয়েছে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। লিবিয়ার সরকার বলতে কিছু নেই।
৩০০ বছর আগের মতেঁস্কুর কেচ্ছা বলতে বলতে অনেক দূরে সরে গেছি। বলা বাহুল্য মতেঁস্কু ফ্রেঞ্চ ভাষায় লিখেছিলেন। অধমের দৌড় তার ইংরেজি অনুবাদ পর্যন্ত। পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞান আইনে নেতাদের বারবার ভার্চুয়াস কাজ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ওদের রাষ্ট্রচিন্তা নেতাদের জন্য ভার্চু একটা বড় স্থান দখল করে আছে। ‘ভার্চু’কে বাংলায় ‘সদ্গুণ’ বলা যায়, কিন্তু ‘ভার্চুয়াস অ্যাক্ট’-এর জুতসই বাংলা খুঁজে পাচ্ছি না। মোস্তাফা নূরউল ইসলাম বা আনিসুজ্জামান স্যারদের তো সামান্য একটা ইংরেজি শব্দের বাংলা কী হবে, সে জন্য বিরক্ত করা যায় না। ইংরেজি-বাংলা অভিধানে আছে ‘উৎকৃষ্ট’। জুতসই হচ্ছে না।
ইরান থেকে ফ্রান্সে ভ্রমণ করতে আসা ওই দুই ইরানি যুবা দেশে তাদের বন্ধুবান্ধবদের লেখা চিঠিগুলোর বেশ কয়েকটিতে লিখেছিল—জানো, জানো, এ দেশের (অর্থাৎ ফ্রান্সের) অনেক নেতাই ‘ভার্চুয়াস’ না, তারা ‘ভার্চু’র ধার ধারে না। তারা মেতে আছে নিজের ঘাট নিয়ে, পথ নিয়ে, ক্ষমতা নিয়ে, ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। সমাজে প্রত্যেকেই যেকোনো মূল্যেই হোক নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। ফলে পুরো সমাজে অনাচার-অবিচারই প্রধান। একজন অন্যজনের স্ত্রীকে ধর্ষণ করছে, অপহরণ-নির্যাতন হচ্ছে আর সর্বোপরি সমাজপতি বিচার করে না, কেউ বিচার পায় না।
বলা বাহুল্য মতেঁস্কুর বইটা প্রথমবার ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছিল। হাজার হলেও প্রায় ৩০০ বছর আগের কথা। তখন সংবিধান, বাক্স্বাধীনতা ইত্যাদি শব্দগুলোও কোনো অভিধানে ছিল না। ফার্সী চিঠির প্রায় সিকি শতাব্দী পরে মতেঁস্কুর সবচেয়ে বিখ্যাত বই দ্য স্পিরিট অব দ্য ল’স। ফরাসি বিপ্লব আর যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ওই বইটির প্রায় ৫০ বছরের পরের ঘটনা। আজতক যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় দেশে রাষ্ট্রচিন্তা, রাষ্ট্র-পরিচালনায় সিরিয়াস কোনো কথাবার্তা মতেঁস্কুর চিন্তাকে বাদ দিয়ে হয় না। ভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কারণে যুক্তরাজ্যে মতেঁস্কুর প্রভাব কিছুটা কম। ফরাসিদের কাছ থেকে ‘বুদ্ধি-বিদ্যা’ ধার করেছে—এটা ইংরেজরা কখনো সহজে স্বীকার করতে চায় না। ‘ভার্চুয়াস অ্যাক্ট’-এ ফিরে আসি। আর সেই সঙ্গে এ লেখার শিরোনাম কিছুতেই তো কিছু হয় না।
চৌধুরী মায়া সাহেবের দুর্নীতি, আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত, দীর্ঘমেয়াদি কারাদেশ—এটা দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক সেটা বহাল রাখা হলো—আপিলে না-ওল্টানো পর্যন্ত সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী। অথচ বহাল তবিয়তে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের শুধু মিনিস্টারই না, ঢাকা মহানগরের দলীয় নেতাও বটে।
পচা গম নিয়ে সপ্তাহ তিনেক ধরে সব ধরনের গণমাধ্যমে ধিক্কার, ছি ছি। আজ পুলিশ ওই গম খাবে না, সরকারি সাংসদ তাঁর এলাকার গুদামে গম ঢুকতে দেবেন না, হাইকোর্টে রিট, এই পরীক্ষা, সেই পরীক্ষা। মাননীয় মন্ত্রীর মহান চেয়ারে (‘পদ’ বললে বোধ হয় ‘পদ’ শব্দটার মানহানি হবে) তাঁর অবস্থানের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না।
আরেকজন ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণ নিশ্চিত করার মন্ত্রী, দীর্ঘ বছর ছয়েক ধরে। গত কয়েক মাস ইউরোপজুড়ে হুলুস্থুল হচ্ছে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে উত্তর আফ্রিকা থেকে আসা শরণার্থীদের নিয়ে। লিবিয়ায় এখন সরকার বলতে কিছু নেই বললেই চলে। বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর হানাহানিতে অকাতরে মারা যাচ্ছে নাগরিকেরা। জান বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে তিন বছরের বেশি সময় ধরে। মারা গেছে আড়াই লক্ষাধিক লোক। কমবেশি ২০ লাখ লোক আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে, তারা উদ্বাস্তু। সুদানেও কমবেশি একই অবস্থা। আছে আল-শাবাব গোষ্ঠী। নাইজেরিয়ার বোকো হারাম।
অর্থাৎ এসব দেশের লোকেরা ভাবছে, দেশে থাকলে হানাহানিতে নির্ঘাত মারা যাবে। তার চেয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করলেও মারা যাওয়ার আশঙ্কা প্রচুর। তবে সমুদ্রযাত্রায় সলিলসমাধি নাও হতে পারে, বেঁচেও তো যেতে পারি। রোহিঙ্গাদেরও অবস্থা প্রায় তদ্রুপ। তারা গুলি-কামানে বেঘোরে মারা না পড়লেও তিলে তিলে অত্যাচারে, অনাচারে, না-খেয়ে, কাজকর্ম না পেয়ে মরছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়ও প্রাণ হারাচ্ছে। তাই লিবিয়া, উত্তর নাইজেরিয়া, সিরিয়া, ইরাক, সুদান, সোমালিয়ায় একেবারে উপায়বিহীন মানুষগুলোর মতো রোহিঙ্গারাও বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে অজানার বিপৎসংকুল সমুদ্রযাত্রা।
তার সঙ্গে প্রবাসে গিয়ে কল্যাণ পেতে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশিরাও। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার গণকবরে স্থান মিলেছে শত শত বাংলাদেশির। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাগরগুলোতে সলিলসমাধি হয়েছে আরও শত শত স্বদেশির। আর বিশ্ব গণমাধ্যমে এখন সিরিয়া-লিবিয়া-রোহিঙ্গা-বাংলাদেশ—সব একই কাতারের, বসবাসের অযোগ্য দেশ।
প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর কল্যাণে বছর তিনেক ধরে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ। ফলে মানব পাচারকারীদের জন্য উন্মোচিত হয়েছে পাচারের অপরাধমূলক দুয়ার। আর কক্সবাজারসহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নৌ ও সীমান্ত কর্তৃপক্ষ এদের প্রত্যক্ষ–পরোক্ষ সহায়তা ছাড়া হাজার হাজার লোক কোনোভাবেই এভাবে সমুদ্রযাত্রা করতে পারে না। এখন দু-চারটা জেলার দু-চার-দশজন ‘মানব পাচারকারী’কে আটক করে অসংখ্য মৃত্যুর দায়িত্ব রাষ্ট্র এড়াবে।
আর ‘ভার্চুয়াস অ্যাক্ট’? কল্যাণকারী মন্ত্রী প্রমোশন পেয়েছেন, বিরাটভাবে। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতা—অর্থাৎ সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদককে দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি অরাজনৈতিক কাজের দায়িত্ব, অর্থাৎ জনপ্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার দায়িত্ব। এর ধারাবাহিকতায় অন্য প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা না আবার মৎস্য ও পশু প্রজনন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পান!
মোদ্দাকথা, আমাদের রাজনীতিতে ‘ভার্চুয়াস অ্যাক্ট’ বলে কিছুই নেই। ভাসা-ভাসা মনে পড়ছে, অ্যারিস্টোটলও ‘ভার্চু’ আর ‘ভার্চুয়াস অ্যাক্ট’-এর কথা বলেছিলেন সুখী হওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে। সুখী হতে হলে ‘ভার্চুয়াস অ্যাক্ট’ করতে হবে। গ্রিসে সম্প্রতি একেবারে সাত দিনের নোটিশে গণভোট হয়ে গেল। আমাদের প্রতি দশকেও একবার যদি ভোটাভুটি হয়, তাহলেই আমরা হব ভাগ্যবান। আমাদের রাজনীতি থেকে ভার্চু আর ভার্চুয়াস অ্যাক্ট চলে গেছে। ফলাফল—রাজনের মৃত্যুর মতো; আশঙ্কা হয়, বহু মৃত্যু আমাদের জন্য
অপেক্ষা করছে। সলিলসমাধি তো শুরু হয়েই গেছে, গৃহযুদ্ধ ছাড়াই।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।
Comments
Post a Comment