অকপটে জানিয়ে দিয়েছিলেন- তিনি বিরোধী দলের মাজা বা কোমর ভেঙে দিয়েছেন। সরকারপ্রধানের এই বক্তব্য এবং ভোটের এক দিন আগের আক্রমণাত্মক বক্তব্য জনগণ আমলে নিয়েছে। তাই ধরেই নিয়েছিল কী হতে যাচ্ছে।

তিন সিটিতে ভোটারচিত্র ছিল দৃষ্টিগ্রাহ্য, সেটা ছিল চরম মাত্রায় বাড়াবাড়ির। ভোট দেয়ার পরিবেশ সবখানে এক রকম ছিল না। উৎসব ছিল না কোথাও। ঠাণ্ডা মাথায় ভোট ডাকাতির দৃশ্য দেখতে হলো অনেককে। ভোট দেয়ার পর তা গোনা নিয়ে আগ্রহ ছিল না কারো। ভোটারমনের চিন্তার সঠিক প্রতিফলন বারবার হোঁচট খেয়েছে। কিছু বাড়াবাড়ি নাগরিকদের ভাবনাকে সর্বত্র আচ্ছন্ন করে রেখেছে। প্রচারণায় বৈষম্যের অভিযোগ আমলে নেয়া হয়নি। কোনো নাগরিক নিজেকে নিরাপদ ভাবেনি। জমায়েত হলেই পুলিশ তাড়া করেছে। জমায়েত শেষে ধরে নিয়ে গেছে কাউকে কাউকে। কেউ পুলিশ প্রটেকশনে, কেউ পুলিশের তাড়া খেয়েছে; পুলিশ নিরাপদ ভোটডাকাতি পাহারা দিয়েছে মাত্র।

এ সরকার স্থানীয় সরকারব্যবস্থা জোরদার করতে কখনো চায়নি। মেয়াদোত্তীর্ণ সিটি করপোরেশন নিয়ে তাদের হেঁয়ালিপনা সবার নজরে আছে। উপজেলায় কী কাণ্ড ঘটানো হয়েছিল, কেউ এখনো ভুলে যায়নি। জেলা পরিষদগুলোতে দলের স্থানীয় নেতাদের পুনর্বাসনের জন্য সব ব্যবস্থা করা হলো। নির্বাচনের নাম পর্যন্ত নিলো না। গাজীপুর, সিলেট ও রাজশাহীতে নির্বাচিত বিরোধী দলসমর্থিত মেয়রদের ফৌজদারি মামলায় জড়িয়ে পদচ্যুত করার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে। প্রশাসক দিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন চালানো হলো। সাদেক হোসেন খোকাকে সহ্য করতে না পেরে ঢাকা সিটিকে ভাগ করা হলো। জনগণ দাবি জানিয়েও ভোটাধিকার আদায় করতে পারেনি। এখন জাতীয় নির্বাচন দাবি করেও জনগণ হতাশ। তিন সিটিতে নির্বাচন নাগরিক স্বার্থে নয়, ক্ষমতার পাটাতন শক্ত রাখতে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রাজধানীর দখলি স্বত্ব পাওয়ার আশায় সিটিতে ভোটের ঝুঁকি নিয়েছে সরকার। তারপরও অসমতল মাঠ, আব্বাসের অনুপস্থিতি, মাহির ওপর হামলা, মনজুরের অফিস তছনছ, তাবিথকে কোণঠাসা করে রাখা জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। এবারো সরকার হেরে গেল। হেরে গেল গণতন্ত্র।

জনগণ মাথায় রেখেছে বিরোধী দলের মাজা বা কোমর ভেঙে দিয়ে সরকার তিন সিটিতে নির্বাচন দিয়ে দৃষ্টি ফেরাতে সচেষ্ট। বিরোধী দলকে অপ্রস্তুত রেখে হামলা-মামলা, অপহরণ, গ্রেফতার ও গণতান্ত্রিক সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সিটি নির্বাচনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অপ্রস্তুত বিরোধী দল ভালো করে একটি নির্বাচনী ক্যাম্প সাজাতে পারেনি। তারপরও জনগণের ওপর ভরসা করে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার প্রস্তুতি নিয়ে ভোটের হাটে উপস্থিত থাকতে চেয়েছে। কমিশনার প্রার্থী সেভাবে মাঠে নামতে পারেনি বেশির ভাগ জায়গায়। তারপরও বিরোধী দলকে চ্যালেঞ্জ নিতে দেখে সরকার বিপাকে পড়ে যায়। সরকারের ধারণা ছিল, বিরোধী দল সিটি নির্বাচন শুরুতেই বর্জন করবে। সরকার একতরফা নির্বাচনে তিন সিটিতে জায়গা করে নিতে চেয়েছে। জনগণ ভুলে থাকেনি বিরোধী দলসমর্থিত সিলেট, গাজীপুর ও রাজশাহীর মেয়রদের ভাগ্য বিপর্যয় কিভাবে ঘটানো হলো। তাই আশা করেছে- ভরসা করেনি।

সরকার পদে পদে প্রতিপক্ষের সামনে বাধার দেয়াল সৃষ্টি করেছে। বিরোধী দল যাতে যোগ্য প্রার্থী দিতে না পারে, সেই পরিকল্পনা আগেই নেয়া ছিল। ড. তুহিন মালিক ও মাহমুদুর রহমান মান্না অনুপস্থিত থাকতে বাধ্য হলেন। বিএনপির সম্ভাব্য বিকল্প যারা প্রার্থী হতে পারতেন, তাদের মাথার ওপর হুলিয়া।

যারা রাজনীতিতে জনমতের ভীতিতে বসবাস করে, তাদের নির্বাচনে কারসাজি করার প্রক্রিয়া শুরু হয় ভুয়া ভোটার করার মাধ্যমে। ভুয়া ও ভুতুড়ে ভোটাররা সরকারি আনুকূল্যে টোকাই হয়ে টাকার বিনিময়ে সিল মারে। জাল ভোটের হাট বসায়। যে নির্বাচন কমিশন আড়াই থেকে পাঁচ শতাংশ ভোটকে ৪০ শতাংশ দেখাতে পারে, অর্থহীন ও ভোটারবিহীন জাতীয় নির্বাচনকে বৈধতা দিয়ে কৃতার্থ হয়, যারা সাংবিধানিক প্রদত্ত ক্ষমতা দেখানোর মতো শক্তিটিও দেখাতে পারে না, তাদের কাছে পোলিং ও প্রিজাইডিং অফিসাররা নিরাপত্তা চাইতেও লজ্জা পেয়েছেন! নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে সরকার অনুগত সবাইকে। স্বভাবতই ভোটকেন্দ্রে ক্ষমতার প্রভাব ও প্রদর্শনেচ্ছা কারো দৃষ্টি এড়ায়নি। ক্ষমতা যার, পুলিশ তার। ভোটকেন্দ্রও তার। তাই ডাকাতের মতো হামলে পড়ে সব আশা ডাকাতি করে নিয়েছে। বিরোধী দল কিছু কেন্দ্রে এজেন্ট দিয়েও টেকাতে পারেনি। বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দৃশ্যত নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করেছে। অনেক কেন্দ্রের ভেতরে অসহায় ভোটারের টুঁ-শব্দটি করার সুযোগ ছিল না। ভোট চুরি নয়, ভীতি সৃষ্টি করে ভোটার উপস্থিতি কমাতে প্রথমবেলায় সরকারপন্থীরা সচেষ্ট ছিল। অনেক কেন্দ্রে নৈতিক শক্তির মৃত্যু ঘটেছে ভোটের আগের রাতে ও ভোটের দিনের প্রথম প্রহরে। ভীতির কবলে পড়েছেন বিরোধীদলীয় প্রার্থী-এজেন্ট এবং মিডিয়া কর্মীরা।

 ভোটের সংখ্যাতত্ত্ব অনুযায়ী, বিএনপি জোট স্বভাবতই ১০ শতাংশ বেশি ভোট পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার মতো নির্বিঘœ পরিস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ অনেক কেন্দ্রে ছিল না। বিরোধী জোট ভোটকেন্দ্র পাহারা দেয়ার মতো অবস্থায় ছিল না। পুলিশ তা হতেও দেয়নি। পুলিশের ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডাররা দাপটের সাথে সর্বত্র ক্ষমতার মহড়া দেখিয়েছে। আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে কেউ প্রতিবাদী হতে চায়নি। বিরোধী দলের সামনে পুলিশভীতি, গ্রেফতার আতঙ্ক, মামলায় জড়িয়ে যাওয়ার ভয় দিনভর তাড়া করেছে। পুলিশ এই সুযোগে পুরনো মামলার অজ্ঞাত তালিকাকে পূরণ করতে চেয়েছে। পেশাদারিত্ব বিকিয়ে দিয়েও কিছু দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক সত্যটা বলতে চেয়েছে, পারেনি। মিডিয়া থেকেছে অন্ধকারে। ভীতি থেকে তারাও মুক্ত ছিল না।

সরকারের ভরসা ছিল শক্তির জোর। বিরোধী দলের ভরসা পরিবর্তনকামী মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের ইচ্ছা। জনগণ আবার হোঁচট খেলো। মৃত্যুযন্ত্রণায় গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার আর্তনাদ করল।

এবার কার্যত নেগেটিভ ভোটের প্রাধান্য ছিল। মানুষ সব ক্ষোভ-দুঃখ, ভোট ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের জবাব ব্যালটের মাধ্যমে দিতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার ক্ষোভ প্রকাশ করতে চেয়েও বঞ্চিত হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানানোর দায় পূরণের জন্য অনেকেই ভোট দিতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি।

সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এক ধরনের সরকারি ক্যাডার সব সীমা অতিক্রম করেছে। খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ আগেই ঘটেছিল। এমন ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা ছিল, যাতে ভোট হয়। বিরোধীদল দাঁড়াতেও না পারে। ভোটারসংখ্যা কমে যায়। জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি না, এমন একটি শঙ্কা নিয়েও ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখেছে ভোট হয়ে গেছে। আবার অনেক কেন্দ্রে হাহাকার মিডিয়ার সৌজন্যে অনেকেই দেখেছেন। পূর্বাপর ইসির ধূম্রজাল ও রহস্যঘেরা আচরণের কারণে একটি উৎসবমুখর ভোট হতে পারল না। সরকারের মিথ্যা প্রচারণা আবারো হেরে গেল। জিতে গেল জনগণ ও বিরোধী দল।

তারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারল। সরকারবিরোধীরা জনগণের বিবেক স্পর্শ করতে পারল আরো একবার। মৃত্যুপথযাত্রী গণতন্ত্রের জন্য এই আশাবাদটুকুই শুধু টিকে রইল। এটাও নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হলো, দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয়-জাতীয় কোনো নির্বাচনই নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের ভাষা অন্যায্য ক্ষমতার কাছে অকার্যকরই থেকে যায়। 
- See more at: http://dev.dailynayadiganta.com/detail/news/18863#sthash.P9qWJj9K.dpuf

Comments