আমাদের দেশের অনেক পত্রপত্রিকা পড়ে মনে হচ্ছে, ব্লগাররা হলেন খুবই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমনস্ক ব্যক্তি। আর এদের নেতৃত্বে আমাদের অভাবের সমস্যা মিটবে।
‘ব্লগার’ শব্দটার ঠিক মানে আমার জানা নেই। জাহাজে ‘লগবুক’ থাকে। লগবুক বলতে বোঝায়, এমন খাতা যাতে জাহাজের দৈনিক কাজের বিবরণ ও অভিজ্ঞতার বিবরণী লিপিবদ্ধ করা হয়। ‘ব্লগ’ ব্যাপারটা নাকি কোনো ব্যক্তির রোজনামচা বা দিনলিপির মতো, যা প্রকাশিত হয় ইনটারনেটের মাধ্যমে। এতে থাকে কোনো বিষয়ে কোনো ব্যক্তির অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়। থাকে সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে কারো ব্যক্তিমনের প্রতিক্রিয়া। যারা এমন লেখা লেখেন তাকেই নাকি এখন বলা হচ্ছে ব্লগার। সিলেটে অবস্থিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালের একটি সংবাদ নিবন্ধ পড়লাম (আলোকিত বাংলাদেশ, ২২ মে ২০১৫)। যা পড়ে অবগত হলাম যে, ব্লগাররা নাকি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এক দল নিজেদের দাবি করছেন মুক্তচিন্তাপন্থী হিসেবে। আর অন্য দল নিজেদের দাবি করছেন ইসলামপন্থী বলে। এরা একে অপরকে সমালোচনা করছেন অত্যন্ত কটু ভাষায়। ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ নিয়ে যতটুকু জানতে পেরেছি তা হলো, মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারীরা প্রথমে আরম্ভ করেন ইসলামপন্থীদের অশিষ্ট ভাষায় আক্রমণ। ব্লগাররা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন আস্তিক ও নাস্তিকে। ‘মুক্তচিন্তা’র অর্থ দাঁড়িয়েছে, নাস্তিকতা। অন্য দিকে যারা দাঁড়িয়েছেন তারা হলেন আস্তিক। তারা মনে করেন, এ বিশ্বে সব কিছুই ঘটছে না অন্ধ জড় প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে। এর মূলে কাজ করছে কোনো-না-কোনো পরিকল্পনা। নাস্তিক ব্লগাররা আস্তিকদের আক্রমণ করছেন বিবর্তনবাদ এবং চার্লস রবার্ট ডারউইনের (১৮০৯-১৮৮২) জীব বিবর্তনবাদের ব্যাখ্যাকে নির্ভর করে। আমি তাই জীব বিবর্তনবাদ ও ডারউইনবাদ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করতে চাচ্ছি। প্রমাণ করতে চাইব, মুক্তচিন্তাবাদীরা আসলে মুক্তচিন্তার অধিকারী নন। আর জীব বিবর্তনবাদ ও ডারউইননির্ভর যুক্তিবিন্যাস আসলে হলো ভিত্তিহীন। ডারউইন আর আগের মতো আদৃত নন বিজ্ঞানী মহলে। জীব বিবর্তনবাদ নিয়েও বিজ্ঞানী মহলে অনেকের মনে জেগেছে সংশয়। যে সংশয়ের কথা আমি তুলে ধরতে চাইব বর্তমান নিবন্ধে।
অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা যায় না জীব বিবর্তনবাদের মাধ্যমে। মনে হয়, প্রতিটি প্রাণী ও প্রতিটি উদ্ভিদের মাধ্যে কাজ করে চলেছে একেকটি পৃথক পরিকল্পনা (চষধহ)। প্রতিটি প্রাণী ও উদ্ভিদ সৃষ্টি হতে পেরেছে পৃথক পৃথক পরিকল্পনা অনুসারে। একটি কেঁচোকে যদি তার মধ্যভাগ থেকে আড়াআড়িভাবে কেটে দু’টুকরো করা হয়, তবে সে মরে না। ওপরের কাটা অংশের নিচ থেকে গজায় লেজ। আর নিচের অংশের উপরিভাগ থেকে সৃষ্টি হয় নতুন মাথা। অর্থাৎ একটি কেঁচো থেকে উদ্ভব হয় দু’টি কেঁচোর। তার মধ্যে কাজ করে একটি কেঁচোর সাধারণ পরিকল্পনা। কেঁচো থেকে কেঁচোই উৎপন্ন হয়, অন্য কোনো প্রাণী নয়। ডারউইন দিয়ে এ ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়া যায় বলে মনে হয় না। উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও কতকটা অনুরূপ ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। আমরা যখন একটি গাছের ডাল কেটে (যেমন সজনে গাছের ডাল) মাটিতে লাগাই, তখন ডালটির গোড়ার দিককেই মাটিতে রোপণ করি। সেখান থেকেই নির্গত হয় শিকড়। কিন্তু ডালটিকে যদি উল্টো করে রোপণ করা যায়, তবে তার আগার দিক থেকে শিকড় নির্গত হয় না। ডালটি শুকিয়ে মরে যেতে শুরু করে। অর্থাৎ ডালটির মধ্যে কাজ করে একটি পরিকল্পনা। যে পরিকল্পনা অনুসারে তার কাঠামো ও দেহক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। একে উদ্ভিদবিদ্যায় বলে পোলারিটি (চড়ষধৎরঃু)। জীব বিবর্তনবাদ দিয়ে এই পোলারিটির ব্যাখ্যা করা কঠিন। আমগাছের ডাল থেকে হয় আমগাছ। লেবুগাছের ডাল থেকে হয় লেবুগাছ। অন্য কোনো গাছের উদ্ভব হতে দেখা যায় না। কোনো কৃষকই তার জমিতে যব লাগিয়ে গম হবে বলে মনে করেন না। এসব ব্যাপার খুবই সাধারণ। যবগাছকে আমরা গমগাছে রূপান্তরিত হতে দেখি না। তাই বিবর্তনবাদকে মেনে নিতে মনে জাগে সংশয়। ডারউইনের পরে জন্মেছিলেন বিখ্যাত ফরাসি বৈজ্ঞানিক লুই পাস্তুর (১৮২২-১৮৯৫)। তিনি নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখান যে, কেবলমাত্র জীবন্ত বস্তু থেকেই জীবন্ত বস্তুর উদ্ভব হতে পারে (ঙসহব ারাঁস ব ারাড়)। রোগীদের দেহে রোগজীবাণুর কারণে রোগের উদ্ভব হয়। রোগীদের দেহে আপনা থেকে রোগজীবাণুর উদ্ভব ঘটতে পারে না। তাই ওষুধের মাধ্যমে যদি রোগজীবাণুকে মেরে ফেলা যায়, তবে রোগী ওই জীবাণুর কারণে উদ্ভূত রোগ থেকে মুক্ত হতে পারে। তার এই আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানকে দিতে পারে বহু দূর এগিয়ে। রোগজীবাণু যদি আপনা থেকে উৎপন্ন হতে পারত, তবে জীবাণুজনিত রোগ চিকিৎসা করা সহজ হতো না। আমরা জানি, টাইফয়েড রোগ হয় টাইফয়েড ব্যাকটেরিয়ার কারণে। আমরা তাই কোনোখানে টাইফয়েড রোগ মহামারী আকারে দেখা দিলে পানি ফুটিয়ে পান করি। পানি ফুটালে পানিতে থাকা টাইফয়েড জীবাণু মরে যায়। বড় বড় শহরে এখন পানিতে ক্লোরিন যোগ করা হয়, রোগজীবাণু নিধন করে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের লক্ষ্যে। সাধারণ গাছপালার ক্ষেত্রে এক গাছ থেকে যেমন আরেক গাছের উদ্ভব হতে দেখা যায় না, রোগজীবাণুর ক্ষেত্রেও তেমনি এক রোগজীবাণু থেকে আরেক রোগজীবাণুর উদ্ভব হতে দেখা যায় না। বহু ব্যাকটেরিয়া লাখ লাখ বছর ধরে একই রকম আছে। টিবি রোগের ব্যাকটেরিয়া হাড়কে আক্রমণ করে। ডাইনোসরের প্রস্তরীভূত হাড়ের মধ্যে টিবি রোগের ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেছে। ডাইনোসরের বোনটিবি হতো। দৃষ্টান্ত আর বাড়িয়ে লাভ নেই। লাখ লাখ বছর ধরে ব্যাকটেরিয়ারা একই রকম আছে। তাদের মধ্যে বিবর্তনের চিহ্ন পাওয়া যায় না। সাধারণত মনে করা হয় এককোষী জীব থেকে বহুকোষী জীবের উদ্ভব হতে পেরেছে। কিন্তু এককোষী জীবরা কেন এখনো এককোষী জীব হয়ে আছে, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। সব এককোষী জীব বহুকোষী জীবে পরিণত হলে এককোষী জীব বলে পৃথিবীতে কিছু থাকত না।
ডারউইন জীব বিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দিয়েছেন প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব (ঞযবড়ৎু ড়ভ ঘধঃঁৎধষ ঝবষবপঃরড়হ)। এর গোড়ার কথা হলো, সেই সব জীবই বাঁচে, যারা তাদের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে। অথবা সংগ্রাম করে টেকে। শীতের দেশে লোমশ প্রাণী থাকতে দেখা যায়, কেননা শীতের দেশে লোমশ প্রাণীরা বাঁচার বেশি উপযোগী। কিন্তু শীতের দেশের সব লোমশ প্রাণী এক নয়। একই পরিবেশে এত রকম লোমশ প্রাণীর উদ্ভব কী করে হতে পারল ডারউইন দিয়ে তার ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভিন্নতা দিয়ে জীববৈচিত্র্যের ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। একই নদীর পানিতে কত রকম মাছ থাকে। একই বনের পরিবেশে থাকে কত গাছ। পরিবেশে বৈচিত্র্য দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা চলে না। ডারউইন বলেছেন, যারা জীবনসংগ্রামে বেশি উপযোগী তারা বাঁচে। তারা রেখে যেতে পারে বংশধারা। অন্যরা পারে না। এভাবে বংশধারায় বাঁচার উপযোগী বৈশিষ্ট্যের মাত্রা বাড়তে থাকে, ফলে এক প্রজাতি আরেক প্রজাতিতে পরিণত হয়। এভাবেই ঘটতে পারে প্রজাতির উদ্ভব। ডারউইন ‘জীবনসংগ্রাম’ কথাটিকে খুব ব্যাপক অর্থে প্রয়োগ করেছেন। তিনি জীবনসংগ্রাম বলতে বুঝিয়েছেন প্রকৃতির সাথে বেঁচে থাকার সংগ্রাম বা চেষ্টাকে। সংগ্রাম বলতে বুঝিয়েছেন, এক প্রজাতির সাথে আরেক প্রজাতির সংগ্রামকে। আবার সংগ্রাম বলতে বুঝিয়েছেন, একই প্রজাতির বিভিন্ন ব্যষ্টির মধ্যে সংগ্রামকে। ডারউইন বলেছেনÑ যারা শক্তিমান, তারা বাঁচে। যারা দুর্বল তারা বাঁচে না। এভাবেই ঘটছে জীব বিবর্তন। কিন্তু তার এই কথা মানলে কেবল যে ধর্মবিশ্বাসে আঘাত লাগে, তা নয়। মানুষের সমাজজীবনে আইন-আদালতের ভিত্তিও হয়ে ওঠে নড়বড়ে। কেননা, আমরা মানবসমাজে নানা আইন করে দুর্বলকে সবলের অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে চাই। আর তাকেই মনে করি ন্যায়ের বিধান। ডারউইন সবচেয়ে অসুবিধায় পড়েন, একই পরিবেশে কী করে নর-নারীর উদ্ভব হতে পারল, সেটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। নর-নারীর পার্থক্যটা ছোট নয়। ডারউইন এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দিয়েছিলেন তার যৌন নির্বাচন তত্ত্ব (ঞযবড়ৎু ড়ভ ঝবীঁধষ ঝবষবপঃরড়হ)। ডারউইন বলেন, মোরগের (ঈড়পশ) মাথার ঝুঁটির উদ্ভবের কারণ হলো মুরগিকে (ঐবহ) আকৃষ্ট করতে চাওয়া। কিন্তু তার এই তত্ত্বটি এখন একেবারেই বাতিল হয়ে গেছে। কেননা, অনেক সময় মুরগিকে মোরগে পরিণত হতে দেখা যায়। মুরগির দেহে ডিম্বাশয় (ঙাধৎু) থাকে। আবার থাকে সুপ্ত শুক্রাশয় (ঞবংঃরং)। কিন্তু কোনো কারণে, যেমন রোগজীবাণুর আক্রমণে ডিম্বাশয় নষ্ট হয়ে গেলে শুক্রাশয় সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তাতে উৎপন্ন হতে থাকে শুক্রকীট (ঝঢ়বৎস)। কেবল তাই নয়, ওই মুরগির দেহে উৎপন্ন হতে আরম্ভ করে পুরুষ যৌন হরমোন। হরমোন বলতে বোঝায় প্রাণীদেহে নালীকাবিহীন গ্রন্থি থেকে নির্গত জৈব রস, যা দেহের নানা ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করে। পরিবর্তন ঘটায় দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের। মুরগির দেহে পুরুষ যৌন হরমোনের উদ্ভবের ফলে তার পালকগুলো হতে চায় মোরগের পালকের মতো। মাথায় হয়ে ওঠে মোরগের মতোই ঝুঁটি। আসলে মুরগিটি হয়ে ওঠে মোরগ। সে অন্য মুরগির সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। আর এই সঙ্গমজাত ডিম থেকে উৎপন্ন হতে পারে মুরগি অথবা মোরগ। এই ঘটনা ডারউইনের যৌন নির্বাচন তত্ত্বকে দিয়েছে একেবারেই বাতিল করে। মানুষ ও উদ্ভিদের মধ্যে তুলনা চলে না। কিন্তু মানুষের নারীদেহের ডিম্বাশয়ে উৎপন্ন এস্ট্রিন (ঙবংঃৎরহ) নামক হরমোন যদি ড্যাফোডিল ফুলগাছে প্রয়োগ করা যায়, তবে সেই ড্যাফোডিল গাছে সারা বছর ফুল ফুটতে থাকে, যা সাধারণভাবে ফোটে না। এসব ঘটনা ডারউইন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।
বিখ্যাত সুইডিশ শ্রেণীবন্ধনবিদ (ঞধীড়হড়সরংঃ) কার্ল ফন লিনে (১৭০৭-১৭৭৮) লাতিন ভাষায় একটি বই লেখেন। বইটির নাম হলো ঝুংঃবসধ হধঃঁৎধব. এই বইয়ের দশম সংস্করণে (১৭৫৮) লিনে মানুষকে স্থাপন করেন প্রাণিরাজ্যে (জবমহঁস অহরসধষরধ)। তিনিই প্রথম মানব প্রজাতির নাম রাখেন ঐড়সড় ঝধঢ়রবহং. লাতিনে হোমো মানে, মানুষ। আর সেপিয়েনস মানে, জ্ঞানী। অর্থাৎ মানুষ প্রাণী হলেও অন্য প্রাণী থেকে আলাদা। কেননা মানুষ জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতা রাখে পারে ভাবনাচিন্তা করতে। লিনে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের অনেক বর্গে (ঙৎফড়) ভাগ করেছেন। এদের মধ্যে একটি বর্গের নাম দেন প্রিমাত (চৎরসধঃবং)। লিনে প্রিমাত বলতে এমন সব স্তন্যপ্রাণীদের বোঝান, যারা হাত-পা দিয়ে জড়িয়ে ধরে গাছে উঠতে পারে। যাদের হাতে পাঁচটি করে আঙুল থাকে। যারা তাদের হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ অন্যান্য আঙুলের ওপর ন্যস্ত করতে পারে। যাদের স্তন বক্ষদেশে নিবদ্ধ। লিনে প্রিমাত বর্গকে তিনটি উপবর্গে ভাগ করেছিলেন। এরা হলো :
চিরপটেরা (ঈযরৎড়ঢ়ঃবৎধ)
কোয়দ্রুমানা (ছঁধফৎঁসধহধ) এবং
বিমানা (ইরসধহধ)
লিনে চিরপটেরা উপবর্গে স্থাপন করেন বাদুড় ও চামচিকাদের। তিনি কেন এটা করেন, তা বোঝা যায় না। কেননা, বাদুড় ও চামচিকারা স্তন্যপায়ী প্রাণী। কিন্তু এদের মধ্যে প্রিমাত বর্গের আর কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। কোয়াদ্রুমানা বলতে তিনি বোঝান বানরের মতো প্রাণীদের। যারা চার হাত পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলে এবং হাতের সাহায্যে কিছু কাজ করতে পারে। লিনে বিমানা বলতে বোঝান মানুষকে। যাদের পায়ের পাতা বানরের মতো নয়। যারা পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে সোজা হয়ে হাঁটে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে নিপুণভাবে কাজ করতে পারে। ডারউইন লিনের শ্রেণীবিভাগকে মেনে নেন। ডারউইন ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে উবংপবহঃ ড়ভ গধহ নামে একটি বই লেখেন। তিনি তার এই বইতে বলেন, মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল কোয়াদ্রুমানার সমপর্যায়ভুক্ত প্রাণী। এ জন্যই অনেকে মনে করেন, ডারউইন বলেছেন মানুষের পূর্ব পুরুষ হলো বানর। কিন্তু কোয়াদ্রুমানা ও বিমানার মাঝামাঝি পর্যায়ের কোনো প্রাণীর প্রস্তুরীভূত দেহাবশেষ (ফসিল) এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তাই বলা চলে না, কোয়াদ্রুমানা থেকে বিমানার উদ্ভব হতে পেরেছে। লিনে বিবর্তনবাদী ছিলেন না। তিনি এ সম্পর্কে কিছু বলেননি।
বিলাতের খ্যাতনামা দার্শনিক হার্বার্ট স্পেনসার (১৮২০-১৯০৩) ছিলেন ডারউইনের সমসাময়িক। চার্লস ডারউইনের মতে, তিনিও ছিলেন বিবর্তনবাদী। বরং বলতে হয় ডারউইনের অনেক আগেই তিনি দিয়েছিলেন প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণা। ডারউইন তার কাছ থেকেই ধার করেন যোগ্যতমের জয়, ঝঁৎারাধষ ড়ভ ঃযব ঋরঃঃবংঃ বচনটি। প্রাকৃতিক নির্বাচন আর যোগ্যতমের জয় সমার্থক। কিন্তু হার্বার্ট স্পেনসার শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেন অজ্ঞেয়বাদী। তিনি বলেন, এমন কিছু প্রশ্ন আছে যার উত্তর মানুষ কোনো দিনই দিতে পারবে না (টহশহড়ধিনষব)। মানুষ এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না, তার জ্ঞান অভাবের কারণে নয়, তার বুদ্ধির সীমাবদ্ধতার জন্য। অজ্ঞেয়বাদীরা আস্তিক নন। আবার নাস্তিকও নন। তারা বলেন, চরম সত্য মানুষ কোনো দিনই অবগত হতে পারবে না। কেননা, কাল নিরবধি, সৃষ্টি অনন্ত। কোনো একটি বিশেষ সৃষ্টির আরম্ভ ও শেষের কথা আমরা ভাবতে পারি। কিন্তু গোটা ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও শেষের কথা ভাবতে পারি না। স্পেনসারের অজ্ঞেয়তাবাদ বিলাতে আস্তিক-নাস্তিকের বিতর্ক কিছুটা স্তিমিত করে দেয়। এ ছাড়া বিলাতের মানুষ মেতে ওঠেন নানাবিধ যন্ত্র আবিষ্কার ও নির্মাণের কাজে। বিলাত এ সময় পরিণত হয় সারা দুনিয়ার কারখানাঘরে। বিলাতে ঘটে প্রথম কলকারখানার বিপ্লব। কেবল তাই নয়, ইংরেজরা হয় বিরাট সাম্রাজ্যের অধিকারী। তাদের চিন্তার একটা বড় বিষয় হয়ে ওঠে সাম্রাজ্য পরিচালনা আর সেই সূত্রে জটিল রাজনীতি। বলা হয়, বিরাট ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না। আবার রক্তও শুকাত না। কেননা, সাম্রাজ্যের কোনো-না-কোনো অংশে লেগে থাকত যুদ্ধ।
গাছপালা নিয়ে ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে কেটেছে আমার জীবনের সুদীর্ঘ সময়। তুলনামূলকভাবে অন্য বিষয়ের চেয়ে গাছপালা সম্বন্ধে আমার জ্ঞানের পরিধি কিছুটা বেশি ও নির্ভরযোগ্য। প্রাণীদের মধ্যে যেমন খাদ্যখাদক সম্বন্ধ থাকতে দেখা যায়, উদ্ভিদদের মধ্যে তা নেই। ডারউইনের জীবনসংগ্রামের ধারণা প্রাণীদের ক্ষেত্রে যত সহজে প্রয়োগ করা যায়, আমার মনে হয় উদ্ভিদের ক্ষেত্রে করা যায় না। ডারউইনের চিন্তাচেতনার সাথে আমি তাই একমত হতে পারিনি। আমি বুঝিনি একই পৃথিবীর পরিবেশে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনপ্রণালীতে এতটা ভিন্নতার উদ্ভব হতে পেরেছে কেন? প্রাণীদের জীবনের প্রধান সমস্যা ক্ষুধা (ঐঁহমবৎ)। কিন্তু উদ্ভিদের জীবনে তা নয়। সবুজ গাছপালা তাদের প্রয়োজনীয় জৈব খাদ্যবস্তু অজৈব বস্তু থেকে সূর্যালোকের সাহায্যে প্রস্তুত করতে পারে; যাকে আমরা বলি ফটোসিনথেসিস। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে চলেছেন কারখানা ফটোসিনথেসিসের অনুরূপ পদ্ধতিতে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় জৈব খাদ্য উৎপাদনের। এটা সম্ভব হলে মানবজীবনে ক্ষুধার সমস্যার অবসান হবে। কিন্তু আমাদের ব্লগাররা যেন মনে করছেন, বাংলাদেশের মানুষ আস্তিক না থেকে যদি নাস্তিক হয়, তাহলে ভরপেট খেতে পারবে। এদের এই চিন্তাকে আমার কাছে বাতুলতা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। আমি অনেকের মতো তাই ব্লগারদের ভাবতে পারছি না বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমনস্ক মানুষ হিসেবে।
আমাদের দেশের অনেক পত্রপত্রিকা পড়ে মনে হচ্ছে, ব্লগাররা হলেন খুবই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমনস্ক ব্যক্তি। আর এদের নেতৃত্বে আমাদের অভাবের সমস্যা মিটবে। কিন্তু আমার তা মনে হয় না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ১৪টি অঙ্গরাজ্যে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি অনুদানে চলে, তাতে জীব বিবর্তনবাদ ও ডারউইনের মতবাদকে এখনো সত্য বলে পড়ানো চলে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ১৪টি অঙ্গরাজ্য যে তাই বলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পিছিয়ে আছে, তা নয়। অর্থনৈতিক দিক থেকেও এদের সমৃদ্ধি অন্যদের তুলনায় যে কম, তা বলা যায় না। ঘটনাটির কথা আমাদের দেশের অনেকেরই জানা নেই। তাই উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা যায় না জীব বিবর্তনবাদের মাধ্যমে। মনে হয়, প্রতিটি প্রাণী ও প্রতিটি উদ্ভিদের মাধ্যে কাজ করে চলেছে একেকটি পৃথক পরিকল্পনা (চষধহ)। প্রতিটি প্রাণী ও উদ্ভিদ সৃষ্টি হতে পেরেছে পৃথক পৃথক পরিকল্পনা অনুসারে। একটি কেঁচোকে যদি তার মধ্যভাগ থেকে আড়াআড়িভাবে কেটে দু’টুকরো করা হয়, তবে সে মরে না। ওপরের কাটা অংশের নিচ থেকে গজায় লেজ। আর নিচের অংশের উপরিভাগ থেকে সৃষ্টি হয় নতুন মাথা। অর্থাৎ একটি কেঁচো থেকে উদ্ভব হয় দু’টি কেঁচোর। তার মধ্যে কাজ করে একটি কেঁচোর সাধারণ পরিকল্পনা। কেঁচো থেকে কেঁচোই উৎপন্ন হয়, অন্য কোনো প্রাণী নয়। ডারউইন দিয়ে এ ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়া যায় বলে মনে হয় না। উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও কতকটা অনুরূপ ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। আমরা যখন একটি গাছের ডাল কেটে (যেমন সজনে গাছের ডাল) মাটিতে লাগাই, তখন ডালটির গোড়ার দিককেই মাটিতে রোপণ করি। সেখান থেকেই নির্গত হয় শিকড়। কিন্তু ডালটিকে যদি উল্টো করে রোপণ করা যায়, তবে তার আগার দিক থেকে শিকড় নির্গত হয় না। ডালটি শুকিয়ে মরে যেতে শুরু করে। অর্থাৎ ডালটির মধ্যে কাজ করে একটি পরিকল্পনা। যে পরিকল্পনা অনুসারে তার কাঠামো ও দেহক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। একে উদ্ভিদবিদ্যায় বলে পোলারিটি (চড়ষধৎরঃু)। জীব বিবর্তনবাদ দিয়ে এই পোলারিটির ব্যাখ্যা করা কঠিন। আমগাছের ডাল থেকে হয় আমগাছ। লেবুগাছের ডাল থেকে হয় লেবুগাছ। অন্য কোনো গাছের উদ্ভব হতে দেখা যায় না। কোনো কৃষকই তার জমিতে যব লাগিয়ে গম হবে বলে মনে করেন না। এসব ব্যাপার খুবই সাধারণ। যবগাছকে আমরা গমগাছে রূপান্তরিত হতে দেখি না। তাই বিবর্তনবাদকে মেনে নিতে মনে জাগে সংশয়। ডারউইনের পরে জন্মেছিলেন বিখ্যাত ফরাসি বৈজ্ঞানিক লুই পাস্তুর (১৮২২-১৮৯৫)। তিনি নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখান যে, কেবলমাত্র জীবন্ত বস্তু থেকেই জীবন্ত বস্তুর উদ্ভব হতে পারে (ঙসহব ারাঁস ব ারাড়)। রোগীদের দেহে রোগজীবাণুর কারণে রোগের উদ্ভব হয়। রোগীদের দেহে আপনা থেকে রোগজীবাণুর উদ্ভব ঘটতে পারে না। তাই ওষুধের মাধ্যমে যদি রোগজীবাণুকে মেরে ফেলা যায়, তবে রোগী ওই জীবাণুর কারণে উদ্ভূত রোগ থেকে মুক্ত হতে পারে। তার এই আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানকে দিতে পারে বহু দূর এগিয়ে। রোগজীবাণু যদি আপনা থেকে উৎপন্ন হতে পারত, তবে জীবাণুজনিত রোগ চিকিৎসা করা সহজ হতো না। আমরা জানি, টাইফয়েড রোগ হয় টাইফয়েড ব্যাকটেরিয়ার কারণে। আমরা তাই কোনোখানে টাইফয়েড রোগ মহামারী আকারে দেখা দিলে পানি ফুটিয়ে পান করি। পানি ফুটালে পানিতে থাকা টাইফয়েড জীবাণু মরে যায়। বড় বড় শহরে এখন পানিতে ক্লোরিন যোগ করা হয়, রোগজীবাণু নিধন করে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের লক্ষ্যে। সাধারণ গাছপালার ক্ষেত্রে এক গাছ থেকে যেমন আরেক গাছের উদ্ভব হতে দেখা যায় না, রোগজীবাণুর ক্ষেত্রেও তেমনি এক রোগজীবাণু থেকে আরেক রোগজীবাণুর উদ্ভব হতে দেখা যায় না। বহু ব্যাকটেরিয়া লাখ লাখ বছর ধরে একই রকম আছে। টিবি রোগের ব্যাকটেরিয়া হাড়কে আক্রমণ করে। ডাইনোসরের প্রস্তরীভূত হাড়ের মধ্যে টিবি রোগের ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেছে। ডাইনোসরের বোনটিবি হতো। দৃষ্টান্ত আর বাড়িয়ে লাভ নেই। লাখ লাখ বছর ধরে ব্যাকটেরিয়ারা একই রকম আছে। তাদের মধ্যে বিবর্তনের চিহ্ন পাওয়া যায় না। সাধারণত মনে করা হয় এককোষী জীব থেকে বহুকোষী জীবের উদ্ভব হতে পেরেছে। কিন্তু এককোষী জীবরা কেন এখনো এককোষী জীব হয়ে আছে, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। সব এককোষী জীব বহুকোষী জীবে পরিণত হলে এককোষী জীব বলে পৃথিবীতে কিছু থাকত না।
ডারউইন জীব বিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দিয়েছেন প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব (ঞযবড়ৎু ড়ভ ঘধঃঁৎধষ ঝবষবপঃরড়হ)। এর গোড়ার কথা হলো, সেই সব জীবই বাঁচে, যারা তাদের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে। অথবা সংগ্রাম করে টেকে। শীতের দেশে লোমশ প্রাণী থাকতে দেখা যায়, কেননা শীতের দেশে লোমশ প্রাণীরা বাঁচার বেশি উপযোগী। কিন্তু শীতের দেশের সব লোমশ প্রাণী এক নয়। একই পরিবেশে এত রকম লোমশ প্রাণীর উদ্ভব কী করে হতে পারল ডারউইন দিয়ে তার ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভিন্নতা দিয়ে জীববৈচিত্র্যের ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। একই নদীর পানিতে কত রকম মাছ থাকে। একই বনের পরিবেশে থাকে কত গাছ। পরিবেশে বৈচিত্র্য দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা চলে না। ডারউইন বলেছেন, যারা জীবনসংগ্রামে বেশি উপযোগী তারা বাঁচে। তারা রেখে যেতে পারে বংশধারা। অন্যরা পারে না। এভাবে বংশধারায় বাঁচার উপযোগী বৈশিষ্ট্যের মাত্রা বাড়তে থাকে, ফলে এক প্রজাতি আরেক প্রজাতিতে পরিণত হয়। এভাবেই ঘটতে পারে প্রজাতির উদ্ভব। ডারউইন ‘জীবনসংগ্রাম’ কথাটিকে খুব ব্যাপক অর্থে প্রয়োগ করেছেন। তিনি জীবনসংগ্রাম বলতে বুঝিয়েছেন প্রকৃতির সাথে বেঁচে থাকার সংগ্রাম বা চেষ্টাকে। সংগ্রাম বলতে বুঝিয়েছেন, এক প্রজাতির সাথে আরেক প্রজাতির সংগ্রামকে। আবার সংগ্রাম বলতে বুঝিয়েছেন, একই প্রজাতির বিভিন্ন ব্যষ্টির মধ্যে সংগ্রামকে। ডারউইন বলেছেনÑ যারা শক্তিমান, তারা বাঁচে। যারা দুর্বল তারা বাঁচে না। এভাবেই ঘটছে জীব বিবর্তন। কিন্তু তার এই কথা মানলে কেবল যে ধর্মবিশ্বাসে আঘাত লাগে, তা নয়। মানুষের সমাজজীবনে আইন-আদালতের ভিত্তিও হয়ে ওঠে নড়বড়ে। কেননা, আমরা মানবসমাজে নানা আইন করে দুর্বলকে সবলের অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে চাই। আর তাকেই মনে করি ন্যায়ের বিধান। ডারউইন সবচেয়ে অসুবিধায় পড়েন, একই পরিবেশে কী করে নর-নারীর উদ্ভব হতে পারল, সেটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। নর-নারীর পার্থক্যটা ছোট নয়। ডারউইন এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দিয়েছিলেন তার যৌন নির্বাচন তত্ত্ব (ঞযবড়ৎু ড়ভ ঝবীঁধষ ঝবষবপঃরড়হ)। ডারউইন বলেন, মোরগের (ঈড়পশ) মাথার ঝুঁটির উদ্ভবের কারণ হলো মুরগিকে (ঐবহ) আকৃষ্ট করতে চাওয়া। কিন্তু তার এই তত্ত্বটি এখন একেবারেই বাতিল হয়ে গেছে। কেননা, অনেক সময় মুরগিকে মোরগে পরিণত হতে দেখা যায়। মুরগির দেহে ডিম্বাশয় (ঙাধৎু) থাকে। আবার থাকে সুপ্ত শুক্রাশয় (ঞবংঃরং)। কিন্তু কোনো কারণে, যেমন রোগজীবাণুর আক্রমণে ডিম্বাশয় নষ্ট হয়ে গেলে শুক্রাশয় সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তাতে উৎপন্ন হতে থাকে শুক্রকীট (ঝঢ়বৎস)। কেবল তাই নয়, ওই মুরগির দেহে উৎপন্ন হতে আরম্ভ করে পুরুষ যৌন হরমোন। হরমোন বলতে বোঝায় প্রাণীদেহে নালীকাবিহীন গ্রন্থি থেকে নির্গত জৈব রস, যা দেহের নানা ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করে। পরিবর্তন ঘটায় দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের। মুরগির দেহে পুরুষ যৌন হরমোনের উদ্ভবের ফলে তার পালকগুলো হতে চায় মোরগের পালকের মতো। মাথায় হয়ে ওঠে মোরগের মতোই ঝুঁটি। আসলে মুরগিটি হয়ে ওঠে মোরগ। সে অন্য মুরগির সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। আর এই সঙ্গমজাত ডিম থেকে উৎপন্ন হতে পারে মুরগি অথবা মোরগ। এই ঘটনা ডারউইনের যৌন নির্বাচন তত্ত্বকে দিয়েছে একেবারেই বাতিল করে। মানুষ ও উদ্ভিদের মধ্যে তুলনা চলে না। কিন্তু মানুষের নারীদেহের ডিম্বাশয়ে উৎপন্ন এস্ট্রিন (ঙবংঃৎরহ) নামক হরমোন যদি ড্যাফোডিল ফুলগাছে প্রয়োগ করা যায়, তবে সেই ড্যাফোডিল গাছে সারা বছর ফুল ফুটতে থাকে, যা সাধারণভাবে ফোটে না। এসব ঘটনা ডারউইন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।
বিখ্যাত সুইডিশ শ্রেণীবন্ধনবিদ (ঞধীড়হড়সরংঃ) কার্ল ফন লিনে (১৭০৭-১৭৭৮) লাতিন ভাষায় একটি বই লেখেন। বইটির নাম হলো ঝুংঃবসধ হধঃঁৎধব. এই বইয়ের দশম সংস্করণে (১৭৫৮) লিনে মানুষকে স্থাপন করেন প্রাণিরাজ্যে (জবমহঁস অহরসধষরধ)। তিনিই প্রথম মানব প্রজাতির নাম রাখেন ঐড়সড় ঝধঢ়রবহং. লাতিনে হোমো মানে, মানুষ। আর সেপিয়েনস মানে, জ্ঞানী। অর্থাৎ মানুষ প্রাণী হলেও অন্য প্রাণী থেকে আলাদা। কেননা মানুষ জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতা রাখে পারে ভাবনাচিন্তা করতে। লিনে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের অনেক বর্গে (ঙৎফড়) ভাগ করেছেন। এদের মধ্যে একটি বর্গের নাম দেন প্রিমাত (চৎরসধঃবং)। লিনে প্রিমাত বলতে এমন সব স্তন্যপ্রাণীদের বোঝান, যারা হাত-পা দিয়ে জড়িয়ে ধরে গাছে উঠতে পারে। যাদের হাতে পাঁচটি করে আঙুল থাকে। যারা তাদের হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ অন্যান্য আঙুলের ওপর ন্যস্ত করতে পারে। যাদের স্তন বক্ষদেশে নিবদ্ধ। লিনে প্রিমাত বর্গকে তিনটি উপবর্গে ভাগ করেছিলেন। এরা হলো :
চিরপটেরা (ঈযরৎড়ঢ়ঃবৎধ)
কোয়দ্রুমানা (ছঁধফৎঁসধহধ) এবং
বিমানা (ইরসধহধ)
লিনে চিরপটেরা উপবর্গে স্থাপন করেন বাদুড় ও চামচিকাদের। তিনি কেন এটা করেন, তা বোঝা যায় না। কেননা, বাদুড় ও চামচিকারা স্তন্যপায়ী প্রাণী। কিন্তু এদের মধ্যে প্রিমাত বর্গের আর কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। কোয়াদ্রুমানা বলতে তিনি বোঝান বানরের মতো প্রাণীদের। যারা চার হাত পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলে এবং হাতের সাহায্যে কিছু কাজ করতে পারে। লিনে বিমানা বলতে বোঝান মানুষকে। যাদের পায়ের পাতা বানরের মতো নয়। যারা পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে সোজা হয়ে হাঁটে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে নিপুণভাবে কাজ করতে পারে। ডারউইন লিনের শ্রেণীবিভাগকে মেনে নেন। ডারউইন ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে উবংপবহঃ ড়ভ গধহ নামে একটি বই লেখেন। তিনি তার এই বইতে বলেন, মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল কোয়াদ্রুমানার সমপর্যায়ভুক্ত প্রাণী। এ জন্যই অনেকে মনে করেন, ডারউইন বলেছেন মানুষের পূর্ব পুরুষ হলো বানর। কিন্তু কোয়াদ্রুমানা ও বিমানার মাঝামাঝি পর্যায়ের কোনো প্রাণীর প্রস্তুরীভূত দেহাবশেষ (ফসিল) এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তাই বলা চলে না, কোয়াদ্রুমানা থেকে বিমানার উদ্ভব হতে পেরেছে। লিনে বিবর্তনবাদী ছিলেন না। তিনি এ সম্পর্কে কিছু বলেননি।
বিলাতের খ্যাতনামা দার্শনিক হার্বার্ট স্পেনসার (১৮২০-১৯০৩) ছিলেন ডারউইনের সমসাময়িক। চার্লস ডারউইনের মতে, তিনিও ছিলেন বিবর্তনবাদী। বরং বলতে হয় ডারউইনের অনেক আগেই তিনি দিয়েছিলেন প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণা। ডারউইন তার কাছ থেকেই ধার করেন যোগ্যতমের জয়, ঝঁৎারাধষ ড়ভ ঃযব ঋরঃঃবংঃ বচনটি। প্রাকৃতিক নির্বাচন আর যোগ্যতমের জয় সমার্থক। কিন্তু হার্বার্ট স্পেনসার শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেন অজ্ঞেয়বাদী। তিনি বলেন, এমন কিছু প্রশ্ন আছে যার উত্তর মানুষ কোনো দিনই দিতে পারবে না (টহশহড়ধিনষব)। মানুষ এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না, তার জ্ঞান অভাবের কারণে নয়, তার বুদ্ধির সীমাবদ্ধতার জন্য। অজ্ঞেয়বাদীরা আস্তিক নন। আবার নাস্তিকও নন। তারা বলেন, চরম সত্য মানুষ কোনো দিনই অবগত হতে পারবে না। কেননা, কাল নিরবধি, সৃষ্টি অনন্ত। কোনো একটি বিশেষ সৃষ্টির আরম্ভ ও শেষের কথা আমরা ভাবতে পারি। কিন্তু গোটা ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও শেষের কথা ভাবতে পারি না। স্পেনসারের অজ্ঞেয়তাবাদ বিলাতে আস্তিক-নাস্তিকের বিতর্ক কিছুটা স্তিমিত করে দেয়। এ ছাড়া বিলাতের মানুষ মেতে ওঠেন নানাবিধ যন্ত্র আবিষ্কার ও নির্মাণের কাজে। বিলাত এ সময় পরিণত হয় সারা দুনিয়ার কারখানাঘরে। বিলাতে ঘটে প্রথম কলকারখানার বিপ্লব। কেবল তাই নয়, ইংরেজরা হয় বিরাট সাম্রাজ্যের অধিকারী। তাদের চিন্তার একটা বড় বিষয় হয়ে ওঠে সাম্রাজ্য পরিচালনা আর সেই সূত্রে জটিল রাজনীতি। বলা হয়, বিরাট ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না। আবার রক্তও শুকাত না। কেননা, সাম্রাজ্যের কোনো-না-কোনো অংশে লেগে থাকত যুদ্ধ।
গাছপালা নিয়ে ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে কেটেছে আমার জীবনের সুদীর্ঘ সময়। তুলনামূলকভাবে অন্য বিষয়ের চেয়ে গাছপালা সম্বন্ধে আমার জ্ঞানের পরিধি কিছুটা বেশি ও নির্ভরযোগ্য। প্রাণীদের মধ্যে যেমন খাদ্যখাদক সম্বন্ধ থাকতে দেখা যায়, উদ্ভিদদের মধ্যে তা নেই। ডারউইনের জীবনসংগ্রামের ধারণা প্রাণীদের ক্ষেত্রে যত সহজে প্রয়োগ করা যায়, আমার মনে হয় উদ্ভিদের ক্ষেত্রে করা যায় না। ডারউইনের চিন্তাচেতনার সাথে আমি তাই একমত হতে পারিনি। আমি বুঝিনি একই পৃথিবীর পরিবেশে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনপ্রণালীতে এতটা ভিন্নতার উদ্ভব হতে পেরেছে কেন? প্রাণীদের জীবনের প্রধান সমস্যা ক্ষুধা (ঐঁহমবৎ)। কিন্তু উদ্ভিদের জীবনে তা নয়। সবুজ গাছপালা তাদের প্রয়োজনীয় জৈব খাদ্যবস্তু অজৈব বস্তু থেকে সূর্যালোকের সাহায্যে প্রস্তুত করতে পারে; যাকে আমরা বলি ফটোসিনথেসিস। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে চলেছেন কারখানা ফটোসিনথেসিসের অনুরূপ পদ্ধতিতে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় জৈব খাদ্য উৎপাদনের। এটা সম্ভব হলে মানবজীবনে ক্ষুধার সমস্যার অবসান হবে। কিন্তু আমাদের ব্লগাররা যেন মনে করছেন, বাংলাদেশের মানুষ আস্তিক না থেকে যদি নাস্তিক হয়, তাহলে ভরপেট খেতে পারবে। এদের এই চিন্তাকে আমার কাছে বাতুলতা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। আমি অনেকের মতো তাই ব্লগারদের ভাবতে পারছি না বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমনস্ক মানুষ হিসেবে।
আমাদের দেশের অনেক পত্রপত্রিকা পড়ে মনে হচ্ছে, ব্লগাররা হলেন খুবই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমনস্ক ব্যক্তি। আর এদের নেতৃত্বে আমাদের অভাবের সমস্যা মিটবে। কিন্তু আমার তা মনে হয় না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ১৪টি অঙ্গরাজ্যে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি অনুদানে চলে, তাতে জীব বিবর্তনবাদ ও ডারউইনের মতবাদকে এখনো সত্য বলে পড়ানো চলে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ১৪টি অঙ্গরাজ্য যে তাই বলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পিছিয়ে আছে, তা নয়। অর্থনৈতিক দিক থেকেও এদের সমৃদ্ধি অন্যদের তুলনায় যে কম, তা বলা যায় না। ঘটনাটির কথা আমাদের দেশের অনেকেরই জানা নেই। তাই উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
Comments
Post a Comment