বোবা হয়ে যাবো, কিছুই বলব না, অন্ধ হয়ে যাবো কিছুই দেখব না
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি কারা করেছিল, নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। ধর্ষক মানিক দেশ ছেড়ে বাঁচেনি। তার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। ক্ষমতাসীনেরা মানিককে ক্ষোভের আগুন থেকে বাঁচাতে ইতালি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। প্রকৃতির ক্ষোভ তাকে বাঁচতে দেয়নি।
থার্টিফার্স্ট নাইটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বাঁধন সম্ভ্রম হারিয়েছিল। সে তো ১৯৯৯ সালের কথা। বাঁধনের বস্ত্রহরণের ঘটনায় ক্ষমতাসীনেরা লজ্জা পাননি। পুরো জাতি লজ্জা পেয়েছিল। ২০১১-তে আবার একই স্থানে যৌন নিগ্রহের শিকার হলো আরেক বালিকা। বালিকাবিষয়ক একই পাপের আগুনে দগ্ধ হলো বৈশাখী উৎসবে অপর নারী, তাও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চার স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতর।
ভিকারুননিসায় শিক্ষক নামের এক নরকের কীট কেড়ে নিলেন এক ছাত্রীর সম্ভ্রম। সেই শিক্ষকের নাম পরিমল জয়ধর। তার মতো আরেক স্কুলের ক্লিনার এক শিশু শিক্ষার্থীর শ্লীলতাহানির কুরেকর্ড গড়েছে এই ঢাকাতেই। সোনার ছেলেরাই ঘুরেফিরে রমণী বল্লভ হয়ে ধরা পড়ল। এরা শুধু কামিনী কাতর নয়, ক্ষমতা তাদের অন্ধ বানিয়েছে। পরিস্থিতি তাদের সাজিয়েছে যৌন সন্ত্রাসী।
ভারতের অনেক ভালো কাজ আমরা অনুসরণ করি না, অনুকরণ করি তাদের বিনোদন বাণিজ্যের ধারা। তাদের রাজনীতির কিছু প্রাতিষ্ঠানিকতা, নির্বাচন কমিশনের সুনাম, বিচার বিভাগীয় স্বকীয়তা, জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার প্রচেষ্টার মতো বিষয়গুলো আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে না। মনস্তাত্ত্বিক কারণটা বোধ করি ভারতেরই সৃষ্টি। কারণ, ভারত মন্দটার পৃষ্ঠপোষকতা করে, ভালোটার নয়। ভারতের খারাপ দৃষ্টান্তটি অনুসরণ করল আমাদের যৌন সন্ত্রাসীরা। যৌন সন্ত্রাসীরা রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এক তরুণীকে অস্ত্রেরমুখে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে গণধর্ষণ করেছে। আমরা অনেক অনাচারের সাথে পরিচিত। কিন্তু চলন্ত ট্রেনে-বাসে ধর্ষণের সাথে অল্পই পরিচিত ছিলাম। দিল্লির পর ঢাকাও এই কুখ্যাতির বাইরে রইল না। আসমান ছোঁয়া খ্যাতির দিল্লি রাতারাতি ধর্ষকদের জন্য নতুন খ্যাতি পেল, ঢাকার পরিচিতির সাথেও যোগ হলো এই কলঙ্কতিলক। ধর্ষিতা গারো ওই তরুণী নিত্যদিনকার মতো কাজ শেষে খালার বাসায় ফিরছিল। পথে ওই তরুণীকে অস্ত্রেরমুখে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেয় দুর্বৃত্তরা। এরপর তাকে ওই গাড়িতে পালাক্রমে গণধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে রেখে যায়। গ্রাম থেকে উঠে আসা এই মেয়েটি লেখাপড়ার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি করে। কলেজ পড়–য়া ওই গারো তরুণী শুধু নিরীহ নয়, অসহায়ও। তার এই অসহায়ত্ব গারো হওয়ার কারণে নয়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি যারা প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য।
পুলিশ দাবি করছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তারা ঘটনাটি তদন্ত করছে। এটাকে আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে পারি না, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই তরুণী বলে নয়, অন্য কেউ হলে যে আক্রান্ত হতেন না, তা হলফ করে বলা যায় না। বাস্তবে রাজনৈতিক শূন্যতা আর জবাবদিহিতার অভাবে সমাজে একশ্রেণীর দুষ্টচক্র হাত-পা ছড়িয়ে বসেছে। সে কারণে সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। নৈতিক অবক্ষয় ও অপরাধ-প্রবণতাকে সহনীয় করে দেখার কারণেই এই তরুণী গণধর্ষণের শিকার হলো। তা ছাড়া বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির কারণেও অপরাধীরা আশকারা পাচ্ছে, তাতো আগেই উল্লেখ করেছি। বিচারহীনতার এই অপসংস্কৃতি কি পাল্টাবে না! এতকিছুর পরও পুলিশকে রাজনীতিতে ব্যবহার না করে অপরাধ দমনে কার্যকর পদক্ষেপের নির্দেশ দেয়া হবে কি না, তাও জানি না।
এর আগে অধিকার ও আইন-সালিস কেন্দ্রের বরাতে ধর্ষণের একটা চিত্র আমরা পেয়েছি। যেসব এনজিও এ ধরনের ইস্যু নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করে তাদের দেয়া তথ্যগুলো একসাথে উপস্থাপন করলে তাজ্জব হতে হয়। মনে হয় আমরা চোখ থাকতে অন্ধ। কান থাকলেও শ্রুতি প্রতিবন্ধী।
অনাচার সব সমাজে হয়। সব কালে হয়েছে। রক্ষণশীল সমাজে যৌন নিপীড়ন কম। ধার্মিক মানস মানুষকে সংযত করে। আমরা যারা আধুনিকতা অতিক্রম করে উত্তর আধুনিকতায় গা ডুবিয়েছি, তাদের কাছে নারী ভোগ্যপণ্য। বাণিজ্যের উপকরণ। দাপুটে মডেল কন্যারা যৌনতার চাষ করে। নতুন প্রজন্ম সেটাই গিলে খায়। আর নারী অধিকারের ডুগডুগি বাজায়। বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত। প্রধানমন্ত্রী নারী। স্পিকার নারী। কার্যত বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী। অনুগত কিংবা গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেত্রীও নারী। তারপরও নারী নিগৃহীত। বিচারহীনতার কারণে প্রতিকার না পেয়ে নারী অভিশাপ দিচ্ছে। অনেক নারী গুমরে কাঁদছে- যাদের কান্না আমাদের কাছে শব্দ হয়ে পৌঁছায় না। এ ক্ষেত্রে সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া একটি জাতীয় দৈনিকের তথ্যচিত্রের খানিকটা তুলে ধরা যেতে পারে।
গত প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনায় ঢাকায় শুধু সরকার পরিচালিত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে এসেছেন পাঁচ হাজার ৩২১ জন নারী। অভিযুক্তদের মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র ৪৩ জনের। যে নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, তাদের জীবন থমকে দাঁড়াচ্ছে। তারপর শুরু হয় সেই নারীর গ্লানিকর জীবন। বিচার না পেয়ে আত্মঘাতী হচ্ছেন কেউ কেউ। বোবা কান্নায় কারো কারো বুক ফাটছে কিন্তু মুখ ফুটছে না। কেউ একঘরে হওয়ার ভয়ে আপস-মীমাংসা করে প্রাণে বাঁচতে সচেষ্ট। রাষ্ট্র ও সরকার কারো পক্ষে যেভাবে দাঁড়ানো উচিত সেভাবে দাঁড়াচ্ছে না।
ঘটনার শিকার নারী ও তাদের স্বজনেরা সাধারণত মুখ খোলেন না। যারা মুখ খোলেন তারা চোখ খুলে দেখতে পান, ধর্ষকেরা সমাজের প্রভাবশালী। নির্যাতনের শিকার নারী ধরে নিতে বাধ্য হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুবিচার পাবে না। এটা আশঙ্কা নয়, অভিজ্ঞতা। তাই অধিকাংশ নারী আইনের আশ্রয় নিতে চান না।
বাংলাদেশে ফতোয়া নিয়ে একসময় তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল। সব দোষ মোল্লাদের ফতোয়ার। তারা নাকি ফতোয়া দিয়ে সব শেষ করে দিচ্ছে। অথচ উচ্চ আদালত ও আধুনিক সমাজ বিচার নিশ্চিত করতে পারল না। হাতুড়ে ডাক্তারের চিকিৎসা পরিহার মানে চিকিৎসা এড়ানো নয়। তেমনি কাঠ মোল্লার ফতোয়াও গ্রহণযোগ্য না হওয়াই উত্তম। কিন্তু একটি সন্তোষজনক সমাধান পেতে হবে। নয়তো মানুষের সমাজ বেশি দিন টিকে না।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি ও ব্র্যাকের হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস বলছে, গত এক বছরে যেসব ধর্ষণের মামলা হয়েছে, তার একটিরও নিষ্পত্তি হয়নি। তাহলে দোষ কার ঘাড়ে চাপলে আমরা রেহাই পাবো। সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে উদ্যোগ নিয়ে দেখা গেল শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল শের-ই-বাংলা, খুলনা, সিলেট এম এ জি ওসমানী, রংপুর ও ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২২ হাজার ৩৮৬ জন ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নিতে এসেছেন। এসব ঘটনায় পাঁচ হাজার তিনটি মামলা হয়েছে। রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের। শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার দশমিক ৪৫ শতাংশ। এক শতাংশের অর্ধেকেরও কম।
আমরা নিশ্চিতভাবে মনে করি, বিগত পঞ্চাশ বছরে নারীর অগ্রগতি আমাদের দেশে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সামাজিক ঘটনা। যদিও এই চিত্র সামগ্রিকও নয়, প্রান্তিক স্তর পর্যন্তও নয়। বাংলাদেশে আইন আছে। আইনের সুষ্ঠু ও সময়োচিত প্রয়োগ নেই। একজন নারী হয়তো সাহস নিয়ে একটি মামলা শুরু করে, অপরপক্ষ থেকে চাপ দেয়া হয় আপস করে ঘরে ফিরে যেতে। সরকারের কাছে অপরাধী আশকারা পায়, নারী ভরসা পায় না। একটি বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে- ধর্ষকের শাস্তি হবে, ধর্ষণের শিকার নারীর তাতে কী লাভ হবে? সে কি সমাজে প্রতিষ্ঠা পাবে, তার সতীত্ব কি ফিরে পাবে? আমাদের বিচার-পুলিশ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। সরকার ব্যস্ত রাজনীতি দমনে, প্রতিপক্ষকে মামলার স্তূপে চাপা দিতে। তাদের কাছে নারীর আকুতি, আহাজারি পৌঁছায় না। তাহলে ফরিয়াদ করা হবে কার কাছে। আরশের প্রভুর কাছে! না আমরাও বোবা হয়ে যাবো, কিছুই বলব না, অন্ধ হয়ে যাবো কিছুই দেখব না।
masud2151@gmail.com
থার্টিফার্স্ট নাইটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বাঁধন সম্ভ্রম হারিয়েছিল। সে তো ১৯৯৯ সালের কথা। বাঁধনের বস্ত্রহরণের ঘটনায় ক্ষমতাসীনেরা লজ্জা পাননি। পুরো জাতি লজ্জা পেয়েছিল। ২০১১-তে আবার একই স্থানে যৌন নিগ্রহের শিকার হলো আরেক বালিকা। বালিকাবিষয়ক একই পাপের আগুনে দগ্ধ হলো বৈশাখী উৎসবে অপর নারী, তাও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চার স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতর।
ভিকারুননিসায় শিক্ষক নামের এক নরকের কীট কেড়ে নিলেন এক ছাত্রীর সম্ভ্রম। সেই শিক্ষকের নাম পরিমল জয়ধর। তার মতো আরেক স্কুলের ক্লিনার এক শিশু শিক্ষার্থীর শ্লীলতাহানির কুরেকর্ড গড়েছে এই ঢাকাতেই। সোনার ছেলেরাই ঘুরেফিরে রমণী বল্লভ হয়ে ধরা পড়ল। এরা শুধু কামিনী কাতর নয়, ক্ষমতা তাদের অন্ধ বানিয়েছে। পরিস্থিতি তাদের সাজিয়েছে যৌন সন্ত্রাসী।
ভারতের অনেক ভালো কাজ আমরা অনুসরণ করি না, অনুকরণ করি তাদের বিনোদন বাণিজ্যের ধারা। তাদের রাজনীতির কিছু প্রাতিষ্ঠানিকতা, নির্বাচন কমিশনের সুনাম, বিচার বিভাগীয় স্বকীয়তা, জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার প্রচেষ্টার মতো বিষয়গুলো আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে না। মনস্তাত্ত্বিক কারণটা বোধ করি ভারতেরই সৃষ্টি। কারণ, ভারত মন্দটার পৃষ্ঠপোষকতা করে, ভালোটার নয়। ভারতের খারাপ দৃষ্টান্তটি অনুসরণ করল আমাদের যৌন সন্ত্রাসীরা। যৌন সন্ত্রাসীরা রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এক তরুণীকে অস্ত্রেরমুখে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে গণধর্ষণ করেছে। আমরা অনেক অনাচারের সাথে পরিচিত। কিন্তু চলন্ত ট্রেনে-বাসে ধর্ষণের সাথে অল্পই পরিচিত ছিলাম। দিল্লির পর ঢাকাও এই কুখ্যাতির বাইরে রইল না। আসমান ছোঁয়া খ্যাতির দিল্লি রাতারাতি ধর্ষকদের জন্য নতুন খ্যাতি পেল, ঢাকার পরিচিতির সাথেও যোগ হলো এই কলঙ্কতিলক। ধর্ষিতা গারো ওই তরুণী নিত্যদিনকার মতো কাজ শেষে খালার বাসায় ফিরছিল। পথে ওই তরুণীকে অস্ত্রেরমুখে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেয় দুর্বৃত্তরা। এরপর তাকে ওই গাড়িতে পালাক্রমে গণধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে রেখে যায়। গ্রাম থেকে উঠে আসা এই মেয়েটি লেখাপড়ার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি করে। কলেজ পড়–য়া ওই গারো তরুণী শুধু নিরীহ নয়, অসহায়ও। তার এই অসহায়ত্ব গারো হওয়ার কারণে নয়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি যারা প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য।
পুলিশ দাবি করছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তারা ঘটনাটি তদন্ত করছে। এটাকে আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে পারি না, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই তরুণী বলে নয়, অন্য কেউ হলে যে আক্রান্ত হতেন না, তা হলফ করে বলা যায় না। বাস্তবে রাজনৈতিক শূন্যতা আর জবাবদিহিতার অভাবে সমাজে একশ্রেণীর দুষ্টচক্র হাত-পা ছড়িয়ে বসেছে। সে কারণে সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। নৈতিক অবক্ষয় ও অপরাধ-প্রবণতাকে সহনীয় করে দেখার কারণেই এই তরুণী গণধর্ষণের শিকার হলো। তা ছাড়া বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির কারণেও অপরাধীরা আশকারা পাচ্ছে, তাতো আগেই উল্লেখ করেছি। বিচারহীনতার এই অপসংস্কৃতি কি পাল্টাবে না! এতকিছুর পরও পুলিশকে রাজনীতিতে ব্যবহার না করে অপরাধ দমনে কার্যকর পদক্ষেপের নির্দেশ দেয়া হবে কি না, তাও জানি না।
এর আগে অধিকার ও আইন-সালিস কেন্দ্রের বরাতে ধর্ষণের একটা চিত্র আমরা পেয়েছি। যেসব এনজিও এ ধরনের ইস্যু নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করে তাদের দেয়া তথ্যগুলো একসাথে উপস্থাপন করলে তাজ্জব হতে হয়। মনে হয় আমরা চোখ থাকতে অন্ধ। কান থাকলেও শ্রুতি প্রতিবন্ধী।
অনাচার সব সমাজে হয়। সব কালে হয়েছে। রক্ষণশীল সমাজে যৌন নিপীড়ন কম। ধার্মিক মানস মানুষকে সংযত করে। আমরা যারা আধুনিকতা অতিক্রম করে উত্তর আধুনিকতায় গা ডুবিয়েছি, তাদের কাছে নারী ভোগ্যপণ্য। বাণিজ্যের উপকরণ। দাপুটে মডেল কন্যারা যৌনতার চাষ করে। নতুন প্রজন্ম সেটাই গিলে খায়। আর নারী অধিকারের ডুগডুগি বাজায়। বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত। প্রধানমন্ত্রী নারী। স্পিকার নারী। কার্যত বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী। অনুগত কিংবা গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেত্রীও নারী। তারপরও নারী নিগৃহীত। বিচারহীনতার কারণে প্রতিকার না পেয়ে নারী অভিশাপ দিচ্ছে। অনেক নারী গুমরে কাঁদছে- যাদের কান্না আমাদের কাছে শব্দ হয়ে পৌঁছায় না। এ ক্ষেত্রে সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া একটি জাতীয় দৈনিকের তথ্যচিত্রের খানিকটা তুলে ধরা যেতে পারে।
গত প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনায় ঢাকায় শুধু সরকার পরিচালিত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে এসেছেন পাঁচ হাজার ৩২১ জন নারী। অভিযুক্তদের মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র ৪৩ জনের। যে নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, তাদের জীবন থমকে দাঁড়াচ্ছে। তারপর শুরু হয় সেই নারীর গ্লানিকর জীবন। বিচার না পেয়ে আত্মঘাতী হচ্ছেন কেউ কেউ। বোবা কান্নায় কারো কারো বুক ফাটছে কিন্তু মুখ ফুটছে না। কেউ একঘরে হওয়ার ভয়ে আপস-মীমাংসা করে প্রাণে বাঁচতে সচেষ্ট। রাষ্ট্র ও সরকার কারো পক্ষে যেভাবে দাঁড়ানো উচিত সেভাবে দাঁড়াচ্ছে না।
ঘটনার শিকার নারী ও তাদের স্বজনেরা সাধারণত মুখ খোলেন না। যারা মুখ খোলেন তারা চোখ খুলে দেখতে পান, ধর্ষকেরা সমাজের প্রভাবশালী। নির্যাতনের শিকার নারী ধরে নিতে বাধ্য হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুবিচার পাবে না। এটা আশঙ্কা নয়, অভিজ্ঞতা। তাই অধিকাংশ নারী আইনের আশ্রয় নিতে চান না।
বাংলাদেশে ফতোয়া নিয়ে একসময় তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল। সব দোষ মোল্লাদের ফতোয়ার। তারা নাকি ফতোয়া দিয়ে সব শেষ করে দিচ্ছে। অথচ উচ্চ আদালত ও আধুনিক সমাজ বিচার নিশ্চিত করতে পারল না। হাতুড়ে ডাক্তারের চিকিৎসা পরিহার মানে চিকিৎসা এড়ানো নয়। তেমনি কাঠ মোল্লার ফতোয়াও গ্রহণযোগ্য না হওয়াই উত্তম। কিন্তু একটি সন্তোষজনক সমাধান পেতে হবে। নয়তো মানুষের সমাজ বেশি দিন টিকে না।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি ও ব্র্যাকের হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস বলছে, গত এক বছরে যেসব ধর্ষণের মামলা হয়েছে, তার একটিরও নিষ্পত্তি হয়নি। তাহলে দোষ কার ঘাড়ে চাপলে আমরা রেহাই পাবো। সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে উদ্যোগ নিয়ে দেখা গেল শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল শের-ই-বাংলা, খুলনা, সিলেট এম এ জি ওসমানী, রংপুর ও ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২২ হাজার ৩৮৬ জন ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নিতে এসেছেন। এসব ঘটনায় পাঁচ হাজার তিনটি মামলা হয়েছে। রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের। শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার দশমিক ৪৫ শতাংশ। এক শতাংশের অর্ধেকেরও কম।
আমরা নিশ্চিতভাবে মনে করি, বিগত পঞ্চাশ বছরে নারীর অগ্রগতি আমাদের দেশে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সামাজিক ঘটনা। যদিও এই চিত্র সামগ্রিকও নয়, প্রান্তিক স্তর পর্যন্তও নয়। বাংলাদেশে আইন আছে। আইনের সুষ্ঠু ও সময়োচিত প্রয়োগ নেই। একজন নারী হয়তো সাহস নিয়ে একটি মামলা শুরু করে, অপরপক্ষ থেকে চাপ দেয়া হয় আপস করে ঘরে ফিরে যেতে। সরকারের কাছে অপরাধী আশকারা পায়, নারী ভরসা পায় না। একটি বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে- ধর্ষকের শাস্তি হবে, ধর্ষণের শিকার নারীর তাতে কী লাভ হবে? সে কি সমাজে প্রতিষ্ঠা পাবে, তার সতীত্ব কি ফিরে পাবে? আমাদের বিচার-পুলিশ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। সরকার ব্যস্ত রাজনীতি দমনে, প্রতিপক্ষকে মামলার স্তূপে চাপা দিতে। তাদের কাছে নারীর আকুতি, আহাজারি পৌঁছায় না। তাহলে ফরিয়াদ করা হবে কার কাছে। আরশের প্রভুর কাছে! না আমরাও বোবা হয়ে যাবো, কিছুই বলব না, অন্ধ হয়ে যাবো কিছুই দেখব না।
masud2151@gmail.com
Comments
Post a Comment