মার্কিন নথি: জিয়া ও মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড রুশ-ভারতকে সন্দেহ করেনি যুক্তরাষ্ট্র
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পরে খোন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বাধীন সরকার একটি সম্ভাব্য ভারতীয় হস্তক্ষেপের ব্যাপারে সন্দিহান ছিল। আর সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বিশ্বাস করেছিল। আর ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পরও আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি প্রশাসন ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তখন তা বিশ্বাস করেনি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড টি স্নাইডার ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিলেন, ‘আমরা চট্টগ্রাম বেতার থেকে প্রচারিত মঞ্জুরের ঘোষণা শুনতে পেয়েছি যে তিনি ভারতের সঙ্গে ১৯৭২ সালের মৈত্রী চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘোষণা সত্ত্বেও কিংবা সম্ভবত এই কারণেও আমাদের বলা হয়েছে যে অনেক বাংলাদেশির সন্দেহ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মঞ্জুরের অভ্যুত্থানচেষ্টাকে সমর্থন জুগিয়েছে।’
জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে ইঙ্গিত দেন যে ওই সময় সামরিক বাহিনী ও সরকারের মধ্যে এ রকমই একটা সন্দেহ-সংশয় ছিল। তাঁর ধারণা, জিয়া সেনাবাহিনীতে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। আর ওই দুটি দেশের সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে টানাপোড়েন ছিল। সে কারণেই হয়তো ওই রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব দানা বেঁধেছিল। কিন্তু ওই সময়ে জিয়ার ঘনিষ্ঠ এবং পরিকল্পনা কমিশনের অবৈতনিক উপদেষ্টা ও গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিচালক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এক প্রশ্নের জবাবে গতকাল বলেন, জিয়াউর রহমান কখনো তাঁর সরকারের অস্থিতিশীলতার জন্য রুশ-ভারত বা বাইরের কোনো শক্তির তরফে হুমকির আশঙ্কা করতেন বলে তাঁর জানা নেই।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওই একই তারবার্তায় জানিয়েছিলেন, ‘মন্ত্রিসভা সচিব মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকার বিশ্বাস করে যে তারা মঞ্জুরের অভ্যুত্থানচেষ্টাকে সামলে নিতে পারবে। কিন্তু সরকার মঞ্জুরের প্রতি “বাইরের সমর্থন” নিয়ে উদ্বিগ্ন।’ উল্লেখ্য, এই নথিতে মন্ত্রিসভা সচিবের নামটি নেই। তবে ১৯৭৭ সালের ১৫ জুলাই থেকে ১৯৮২ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত মন্ত্রিসভা সচিব ছিলেন এম কেরামত আলী। ১৯৯১ সালে তিনি বাণিজ্য ও পরে ধর্মমন্ত্রী হন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত এই তারবার্তায় পরিষ্কার করেন যে মন্ত্রিসভা সচিবের ওই মন্তব্য বিচ্ছিন্ন ছিল না। কারণ, তিনি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে ‘এই মন্তব্যে একাধিক সূত্রে পাওয়া একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিবেদনের প্রতিফলন ঘটেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অভ্যুত্থানচেষ্টার পেছনে ভারতীয় ও সোভিয়েতদের কোনো না কোনোভাবে হাত রয়েছে বলে বাংলাদেশ সরকার সন্দেহ করে থাকে।’ এরপরই স্নাইডার মন্তব্য করেন যে ‘আমরা অবশ্য মনে করি যে এই ধারণা সত্য হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।’
এর কারণ হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেনারেল মঞ্জুরকে ভারতবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেন। ওই তারবার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে ভারতীয়দের সীমা লঙ্ঘনের বিষয়ে মঞ্জুরের কঠোর মনোভাব রয়েছে। চট্টগ্রামে তিনি রেডিওতে ঘোষণা দিয়েছেন যে ভারতের সঙ্গে ’৭২-এর মৈত্রী চুক্তি তিনি বাতিল করবেন এবং অ-ইসলামি হিসেবে মদ-জুয়া নিষিদ্ধ করবেন। যদিও তাঁর এই ঘোষণাকে কতিপয় বাংলাদেশি একটি ভারতীয় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মনে করেন। যদিও ঠুনকো অভিযোগ রয়েছে যে তিনি সোভিয়েতপন্থী (মন্ত্রিসভা সচিবও সেই অভিযোগ করেছেন)। তবে বিভিন্ন সূত্র সাক্ষ্য দিচ্ছে যে এই অভিযোগের ভিত্তি নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মঞ্জুরের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করেছেন—এমন দুজন ব্যক্তি আমাদের জানিয়েছেন, মঞ্জুর যুগোস্লাভের ব্যবস্থা সম্পর্কে অনুরাগী ছিলেন। মঞ্জুরের যুগোস্লাভ সফরকালে তাঁর ভেতরে এটা জন্ম নিয়েছিল। এবং যুগোস্লাভ মডেল সম্পর্কে সেই থেকে তাঁর একটা শক্তিশালী সহানুভূতি তৈরি হয়। একজন পশ্চিমা কূটনীতিক তাঁকে একজন সামাজিক গণতন্ত্রী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই সিক্রেট তারবার্তাটির এর পরের কিছু অংশ প্রকাশ করা হয়নি এবং উল্লেখ করা হয়েছে, এতে স্পর্শকাতর গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেনারেল মঞ্জুরের একটি জীবনবৃত্তান্ত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এবং ভারতের মার্কিন দূতাবাসকে অবহিত করেছিলেন। এই ‘সিক্রেট’ তারবার্তায় বলা হয়, ’৭১-এর যুদ্ধের আগে তাঁর চাকরিগত তথ্য সম্পর্কে সামান্যই জানা যায়। ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে লে. কর্নেল ছিলেন, আগস্টে কর্নেল, ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে নয়াদিল্লিতে সামরিক অ্যাটাশে হিসেবে যোগ দেন। এবং মুজিব হত্যাকাণ্ডের আগে ১৯৭৫ সালের জুনে ব্রিগেডিয়ার হিসেবে পদোন্নতি পান। জিয়া তাঁকে চিফ অব জেনারেল স্টাফ করেন। ১৯৭৭ সালের আগস্টে তাঁকে মেজর জেনারেল এবং নভেম্বরে চট্টগ্রামে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক হিসেবে বদলি করা হয়। এই সময়ে সেখানে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহ দমন কার্যক্রমে নিয়োজিত ছিলেন। ২৯ মে ১৯৮১ মঞ্জুরকে মিরপুর স্টাফ কলেজে বদলি করা হয়েছিল।
মার্কিন দূতাবাসের মূল্যায়নপত্রে বলা হয়, ‘১৯৭৫ সালে জিয়া ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তিনি জিয়ার অন্যতম ঘনিষ্ঠ ও সবচেয়ে বিশ্বস্ত উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে ওই সময় মঞ্জুর জেনারেল জিয়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মঞ্জুরকে প্রায়ই একজন উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তা এবং ক্ষমতার প্রশ্নে জিয়াউর রহমানের একজন শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হয়েছে। এটা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে ঢাকায় ক্ষমতার আসন থেকে অপসারণ করতেই জিয়া তাঁকে চট্টগ্রামে বদলি করেছিলেন। আমরা অনুমান করি যে একই আশঙ্কা থেকে জিয়া মঞ্জুরকে মিরপুর স্টাফ কলেজে পুনরায় বদলি করেছিলেন। এই অবস্থানটি থেকে সৈন্য নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই। যদিও চার বছরে কর্মরত থাকার পরে চট্টগ্রাম থেকে বদলির ঘটনা অস্বাভাবিক নয়।’
মার্কিন দূতাবাসের ওই তারবার্তায় আরও উল্লেখ রয়েছে যে ‘মঞ্জুরের রাজনৈতিক দীক্ষা অস্পষ্ট। তাঁকে ঘিরে প্রধানত যে গুজব রটে থাকে, তাতে তাঁকে একজন “চীনা বামপন্থী” হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। যদিও মঞ্জুর আমেরিকানদের প্রতি অত্যন্ত বন্ধুপরায়ণ ছিলেন। দিল্লিতে থাকাকালে আমেরিকানদের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।’ উল্লেখ্য, জেনারেল মঞ্জুরের চীনা ঝোঁক সম্পর্কে জানতে চাইলে জেনারেল মাহবুবুর রহমান, ১৯৮১-র অভ্যুত্থানকালে যিনি ছিলেন চীনের বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক অ্যাটাশে, গতকাল আবেগের সঙ্গে বলেন, ‘এটা একদম খাঁটি। একাত্তরে আমি ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা ভাষা পড়তে শুরু করেছিলাম, কিন্তু শেষ হয়নি। তিনি (মঞ্জুর) তখন চিফ অব জেনারেল স্টাফ। ১৯৭৬ সালের গোড়ায় একদিন তাঁর ফোন পেলাম। তিনিই আমাকে চীনা ভাষা
শিক্ষা শেষ করতে চীন পাঠান।’ তিনি মঞ্জুরকে চীনের সঙ্গে জিয়ার সম্পর্ক দৃঢ় করার প্রয়াসের শক্তিশালী সমর্থক হিসেবে বর্ণনা করেন।
মার্কিন দূতাবাসের ওই তারবার্তায় বলা হয়েছে, ‘চট্টগ্রামে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনাকালে জেনারেল মঞ্জুরকে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি তাঁর পরিশীলিত মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেই দেখা গেছে।’ কিন্তু কবে তাঁদের এই সাক্ষাৎ ঘটেছে, তার উল্লেখ নেই। স্নাইডার বলেন, ‘তঁার (মঞ্জুর) দিল্লি অবস্থানকালে তিনি এই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন যে মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ, মতবাদ ও সাজসরঞ্জাম উৎকৃষ্ট। মঞ্জুরের বরাতে এটাও বলা হয়েছে যে তিনি সোভিয়েত উপদেষ্টাদের সম্পর্কে সমালোচনামূলক এবং বাংলাদেশে সোভিয়েতদের তৎপরতাকেও সুনজরে দেখেন না। বাংলাদেশে সোভিয়েতরা “বাড়াবাড়ি” (মঞ্জুরের নিজের কথায় “ওভার বিয়ারিং”) এবং “সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা” করে বলেও তিনি বর্ণনা করেন। দিল্লিতে থাকাকালে মঞ্জুর বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাব সম্পর্কে অত্যন্ত সন্দিগ্ধ ও অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ওই মনোভাব সত্ত্বেও কতিপয় সূত্র তাঁকে সোভিয়েতপন্থী ও ভারতপন্থী হিসেবেই বর্ণনা করেছে। তাঁর রাজনৈতিক ঝোঁক সম্পর্কে যদিও দ্ব্যর্থক এবং স্ববিরোধী খবরাখবর মিলেছে, কিন্তু সব সূত্রই নিশ্চিত করেছে যে তিনি একজন ঐকান্তিক জাতীয়তাবাদী, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে যাঁর জীবন উৎসর্গীকৃত।’
স্নাইডার ওই তারবার্তার উপসংহার টানেন এই মন্তব্য করে যে ‘রাষ্ট্রদূত স্নাইডার চট্টগ্রামে মঞ্জুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং তাঁকে বুদ্ধিদীপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে লক্ষ করেন। বহু দিক থেকে জিয়ার চেয়ে তিনি পরিশীলিত ও বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন। যদিও তাঁর ঔদ্ধত্য সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি, কিন্তু তিনি একই সঙ্গে তাঁর সেনাদের মধ্যে বেশ ক্যারিশম্যাটিক ও জনপ্রিয় ছিলেন। বাংলা ও উর্দু ছাড়াও তিনি অনর্গল ইংরেজি বলতেন।’
আগামীকাল: ১৫ দিন আগেই অভ্যুত্থানের আশঙ্কা
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে ইঙ্গিত দেন যে ওই সময় সামরিক বাহিনী ও সরকারের মধ্যে এ রকমই একটা সন্দেহ-সংশয় ছিল। তাঁর ধারণা, জিয়া সেনাবাহিনীতে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। আর ওই দুটি দেশের সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে টানাপোড়েন ছিল। সে কারণেই হয়তো ওই রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব দানা বেঁধেছিল। কিন্তু ওই সময়ে জিয়ার ঘনিষ্ঠ এবং পরিকল্পনা কমিশনের অবৈতনিক উপদেষ্টা ও গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিচালক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এক প্রশ্নের জবাবে গতকাল বলেন, জিয়াউর রহমান কখনো তাঁর সরকারের অস্থিতিশীলতার জন্য রুশ-ভারত বা বাইরের কোনো শক্তির তরফে হুমকির আশঙ্কা করতেন বলে তাঁর জানা নেই।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওই একই তারবার্তায় জানিয়েছিলেন, ‘মন্ত্রিসভা সচিব মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকার বিশ্বাস করে যে তারা মঞ্জুরের অভ্যুত্থানচেষ্টাকে সামলে নিতে পারবে। কিন্তু সরকার মঞ্জুরের প্রতি “বাইরের সমর্থন” নিয়ে উদ্বিগ্ন।’ উল্লেখ্য, এই নথিতে মন্ত্রিসভা সচিবের নামটি নেই। তবে ১৯৭৭ সালের ১৫ জুলাই থেকে ১৯৮২ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত মন্ত্রিসভা সচিব ছিলেন এম কেরামত আলী। ১৯৯১ সালে তিনি বাণিজ্য ও পরে ধর্মমন্ত্রী হন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত এই তারবার্তায় পরিষ্কার করেন যে মন্ত্রিসভা সচিবের ওই মন্তব্য বিচ্ছিন্ন ছিল না। কারণ, তিনি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে ‘এই মন্তব্যে একাধিক সূত্রে পাওয়া একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিবেদনের প্রতিফলন ঘটেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অভ্যুত্থানচেষ্টার পেছনে ভারতীয় ও সোভিয়েতদের কোনো না কোনোভাবে হাত রয়েছে বলে বাংলাদেশ সরকার সন্দেহ করে থাকে।’ এরপরই স্নাইডার মন্তব্য করেন যে ‘আমরা অবশ্য মনে করি যে এই ধারণা সত্য হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।’
এর কারণ হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেনারেল মঞ্জুরকে ভারতবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেন। ওই তারবার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে ভারতীয়দের সীমা লঙ্ঘনের বিষয়ে মঞ্জুরের কঠোর মনোভাব রয়েছে। চট্টগ্রামে তিনি রেডিওতে ঘোষণা দিয়েছেন যে ভারতের সঙ্গে ’৭২-এর মৈত্রী চুক্তি তিনি বাতিল করবেন এবং অ-ইসলামি হিসেবে মদ-জুয়া নিষিদ্ধ করবেন। যদিও তাঁর এই ঘোষণাকে কতিপয় বাংলাদেশি একটি ভারতীয় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মনে করেন। যদিও ঠুনকো অভিযোগ রয়েছে যে তিনি সোভিয়েতপন্থী (মন্ত্রিসভা সচিবও সেই অভিযোগ করেছেন)। তবে বিভিন্ন সূত্র সাক্ষ্য দিচ্ছে যে এই অভিযোগের ভিত্তি নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মঞ্জুরের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করেছেন—এমন দুজন ব্যক্তি আমাদের জানিয়েছেন, মঞ্জুর যুগোস্লাভের ব্যবস্থা সম্পর্কে অনুরাগী ছিলেন। মঞ্জুরের যুগোস্লাভ সফরকালে তাঁর ভেতরে এটা জন্ম নিয়েছিল। এবং যুগোস্লাভ মডেল সম্পর্কে সেই থেকে তাঁর একটা শক্তিশালী সহানুভূতি তৈরি হয়। একজন পশ্চিমা কূটনীতিক তাঁকে একজন সামাজিক গণতন্ত্রী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই সিক্রেট তারবার্তাটির এর পরের কিছু অংশ প্রকাশ করা হয়নি এবং উল্লেখ করা হয়েছে, এতে স্পর্শকাতর গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেনারেল মঞ্জুরের একটি জীবনবৃত্তান্ত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এবং ভারতের মার্কিন দূতাবাসকে অবহিত করেছিলেন। এই ‘সিক্রেট’ তারবার্তায় বলা হয়, ’৭১-এর যুদ্ধের আগে তাঁর চাকরিগত তথ্য সম্পর্কে সামান্যই জানা যায়। ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে লে. কর্নেল ছিলেন, আগস্টে কর্নেল, ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে নয়াদিল্লিতে সামরিক অ্যাটাশে হিসেবে যোগ দেন। এবং মুজিব হত্যাকাণ্ডের আগে ১৯৭৫ সালের জুনে ব্রিগেডিয়ার হিসেবে পদোন্নতি পান। জিয়া তাঁকে চিফ অব জেনারেল স্টাফ করেন। ১৯৭৭ সালের আগস্টে তাঁকে মেজর জেনারেল এবং নভেম্বরে চট্টগ্রামে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক হিসেবে বদলি করা হয়। এই সময়ে সেখানে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহ দমন কার্যক্রমে নিয়োজিত ছিলেন। ২৯ মে ১৯৮১ মঞ্জুরকে মিরপুর স্টাফ কলেজে বদলি করা হয়েছিল।
মার্কিন দূতাবাসের মূল্যায়নপত্রে বলা হয়, ‘১৯৭৫ সালে জিয়া ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তিনি জিয়ার অন্যতম ঘনিষ্ঠ ও সবচেয়ে বিশ্বস্ত উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে ওই সময় মঞ্জুর জেনারেল জিয়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মঞ্জুরকে প্রায়ই একজন উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তা এবং ক্ষমতার প্রশ্নে জিয়াউর রহমানের একজন শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হয়েছে। এটা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে ঢাকায় ক্ষমতার আসন থেকে অপসারণ করতেই জিয়া তাঁকে চট্টগ্রামে বদলি করেছিলেন। আমরা অনুমান করি যে একই আশঙ্কা থেকে জিয়া মঞ্জুরকে মিরপুর স্টাফ কলেজে পুনরায় বদলি করেছিলেন। এই অবস্থানটি থেকে সৈন্য নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই। যদিও চার বছরে কর্মরত থাকার পরে চট্টগ্রাম থেকে বদলির ঘটনা অস্বাভাবিক নয়।’
মার্কিন দূতাবাসের ওই তারবার্তায় আরও উল্লেখ রয়েছে যে ‘মঞ্জুরের রাজনৈতিক দীক্ষা অস্পষ্ট। তাঁকে ঘিরে প্রধানত যে গুজব রটে থাকে, তাতে তাঁকে একজন “চীনা বামপন্থী” হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। যদিও মঞ্জুর আমেরিকানদের প্রতি অত্যন্ত বন্ধুপরায়ণ ছিলেন। দিল্লিতে থাকাকালে আমেরিকানদের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।’ উল্লেখ্য, জেনারেল মঞ্জুরের চীনা ঝোঁক সম্পর্কে জানতে চাইলে জেনারেল মাহবুবুর রহমান, ১৯৮১-র অভ্যুত্থানকালে যিনি ছিলেন চীনের বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক অ্যাটাশে, গতকাল আবেগের সঙ্গে বলেন, ‘এটা একদম খাঁটি। একাত্তরে আমি ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা ভাষা পড়তে শুরু করেছিলাম, কিন্তু শেষ হয়নি। তিনি (মঞ্জুর) তখন চিফ অব জেনারেল স্টাফ। ১৯৭৬ সালের গোড়ায় একদিন তাঁর ফোন পেলাম। তিনিই আমাকে চীনা ভাষা
শিক্ষা শেষ করতে চীন পাঠান।’ তিনি মঞ্জুরকে চীনের সঙ্গে জিয়ার সম্পর্ক দৃঢ় করার প্রয়াসের শক্তিশালী সমর্থক হিসেবে বর্ণনা করেন।
মার্কিন দূতাবাসের ওই তারবার্তায় বলা হয়েছে, ‘চট্টগ্রামে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনাকালে জেনারেল মঞ্জুরকে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি তাঁর পরিশীলিত মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেই দেখা গেছে।’ কিন্তু কবে তাঁদের এই সাক্ষাৎ ঘটেছে, তার উল্লেখ নেই। স্নাইডার বলেন, ‘তঁার (মঞ্জুর) দিল্লি অবস্থানকালে তিনি এই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন যে মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ, মতবাদ ও সাজসরঞ্জাম উৎকৃষ্ট। মঞ্জুরের বরাতে এটাও বলা হয়েছে যে তিনি সোভিয়েত উপদেষ্টাদের সম্পর্কে সমালোচনামূলক এবং বাংলাদেশে সোভিয়েতদের তৎপরতাকেও সুনজরে দেখেন না। বাংলাদেশে সোভিয়েতরা “বাড়াবাড়ি” (মঞ্জুরের নিজের কথায় “ওভার বিয়ারিং”) এবং “সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা” করে বলেও তিনি বর্ণনা করেন। দিল্লিতে থাকাকালে মঞ্জুর বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাব সম্পর্কে অত্যন্ত সন্দিগ্ধ ও অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ওই মনোভাব সত্ত্বেও কতিপয় সূত্র তাঁকে সোভিয়েতপন্থী ও ভারতপন্থী হিসেবেই বর্ণনা করেছে। তাঁর রাজনৈতিক ঝোঁক সম্পর্কে যদিও দ্ব্যর্থক এবং স্ববিরোধী খবরাখবর মিলেছে, কিন্তু সব সূত্রই নিশ্চিত করেছে যে তিনি একজন ঐকান্তিক জাতীয়তাবাদী, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে যাঁর জীবন উৎসর্গীকৃত।’
স্নাইডার ওই তারবার্তার উপসংহার টানেন এই মন্তব্য করে যে ‘রাষ্ট্রদূত স্নাইডার চট্টগ্রামে মঞ্জুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং তাঁকে বুদ্ধিদীপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে লক্ষ করেন। বহু দিক থেকে জিয়ার চেয়ে তিনি পরিশীলিত ও বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন। যদিও তাঁর ঔদ্ধত্য সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি, কিন্তু তিনি একই সঙ্গে তাঁর সেনাদের মধ্যে বেশ ক্যারিশম্যাটিক ও জনপ্রিয় ছিলেন। বাংলা ও উর্দু ছাড়াও তিনি অনর্গল ইংরেজি বলতেন।’
আগামীকাল: ১৫ দিন আগেই অভ্যুত্থানের আশঙ্কা
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
Comments
Post a Comment