রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হতে হতে জমাট বেঁধে আছে। এখন সঙ্কট উত্তরণে একটা ব্যবস্থাপত্র বা প্রেসক্রিপশন আশা করাটা স্বাভাবিক। জনগণ মনে করে সঙ্কট একটাই, সরকার অবৈধ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় বসে আছে। জনগণের সম্মতি ছাড়া রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করছে, যা ন্যায্য নয়। ক্ষমতায় আশা এবং থাকার ক্ষেত্রে বৈধতার প্রশ্নটি মুখ্য। মূল সমস্যা এটাই। বাকি সব সমস্যা-সঙ্কট এর থেকে জন্ম নিয়েছে। সাধারণভাবে একটা ধারণা জন্ম নিয়েছে- আন্দোলন করে এ সরকার হঠানো যাবে না। কারণ, সরকার আন্দোলন করতে দেবে না। গণতন্ত্রের ভাষা এ সরকার মানবে না। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সব পথ বন্ধ করে দেয়া আছে। বিরোধী দল ও জোটকে রাস্তায় নামতে না দিলে আন্দোলন হবে না- জনগণের একটা অংশ ধরেই নিয়েছেন এটাই স্বতঃসিদ্ধ। জনগণের একটা অংশ এটাও মনে করেন, নির্বাচনের মাধ্যমেও এই সরকার হঠানো যাবে না। কারণ, নির্বাচন ব্যবস্থাকে শুধু পঙ্গু নয়, নিঃশেষ করে দেয়া হয়েছে। জনগণ ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে না। যেতে পারলেও ভোট দিতে পারবে না। ভোট দিতে পারলেও সেটা ওলটপালট করে দেয়া হবে। আমরা যারা সত্তর সাল থেকে নির্বাচন দেখে আসছি, তারও আগে আইয়ুব-ফাতেমা জিন্নার ভোটযুদ্ধ তরুণ হিসেবে উপভোগ করেছি; আমরা জানি, রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে আন্দোলন যেমন দমন করা যায়, তেমনি ভোটের ফলাফল ওলট-পালট করতেও রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করা সম্ভব। সেটা তেয়াত্তরেও দেখেছি। তার পরও কমবেশি প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু পুকুরচুরি ছিল না। জালজালিয়াতির চূড়ান্ত পর্বটা দেখলাম চৌদ্দ সালের ৫ জানুয়ারি। সেটা হলো পুকুরচুরির বাবা মহাসাগরচুরি। জালজালিয়াতি ও ভোটডাকাতির উৎসব দেখলাম তিন সিটি নির্বাচনে। এরপর যেকোনো সাধুমন বলতে বাধ্য, ‘নির্বাচনকে শত কোটি সালাম।’ জনগণের আন্দোলনে সাফল্য আসবে না- এটা বিশ্বাস করি না। সাফল্য যা আসবে তা নিয়তান্ত্রিক আন্দোলনের পথেই আসবে। এটাও বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক সঙ্কটের বরফও গলবে আন্দোলনের পথ ধরেই। এ পর্যন্ত জনগণের কোনো আন্দোলন বৃথা যায়নি। বিগত আন্দোলনগুলো শুধু সফল নয়, বহুমাত্রিক ফল ফলিয়েছে। ভবিষ্যতে এর প্রমাণ মিলবে। ঊনসত্তরে এসে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে অর্থহীন মনে হয়নি। বায়ান্নতে দাঁড়িয়ে আটচল্লিশ ছিল প্রেরণা। একাত্তরে এসে অতীতের সব অর্জন গোলায় তোলা সম্ভব হলো। এবারো অতীত আন্দোলনের প্রতিটি ধাপ অর্জনের নিয়ামক হয়ে যাবে- শুধু সময়ের অপেক্ষা। এখন সরকারের ওপর মনস্তÍত্ত্বিক চাপ এতটাই প্রবল, যা বাইরে থেকেও দেখা এবং বোঝা কষ্টকর নয়। সরকারকে অজানা এক ভীতি তাড়া করছে। তারা ছায়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। নৈঃশব্দের মাঝেও তারা আঁতকে উঠছেÑ এই বুঝি মনের বাঘ ঘাড়ে উঠে চেপে বসল। খালেদাভীতি তাদেরকে সুস্থির থাকতে দেয় না, পাতা নড়লেও নড়েচড়ে বসে। আর একটুতেই খালেদা কিংবা জিয়া পরিবার নিয়ে প্রলাপ বকা শুরু করে দিচ্ছে। আন্দোলনভীতি ও ভোটভীতি এতটাই প্রবল যে তারা ভেবে পাচ্ছে না কোন পথে এগোলে- সাপ মরবে, লাঠি ভাঙবে না। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের জিগির একসময় রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করলেও এখন সেটাও ভীতি হয়ে তাড়া করছে। জামায়াত-শিবির আগে থেকেই ক্ষমতাসীনদের জলাতঙ্ক কিংবা মৃগী রোগী বানিয়ে ছেড়েছে। এখনো এটা জলাতঙ্ক রোগের মতো ভীতি ছড়ানোর উপকরণ হয়ে আছে। এসবের মোকাবেলায় সরকারের লোকেরা এখন বিদেশে সেকেন্ড হোমস খুঁজে বেড়াচ্ছে। জামায়াত-বিএনপির পরিচয়ে জাল বা ভুয়া সনদ দেখিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজছে। সুইস ব্যাংকে টাকা পাচার করে আখের গুছাচ্ছে। অন্য দিকে নীতিনির্ধারকেরা নিñিদ্র নিরাপত্তাবলয় বাড়াতে বাড়াতে নিজেদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। সরকারকে যা না বনের বাঘ তাড়া করছে, তারচেয়ে বেশি তাড়া করছে মনের বাঘ। যদিও এটা বাস্তবতা নয়। কেউ সরকারকে তাড়া করছে না, পিছু ধাওয়া করতেও কোনো উদ্যোগ নেই। গণতন্ত্রহীনতার ভেতর যে গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে- এটা তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এ অবস্থা মানুষকে স্থিতিতে থাকতে দেয় না, সুস্থও থাকতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে চিন্তার গ্রন্থি বারবার ছিঁড়ে যায়। একধরনের মানসিক বৈকল্য এসে ভর করে। তাতে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেয় ভুলভাবে। চিন্তা করে, কিন্তু অসঙ্গতিগুলো মাথায় নিতে পারে না। নিজেদের জন্য সহজ পথও খুঁজে পায় না। জনগণ লক্ষ করছেÑ আওয়ামী লীগ ও তাদের নৌকায় ওঠা ভিন্ন দলের মন্ত্রীরা ও অন্য পথের কন্যারা প্রতিদিন খালেদা জিয়াকে উপদেশ দিচ্ছেন, পরামর্শ খয়রাত করছেন, তিনি যেন জামায়াত ছাড়েন। খালেদা জিয়া নির্বিকার, জামায়াত নির্লিপ্ত। মনে হয় বিএনপি-জামায়াত এই ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে উপদেষ্টার মর্যাদায় চায় না। বিএনপি-জামায়াত এ ক্ষেত্রে মনে হয় চাণক্যনীতি থেকে শিক্ষা নিতে চায়। ভারতীয় কূটনীতিতে উত্তরে বললে দক্ষিণে যাওয়ার রেওয়াজ আছে। চাণক্যনীতি ও কৌটিল্যশাস্ত্র অনুযায়ী প্রতিপক্ষের পরামর্শ ও উপদেশ সৎ উদ্দেশ্যবিধৌত হয় না। চাণক্য ও কৌটিল্য একজনেরই নাম। তিনি ছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কূটনীতিবিশারদ ও এতদসক্রান্ত মন্ত্রী। অর্থশাস্ত্রপ্রণেতা হিসেবে চাণক্যেরই অপর নাম এটি। আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীরা বিএনপি-জামায়াতকে বিচ্ছিন্ন করতে যতটা মরিয়া, তারা যেন ততটাই নির্লিপ্ত। অনেকেই জানতে আগ্রহী খালেদা জিয়া বিপর্যস্ত দল নিয়েও মাঝে মধ্যে এতটা দৃঢ়তা দেখাতে যান কিসের জোরে। আওয়ামী লীগ নেতারা তাকে পরাজিত সৈনিক বলতে বলতে নিজেরাই এখন ক্লান্ত। খালেদা জিয়া যেন ক্লান্ত নন। বারবার আশাবাদ জাগিয়ে তুলছেন। তাহলে জনগণ ছাড়া তার শক্তির উৎস কী? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর সরকারের কাছে নেই বলেই সরকার এতটা উদ্বিগ্ন। বাস্তবে দেশের উল্লেখযোগ্য মানুষ পরিবর্তনকামী হয়ে উঠেছে। একটা পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত মানুষ গণতন্ত্রহীন উন্নয়নধারণা গিলবে না। রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার আর ক্ষমতার কেলেঙ্কারি জনগণের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সম্ভবত জনগণের এই পরিবর্তনের মানসিকতাই খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অবস্থানকে দৃঢ়তা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসেই ভাবতে থাকে তারাই রাষ্ট্র, তারাই দেশ। আর নামার সিঁড়িটাও সরিয়ে ফেলেছে। অপর দিকে অতীত তাদের পিছু টানে। তাই সবার জন্য বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থাপত্র একটাইÑ পরম্পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ফাঁদে পা দিয়ে বিপদ ডেকে না এনে গণতন্ত্রচর্চার পথ অবারিত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা। বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিয়ে সে পথে হাঁটাই সবার জন্য নিরাপদ। মধ্যবর্তী নির্বাচনের একটি টোপ সবার সামনে রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেশবাসীর মতোই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মেনে নেয়নি। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর আমাদের নির্বাচনব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকতা যে ভেঙে পড়েছে, তা আর কারো কাছে লুকোনোর অবস্থায় নেই। সরকার এত বড় জালজালিয়াতি ও অনিয়মের পরও কেন একটা গ্রহণযোগ্য তদন্তের জন্যও উদ্যোগী হলো না, সে প্রশ্ন বিশ্ববিবেককেও নাড়া দিয়েছে। ব্রিটিশ দূত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেটা জানিয়েও দিয়েছেন। তাই নির্বাচনব্যবস্থায় কিছু সংস্কার,কমিশন পুনর্গঠন ও সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ফর্মুলায় মধ্যবর্র্তী নির্বাচন হতেই হবে। বর্ষা, রোজা ও হজ-কোরবানি শেষে সেই আয়োজন না হলে দেশ নতুন সঙ্কটের মুখামুখি দাঁড়াবে। এটা একটি মত। অন্য মতটি হচ্ছে, সরকার আন্দোলন ‘দমাতে’ সক্ষম হয়েছে। তাহলে নির্বাচন দিতে যাবে কোন কারণে; বরং ভাগ করো শাসন করো, মামলার স্তূপে প্রতিপক্ষকে চাপা দাও, তাতেই তো সিদ্ধি। বাস্তবে ১৬ কোটি মানুষকে পোষ মানিয়ে দেশ পরিচালনা সহজ কাজ নয়, প্রচারণা ও প্রতারণা করে আইয়ুব খান এক দশক পালনের ডুগডুগি বাজানোর কয়েক দিনের মাথায় কুপোকাত হলেন। সেটা ছিল ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের ফসল। এরশাদ পতনের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়েও আস্ফালন দেখিয়েছেন। মফস্বল থেকে ঢাকায় ফিরে দেখেন জনগণ বারবার গোলায় তুলতে সক্ওপরওয়ালাই নির্ধারণ করে দেন। masud2151@gmail.com -

রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হতে হতে জমাট বেঁধে আছে। এখন সঙ্কট উত্তরণে একটা ব্যবস্থাপত্র বা প্রেসক্রিপশন আশা করাটা স্বাভাবিক। জনগণ মনে করে সঙ্কট একটাই, সরকার অবৈধ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় বসে আছে। জনগণের সম্মতি ছাড়া রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করছে, যা ন্যায্য নয়। ক্ষমতায় আশা এবং থাকার ক্ষেত্রে বৈধতার প্রশ্নটি মুখ্য। মূল সমস্যা এটাই। বাকি সব সমস্যা-সঙ্কট এর থেকে জন্ম নিয়েছে।
সাধারণভাবে একটা ধারণা জন্ম নিয়েছে- আন্দোলন করে এ সরকার হঠানো যাবে না। কারণ, সরকার আন্দোলন করতে দেবে না। গণতন্ত্রের ভাষা এ সরকার মানবে না। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সব পথ বন্ধ করে দেয়া আছে। বিরোধী দল ও জোটকে রাস্তায় নামতে না দিলে আন্দোলন হবে না- জনগণের একটা অংশ ধরেই নিয়েছেন এটাই স্বতঃসিদ্ধ। জনগণের একটা অংশ এটাও মনে করেন, নির্বাচনের মাধ্যমেও এই সরকার হঠানো যাবে না। কারণ, নির্বাচন ব্যবস্থাকে শুধু পঙ্গু নয়, নিঃশেষ করে দেয়া হয়েছে। জনগণ ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে না। যেতে পারলেও ভোট দিতে পারবে না। ভোট দিতে পারলেও সেটা ওলটপালট করে দেয়া হবে।
আমরা যারা সত্তর সাল থেকে নির্বাচন দেখে আসছি, তারও আগে আইয়ুব-ফাতেমা জিন্নার ভোটযুদ্ধ তরুণ হিসেবে উপভোগ করেছি; আমরা জানি, রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে আন্দোলন যেমন দমন করা যায়, তেমনি ভোটের ফলাফল ওলট-পালট করতেও রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করা সম্ভব। সেটা তেয়াত্তরেও দেখেছি। তার পরও কমবেশি প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু পুকুরচুরি ছিল না। জালজালিয়াতির চূড়ান্ত পর্বটা দেখলাম চৌদ্দ সালের ৫ জানুয়ারি। সেটা হলো পুকুরচুরির বাবা মহাসাগরচুরি। জালজালিয়াতি ও ভোটডাকাতির উৎসব দেখলাম তিন সিটি নির্বাচনে। এরপর যেকোনো সাধুমন বলতে বাধ্য, ‘নির্বাচনকে শত কোটি সালাম।’
জনগণের আন্দোলনে সাফল্য আসবে না- এটা বিশ্বাস করি না। সাফল্য যা আসবে তা নিয়তান্ত্রিক আন্দোলনের পথেই আসবে। এটাও বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক সঙ্কটের বরফও গলবে আন্দোলনের পথ ধরেই। এ পর্যন্ত জনগণের কোনো আন্দোলন বৃথা যায়নি। বিগত আন্দোলনগুলো শুধু সফল নয়, বহুমাত্রিক ফল ফলিয়েছে। ভবিষ্যতে এর প্রমাণ মিলবে। ঊনসত্তরে এসে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে অর্থহীন মনে হয়নি। বায়ান্নতে দাঁড়িয়ে আটচল্লিশ ছিল প্রেরণা। একাত্তরে এসে অতীতের সব অর্জন গোলায় তোলা সম্ভব হলো। এবারো অতীত আন্দোলনের প্রতিটি ধাপ অর্জনের নিয়ামক হয়ে যাবে- শুধু সময়ের অপেক্ষা। 
এখন সরকারের ওপর মনস্তÍত্ত্বিক চাপ এতটাই প্রবল, যা বাইরে থেকেও দেখা এবং বোঝা কষ্টকর নয়। সরকারকে অজানা এক ভীতি তাড়া করছে। তারা ছায়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। নৈঃশব্দের মাঝেও তারা আঁতকে উঠছেÑ এই বুঝি মনের বাঘ ঘাড়ে উঠে চেপে বসল। খালেদাভীতি তাদেরকে সুস্থির থাকতে দেয় না, পাতা নড়লেও নড়েচড়ে বসে। আর একটুতেই খালেদা কিংবা জিয়া পরিবার নিয়ে প্রলাপ বকা শুরু করে দিচ্ছে। আন্দোলনভীতি ও ভোটভীতি এতটাই প্রবল যে তারা ভেবে পাচ্ছে না কোন পথে এগোলে- সাপ মরবে, লাঠি ভাঙবে না। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের জিগির একসময় রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করলেও এখন সেটাও ভীতি হয়ে তাড়া করছে। জামায়াত-শিবির আগে থেকেই ক্ষমতাসীনদের জলাতঙ্ক কিংবা মৃগী রোগী বানিয়ে ছেড়েছে। এখনো এটা জলাতঙ্ক রোগের মতো ভীতি ছড়ানোর উপকরণ হয়ে আছে। এসবের মোকাবেলায় সরকারের লোকেরা এখন বিদেশে সেকেন্ড হোমস খুঁজে বেড়াচ্ছে। জামায়াত-বিএনপির পরিচয়ে জাল বা ভুয়া সনদ দেখিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজছে। সুইস ব্যাংকে টাকা পাচার করে আখের গুছাচ্ছে। অন্য দিকে নীতিনির্ধারকেরা নিñিদ্র নিরাপত্তাবলয় বাড়াতে বাড়াতে নিজেদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। সরকারকে যা না বনের বাঘ তাড়া করছে, তারচেয়ে বেশি তাড়া করছে মনের বাঘ। যদিও এটা বাস্তবতা নয়। কেউ সরকারকে তাড়া করছে না, পিছু ধাওয়া করতেও কোনো উদ্যোগ নেই। গণতন্ত্রহীনতার ভেতর যে গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে- এটা তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
এ অবস্থা মানুষকে স্থিতিতে থাকতে দেয় না, সুস্থও থাকতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে চিন্তার গ্রন্থি বারবার ছিঁড়ে যায়। একধরনের মানসিক বৈকল্য এসে ভর করে। তাতে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেয় ভুলভাবে। চিন্তা করে, কিন্তু অসঙ্গতিগুলো মাথায় নিতে পারে না। নিজেদের জন্য সহজ পথও খুঁজে পায় না।
জনগণ লক্ষ করছেÑ আওয়ামী লীগ ও তাদের নৌকায় ওঠা ভিন্ন দলের মন্ত্রীরা ও অন্য পথের কন্যারা প্রতিদিন খালেদা জিয়াকে উপদেশ দিচ্ছেন, পরামর্শ খয়রাত করছেন, তিনি যেন জামায়াত ছাড়েন। খালেদা জিয়া নির্বিকার, জামায়াত নির্লিপ্ত। মনে হয় বিএনপি-জামায়াত এই ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে উপদেষ্টার মর্যাদায় চায় না। বিএনপি-জামায়াত এ ক্ষেত্রে মনে হয় চাণক্যনীতি থেকে শিক্ষা নিতে চায়। ভারতীয় কূটনীতিতে উত্তরে বললে দক্ষিণে যাওয়ার রেওয়াজ আছে। চাণক্যনীতি ও কৌটিল্যশাস্ত্র অনুযায়ী প্রতিপক্ষের পরামর্শ ও উপদেশ সৎ উদ্দেশ্যবিধৌত হয় না। চাণক্য ও কৌটিল্য একজনেরই নাম। তিনি ছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কূটনীতিবিশারদ ও এতদসক্রান্ত মন্ত্রী। অর্থশাস্ত্রপ্রণেতা হিসেবে চাণক্যেরই অপর নাম এটি। আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীরা বিএনপি-জামায়াতকে বিচ্ছিন্ন করতে যতটা মরিয়া, তারা যেন ততটাই নির্লিপ্ত। অনেকেই জানতে আগ্রহী খালেদা জিয়া বিপর্যস্ত দল নিয়েও মাঝে মধ্যে এতটা দৃঢ়তা দেখাতে যান কিসের জোরে। আওয়ামী লীগ নেতারা তাকে পরাজিত সৈনিক বলতে বলতে নিজেরাই এখন ক্লান্ত। খালেদা জিয়া যেন ক্লান্ত নন। বারবার আশাবাদ জাগিয়ে তুলছেন। তাহলে জনগণ ছাড়া তার শক্তির উৎস কী? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর সরকারের কাছে নেই বলেই সরকার এতটা উদ্বিগ্ন। বাস্তবে দেশের উল্লেখযোগ্য মানুষ পরিবর্তনকামী হয়ে উঠেছে। একটা পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত মানুষ গণতন্ত্রহীন উন্নয়নধারণা গিলবে না। রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার আর ক্ষমতার কেলেঙ্কারি জনগণের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সম্ভবত জনগণের এই পরিবর্তনের মানসিকতাই খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অবস্থানকে দৃঢ়তা দিয়েছে। 
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসেই ভাবতে থাকে তারাই রাষ্ট্র, তারাই দেশ। আর নামার সিঁড়িটাও সরিয়ে ফেলেছে। অপর দিকে অতীত তাদের পিছু টানে। তাই সবার জন্য বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থাপত্র একটাইÑ পরম্পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ফাঁদে পা দিয়ে বিপদ ডেকে না এনে গণতন্ত্রচর্চার পথ অবারিত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা। বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিয়ে সে পথে হাঁটাই সবার জন্য নিরাপদ।
মধ্যবর্তী নির্বাচনের একটি টোপ সবার সামনে রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেশবাসীর মতোই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মেনে নেয়নি। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর আমাদের নির্বাচনব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকতা যে ভেঙে পড়েছে, তা আর কারো কাছে লুকোনোর অবস্থায় নেই। সরকার এত বড় জালজালিয়াতি ও অনিয়মের পরও কেন একটা গ্রহণযোগ্য তদন্তের জন্যও উদ্যোগী হলো না, সে প্রশ্ন বিশ্ববিবেককেও নাড়া দিয়েছে। ব্রিটিশ দূত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেটা জানিয়েও দিয়েছেন। তাই নির্বাচনব্যবস্থায় কিছু সংস্কার,কমিশন পুনর্গঠন ও সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ফর্মুলায় মধ্যবর্র্তী নির্বাচন হতেই হবে। বর্ষা, রোজা ও হজ-কোরবানি শেষে সেই আয়োজন না হলে দেশ নতুন সঙ্কটের মুখামুখি দাঁড়াবে। এটা একটি মত।
অন্য মতটি হচ্ছে, সরকার আন্দোলন ‘দমাতে’ সক্ষম হয়েছে। তাহলে নির্বাচন দিতে যাবে কোন কারণে; বরং ভাগ করো শাসন করো, মামলার স্তূপে প্রতিপক্ষকে চাপা দাও, তাতেই তো সিদ্ধি। বাস্তবে ১৬ কোটি মানুষকে পোষ মানিয়ে দেশ পরিচালনা সহজ কাজ নয়, প্রচারণা ও প্রতারণা করে আইয়ুব খান এক দশক পালনের ডুগডুগি বাজানোর কয়েক দিনের মাথায় কুপোকাত হলেন। সেটা ছিল ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের ফসল। এরশাদ পতনের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়েও আস্ফালন দেখিয়েছেন। মফস্বল থেকে ঢাকায় ফিরে দেখেন তার তখ্ত উল্টে গেছে। এমন ফসল জনগণ বারবার গোলায় তুলতে সক্ষম। সময়টা ওপরওয়ালাই নির্ধারণ করে দেন।
masud2151@gmail.com

Comments