Skip to main content
দেশী মিডিয়ার রিপোর্ট- নতুন অনিশ্চয়তায় বাংলাদেশের রাজনীতি
বিরোধীদের মেয়র নির্বাচন বর্জন করায় বাংলাদেশে অচলাবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলো। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দু’নেত্রীর দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব আরেকটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো। এই নির্বাচন বর্জন করায় আবারও দেশটি রাজনৈতিক উত্তেজনায় ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এতে নতুন অনিশ্চয়তায় পড়লো বাংলাদেশের রাজনীতি। গত তিন মাস দেশে প্রচণ্ড রাজনৈতিক উত্তেজনার পর এ নির্বাচনকে পর্যবেক্ষক মহল তা নিরসনের একটি ধাপ হিসেবে দেখছিলেন। এ বছরের শুরুতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এতে ব্যাপক সহিংসতা হয়। তিন মাস এমন অবস্থায় চলার পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে অনেকেই দেশ শান্ত হয়ে আসবে বলে ভেবেছিলেন। এ নির্বাচনকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মধ্যে রাজনীতির সর্বশেষ লড়াই হিসেবে দেখা হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপক ‘জালিয়াতি’ ও ‘অর্থহীন’ নির্বাচনের অভিযোগ তুলে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। এই বর্জনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে ফের অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা উসকে দিচ্ছে। গত বছরের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। এ বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন বেগবান করেন। গত বছর যে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে তা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়। গতকাল ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নিয়ে এমনই মূল্যায়ন করেছে বিদেশী মিডিয়া। এর মধ্যে বিবিসি’র শিরোনাম- নতুন অনিশ্চয়তায় বাংলাদেশের রাজনীতি? এতে বলা হয়- বাংলাদেশে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে প্রধান বিরোধী দলের ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে। গতকাল এ রিপোর্ট লেখার সময় ভোট গণনা চলছিল। দুপুরের আগেই প্রথমে চট্টগ্রাম থেকে বিএনপির ভোট বর্জনের কথা আসে। তার কিছুক্ষণ পর রাজধানী ঢাকায় বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা নির্বাচন বয়কটের কথা ঘোষণা করেন। সে সময় সেখানে ঢাকা উত্তরের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল এবং দক্ষিণে মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসও উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় নেতা মওদুদ আহমদ বলেন, এটা কোন নির্বাচনই হয় নি। গণতন্ত্রের প্রহসন হয়েছে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় নি। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকেও ভোটকেন্দ্র দখল, জাল ভোট ও জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিবিসি’র সংবাদদাতারাও কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখতে পান সেখানে গণহারে সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামের বিএনপি সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী মঞ্জুর আলম ক্ষোভে রাজনীতি থেকেই সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন। নির্বাচন কমিশন বলেছে, নির্বাচনের সময় বড় ধরনের কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, অনিয়মের যেসব অভিযোগ তারা পেয়েছেন সেগুলো তারা খতিয়ে দেখবেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, রাজনীতির জন্য ইস্যু তৈরি করার লক্ষ্যেই বিএনপি পরিকল্পিতভাবে নির্বাচন বয়কট করেছে। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বিবিসিকে বলেছেন, জনগণ বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কারণে নতুন একটি ইস্যু তৈরির জন্য খালেদা জিয়া এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। গত বছর ৫ই জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বয়কট এবং এ বছর টানা কয়েক মাস ধরে সহিংস আন্দোলনে ক্ষান্ত দিয়ে বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়। অনেকেই মনে করছিলেন যে, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হয়তো রাজনৈতিক অচলাবস্থার বরফ গলার একটা সুযোগ তৈরি হলো। কিন্তু বিরোধীদের ভোট বয়কটের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি যে নতুন একটি অনিশ্চয়তায় পড়লো এ নিয়ে খুব একটা সন্দেহ নেই। ওদিকে ব্লুমবার্গ ডট কমের শিরোনাম- মেয়র নির্বাচন বর্জন করেছে বিরোধীরা। এর ফলে বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থা রয়েই যাচ্ছে। এতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করছে এমন অভিযোগে মেয়র নির্বাচন শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ রাজধানী ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এটা প্রহসন। এটা গণতন্ত্রের নামে তামাশা। নির্বাচনী বুথে প্রবেশে দলীয় নেতাকর্মীকে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেয় নি। তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তাদেরকে আটক করেছে। বুথে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না ভোটারদের। দু’নেত্রীর মধ্যে দীর্ঘদিনের যে বিরোধ তা এখন নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কর্তৃত্বপরায়ণ হিসেবে অভিহিত করে গত বছর জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। এ নিয়ে দেশজুড়ে যে অবরোধ, হরতাল ডাকা হয় তাতে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়। এক পর্যায়ে তা ভয়াবহ সহিংসতায় রূপ নেয়। ঢাকাস্থ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-এর গবেষণাবিষয়ক অতিরিক্ত পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এই বর্জন রাজনৈতিক উত্তেজনা ফেরার এক নতুন ইঙ্গিত বহন করছে। এর গুরুত্ব নির্ভর করছে বিএনপির দলীয় শক্তির ওপর। ওদিকে বিএনপির বর্জন সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতা মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, একটি লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচনে এসেছিল বিএনপি। এটা জানা ছিল যে, তারা আগেভাগেই নির্বাচন বর্জন করবে। বিএনপি তো বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ সম্পর্কে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মানসুর বলেন, দীর্ঘদিন নির্বাচন থেকে দূরে থাকা নির্বাচনী রাজনীতিতে আত্মহত্যার শামিল। নির্বাচন শুরুর আগে এক ই-মেইলে তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক ভিত্তি ঝালাই করে নেয়া বিএনপির জন্য সহজ হবে না। তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাডোলু লিখেছে, ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ এ নির্বাচনকে প্রহসন ও অর্থহীন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, এটাকে নির্বাচন বলা যায় না। তাই ভোটারবিহীন এ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। জবাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছে, বিরোধীদের এই বর্জন ছিল পাতানো। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, নির্বাচন বর্জনের এ সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে রেখেছিলেন খালেদা জিয়া। তিনি জানতেন নির্বাচনে হারবেন। নির্বাচনে অংশ নেয়ার কোন ইচ্ছাই তার ছিল না। নির্বাচনী প্রচারণাকালে খালেদা জিয়ার গাড়ি কমপক্ষে তিনবার হামলার শিকার হয়েছে। এ হামলা খালেদা জিয়া ঘটিয়েছেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন। আনাডোলু এজেন্সির প্রতিনিধি একটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের নেতা-সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতির দৃশ্য দেখতে পান। সেখানে ভোটকেন্দ্রের বাইরে দাঁড়ানো বেশকিছু ভোটার। ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা ভোট দিতে পারেন নি। এ নিয়ে ওই হাতাহাতির সৃষ্টি। এছাড়া, তারা পোলিং সেন্টারে হামলার ঘটনার খবর পান। ব্যালট পেপার দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরতে দেখা গেছে। তবে তা কোন দল করছে তা নিশ্চিত হওয়া যায় নি। সোমবারই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সতর্ক করেছে। তারা বলেছে, নির্বাচনে কোন রকম হস্তক্ষেপ করা হলে হরতাল ও অবরোধ আসতে পারে। মওদুদ আহমদ দলের কেন্দ্রীয় অফিসে সাংবাদিকদের বলেন, যদি ভোটার ও পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া হয় তাহলে আমরা ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলন আবার শুরু করবো। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়েস স্টেট ইউনিভার্সিটির পলিটিক্স অ্যান্ড গভর্নমেন্টবিষয়ক প্রফেসর আলী রিয়াজ নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এই নির্বাচন একটি পথ করে দিতে পারে। এ নির্বাচন নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতাসীন দলের কাছে একটি পরীক্ষা। তাদের অধীনে কোন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে কিনা সেই পরীক্ষা এটি। যদি ক্ষমতাসীন দল যেকোন উপায়ে ফল নিজেদের অনুকূলে নেয়ার চেষ্টা করে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক। তা না হলে দেশ আবার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দিকে যাবে। পক্ষান্তরে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন তাদের নৈতিক আদর্শকে আরও উন্নত করবে। ভারতের সরকারি বার্তা সংস্থা পিটিআই লিখেছে, জালিয়াতির অভিযোগে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঢাকা উত্তরে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছিল তাবিথ আউয়াল ও ঢাকা দক্ষিণে মির্জা আব্বাসকে। তারপক্ষে প্রচারণা চালান তার স্ত্রী আফরোজা আব্বাস। চট্টগ্রামে মেয়রপ্রার্থী মনজুর আলম নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে এ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত জানায় বিএনপি। মনজুর আলম চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র থেকে আমার পোলিং এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়েছে জোর করে। এ অবস্থায় এমন নির্বাচনে থাকার আগ্রহ আমার নেই। রাজনীতি থেকেও আমি অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিলাম। একই সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রামে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী অভিযোগ করেন, নির্বাচন এতটাই ত্রুটিপূর্ণ যে, এর ফল দেখার জন্য অপেক্ষা করার কোন প্রয়োজন নেই আমাদের। বার্তা সংস্থা রয়টার্সও প্রায় একই রকম রিপোর্ট দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এ নির্বাচন কোন দলীয় নির্বাচন না হলেও ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল বিএনপি সরাসরি প্রার্থীদের সমর্থন দিয়েছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি খুব করে হলেও শতকরা ৫ ভাগ হবে। আমরা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু নির্বাচনে এতটাই কারচুপি প্রমাণিত হয়েছে যে, তা প্রমাণ করে এই সরকারের অধীনে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়।
Comments
Post a Comment