রাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হলো
এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে প্রথমেই যা বলার কথা তা হচ্ছে এই নির্বাচনের ঘোষণা হঠাৎ করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের অন্য রকম পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু পুলিশের আইজিপির কথায় নির্বাচন এগিয়ে আনা হয়েছে। ফলে এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে অগোছালো মনে হয়েছে। তারা ঠিক প্রস্তুত ছিল বলে মনে হয়নি। আবার এই নির্বাচন নিয়ে র্যা ব-পুলিশসহ অনেকেই নানা কথা বলেছে। এর ফলে কমিশনের পক্ষে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ায় নির্বাচনটি শুরু থেকেই রাজনৈতিক রূপ পেয়ে যায়। মন্ত্রীরাও নির্বাচনী কাজে অংশ নিয়েছেন। ২০-দলীয় জোট নির্বাচনে প্রার্থী সমর্থন দেবে কি না, তা নিয়ে প্রথমে সন্দেহ থাকলেও তারাও একই কায়দায় নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে। নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল শুরুতেই এসব নিয়ন্ত্রণ করা। তারপর আমরা দেখেছি, আচরণবিধি হরহামেশা ভঙ্গ করা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া গাড়িবহর নিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন, সে ব্যাপারে কমিশন কিছু বলেনি। আবার তাঁর ওপর তিন-চারবার হামলা করা হলো, তাতেও কমিশনের টনক নড়েনি। অথচ কমিশন বলেছে, তাদের কাছে লিখিত অভিযোগ আসেনি বলে তারা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, আজকের যুগে যেখানে গণমাধ্যমের সরব উপস্থিতি রয়েছে, সেখানে তাদের লিখিত অভিযোগ পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার তো দরকার ছিল না। ফুটেজ তো ছিল, তারা চাইলে পদক্ষেপ নিতে পারত। কমিশন এমন আমলাতান্ত্রিক হলে তো চলবে না।
সার্বিকভাবে বলা যায়, কমিশনের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা যথাযথ ছিল না। না, আমি শুধু লজিস্টিক সরবরাহের কথা বলছি না, নির্বাচনের আইনি ব্যবস্থাপনার কথা বলছি। তারপর পুলিশের ওপরও কমিশনের নিয়ন্ত্রণ ছিল বলে মনে হয় না। সরকারি দল বলল, তাদের সাংসদেরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নির্বাচনী প্রচারণা সমন্বয় করবেন। কমিশন বলল, তাদের কিছু করার নেই, কারণ সাংসদেরা ঢাকার বাসিন্দা। কিন্তু তারপর তো আর কিছু হলো না। সাংসদেরা সেই কাজ করেছেন। সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়েও ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছিল। বলা হলো, প্রয়োজন হলে তাদের নামানো হবে। কিন্তু প্রয়োজন তো ছিল, তাদের নামানো হলো না কেন? সব মিলিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ সুখকর ছিল না। তবু আশা ছিল, সবাই যেহেতু নির্বাচন করছে, ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।
সকালে ভোট দিতে গিয়ে আমি নিজেই ধাক্কা খেয়েছি। কেন্দ্রে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম, গণমাধ্যমকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আবার ঢুকতে দেওয়া হলেও ক্যামেরা নিয়ে ঢোকা যাবে না। এসব দেখেই মনে সন্দেহ সৃষ্টি হলো। গণমাধ্যম যেখানে কমিশনের চোখ ও কান হিসেবে কাজ করে, সেখানে তাদের কেন ঢুকতে দেওয়া হবে না, তা মোটেই বোধগম্য নয়। তারপর পুলিশ প্রশাসনও সাংবাদিকদের কেন্দ্রে প্রবেশ নিয়ে নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অথচ নির্বাচন কমিশন সাংবাদিকদের যে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড সরবরাহ করে, তাতে স্পষ্ট বলা থাকে, তাঁরা কী করতে পারবেন আর কী করতে পারবেন না। সেখানে বলা থাকে, তাঁরা ভোট প্রদানের গোপন কক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না। অর্থাৎ পুলিশ সুস্পষ্টভাবেই নির্বাচন কমিশনের বিধিবিধান ভঙ্গ করল। এরপর আমরা দেখলাম, বুথ দখল, মারপিট, গোলাগুলি—সবই হলো। এমনকি সুইডেনের রাষ্ট্রদূতকে ধাওয়া খেয়ে একটি কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলো, সত্যিই খুব দুঃখজনক। গণমাধ্যম প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করায় এসব করা সহজ হয়েছে।
কথা হচ্ছে, অতীতে কেউ এভাবে চার ঘণ্টা নির্বাচন হওয়ার পর নির্বাচন বর্জন করেনি। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা এখান থেকেই বোঝা যায়। মোদ্দা কথা, নির্বাচন কমিশন সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি, সবাইকে আস্থায় আনতে পারেনি। ফলে ভোটারদের উপস্থিতিও কম ছিল। তাঁরাও আসলে কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। আস্থা আগেও যে খুব বেশি ছিল তা নয়, আর এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই আস্থাহীনতা আরও পাকাপোক্ত হলো। নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর এভাবে আস্থা হারিয়ে ফেলা খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। মানুষের মতামত প্রকাশের সব পথ বন্ধ হয়ে গেলে তার ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। নদীর এক দিকে বাঁধ দিলে যেমন অন্য দিক দিয়ে নদী ভাঙে, ঠিক সে রকম। এসব স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্য। এটা সরকারের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
আমরা ভেবেছিলাম, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংকটের বদ্ধঘরে নতুন জানালা খুলে যাবে। সেই জানালা দিয়ে যে বাতাস আসবে, তাতে গুমোট ভাব কেটে যাবে। আমরা স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারব। কিন্তু এমনটা আর হলো না। আমরা জানি না, এরপর কী হবে। আমরা কি আবারও সহিংসতা দেখব? তবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা রাজনীতিতে হয়তো নতুন মেরুকরণ দেখব। কিন্তু যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেল। ক্ষতি হলো নির্বাচন কমিশনের, ক্ষতি হলো সরকারের, ক্ষতি হলো রাজনীতির, সর্বোপরি ক্ষতি হলো রাষ্ট্রের। সেই ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ীই হবে বলে আশঙ্কা। তবু এই দুর্দিনে আশাই আমাদের একমাত্র ভেলা। আমাদের নাগরিকদের গভীরভাবে ভাবতে হবে, কীভাবে এই দুর্দশা থেকে বেরোনো যায়।
এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
প্রধানমন্ত্রী মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ায় নির্বাচনটি শুরু থেকেই রাজনৈতিক রূপ পেয়ে যায়। মন্ত্রীরাও নির্বাচনী কাজে অংশ নিয়েছেন। ২০-দলীয় জোট নির্বাচনে প্রার্থী সমর্থন দেবে কি না, তা নিয়ে প্রথমে সন্দেহ থাকলেও তারাও একই কায়দায় নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে। নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল শুরুতেই এসব নিয়ন্ত্রণ করা। তারপর আমরা দেখেছি, আচরণবিধি হরহামেশা ভঙ্গ করা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া গাড়িবহর নিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন, সে ব্যাপারে কমিশন কিছু বলেনি। আবার তাঁর ওপর তিন-চারবার হামলা করা হলো, তাতেও কমিশনের টনক নড়েনি। অথচ কমিশন বলেছে, তাদের কাছে লিখিত অভিযোগ আসেনি বলে তারা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, আজকের যুগে যেখানে গণমাধ্যমের সরব উপস্থিতি রয়েছে, সেখানে তাদের লিখিত অভিযোগ পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার তো দরকার ছিল না। ফুটেজ তো ছিল, তারা চাইলে পদক্ষেপ নিতে পারত। কমিশন এমন আমলাতান্ত্রিক হলে তো চলবে না।
সার্বিকভাবে বলা যায়, কমিশনের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা যথাযথ ছিল না। না, আমি শুধু লজিস্টিক সরবরাহের কথা বলছি না, নির্বাচনের আইনি ব্যবস্থাপনার কথা বলছি। তারপর পুলিশের ওপরও কমিশনের নিয়ন্ত্রণ ছিল বলে মনে হয় না। সরকারি দল বলল, তাদের সাংসদেরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নির্বাচনী প্রচারণা সমন্বয় করবেন। কমিশন বলল, তাদের কিছু করার নেই, কারণ সাংসদেরা ঢাকার বাসিন্দা। কিন্তু তারপর তো আর কিছু হলো না। সাংসদেরা সেই কাজ করেছেন। সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়েও ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছিল। বলা হলো, প্রয়োজন হলে তাদের নামানো হবে। কিন্তু প্রয়োজন তো ছিল, তাদের নামানো হলো না কেন? সব মিলিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ সুখকর ছিল না। তবু আশা ছিল, সবাই যেহেতু নির্বাচন করছে, ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।
সকালে ভোট দিতে গিয়ে আমি নিজেই ধাক্কা খেয়েছি। কেন্দ্রে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম, গণমাধ্যমকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আবার ঢুকতে দেওয়া হলেও ক্যামেরা নিয়ে ঢোকা যাবে না। এসব দেখেই মনে সন্দেহ সৃষ্টি হলো। গণমাধ্যম যেখানে কমিশনের চোখ ও কান হিসেবে কাজ করে, সেখানে তাদের কেন ঢুকতে দেওয়া হবে না, তা মোটেই বোধগম্য নয়। তারপর পুলিশ প্রশাসনও সাংবাদিকদের কেন্দ্রে প্রবেশ নিয়ে নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অথচ নির্বাচন কমিশন সাংবাদিকদের যে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড সরবরাহ করে, তাতে স্পষ্ট বলা থাকে, তাঁরা কী করতে পারবেন আর কী করতে পারবেন না। সেখানে বলা থাকে, তাঁরা ভোট প্রদানের গোপন কক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না। অর্থাৎ পুলিশ সুস্পষ্টভাবেই নির্বাচন কমিশনের বিধিবিধান ভঙ্গ করল। এরপর আমরা দেখলাম, বুথ দখল, মারপিট, গোলাগুলি—সবই হলো। এমনকি সুইডেনের রাষ্ট্রদূতকে ধাওয়া খেয়ে একটি কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলো, সত্যিই খুব দুঃখজনক। গণমাধ্যম প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করায় এসব করা সহজ হয়েছে।
কথা হচ্ছে, অতীতে কেউ এভাবে চার ঘণ্টা নির্বাচন হওয়ার পর নির্বাচন বর্জন করেনি। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা এখান থেকেই বোঝা যায়। মোদ্দা কথা, নির্বাচন কমিশন সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি, সবাইকে আস্থায় আনতে পারেনি। ফলে ভোটারদের উপস্থিতিও কম ছিল। তাঁরাও আসলে কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। আস্থা আগেও যে খুব বেশি ছিল তা নয়, আর এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই আস্থাহীনতা আরও পাকাপোক্ত হলো। নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর এভাবে আস্থা হারিয়ে ফেলা খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। মানুষের মতামত প্রকাশের সব পথ বন্ধ হয়ে গেলে তার ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। নদীর এক দিকে বাঁধ দিলে যেমন অন্য দিক দিয়ে নদী ভাঙে, ঠিক সে রকম। এসব স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্য। এটা সরকারের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
আমরা ভেবেছিলাম, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংকটের বদ্ধঘরে নতুন জানালা খুলে যাবে। সেই জানালা দিয়ে যে বাতাস আসবে, তাতে গুমোট ভাব কেটে যাবে। আমরা স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারব। কিন্তু এমনটা আর হলো না। আমরা জানি না, এরপর কী হবে। আমরা কি আবারও সহিংসতা দেখব? তবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা রাজনীতিতে হয়তো নতুন মেরুকরণ দেখব। কিন্তু যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেল। ক্ষতি হলো নির্বাচন কমিশনের, ক্ষতি হলো সরকারের, ক্ষতি হলো রাজনীতির, সর্বোপরি ক্ষতি হলো রাষ্ট্রের। সেই ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ীই হবে বলে আশঙ্কা। তবু এই দুর্দিনে আশাই আমাদের একমাত্র ভেলা। আমাদের নাগরিকদের গভীরভাবে ভাবতে হবে, কীভাবে এই দুর্দশা থেকে বেরোনো যায়।
এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
Comments
Post a Comment