এদের কোনো কাম নাই। এদের কোনো প্রডাকশন নাই। শুধু রিডাকশন আছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা দিয়ে আসছে।
তিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে সরকারের রহস্যনাটক বেশ জমে উঠেছে। এ নাটকের পর্দা উন্মোচিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক নগরীতে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর সেখানকার টাঙ্গাইল সমিতি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে। সে অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী। তবে তারচেয়ে হজ ও তাবলিগ জামাতের বেশি বিরোধী। এ হজে যে কত ম্যান পাওয়ার নষ্ট হয়! হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরব গেছে। এদের কোনো কাম নাই। এদের কোনো প্রডাকশন নাই। শুধু রিডাকশন আছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা দিয়ে আসছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এভারেজে যদি বাংলাদেশ থেকে এক লাখ লোক হজে যায়, প্রত্যেকে যদি পাঁচ লাখ টাকা করে খরচ করে, তাতে ৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়।’ হজ কিভাবে এসেছে, নিজের মতো করে তার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আবদুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ চিন্তা করলেন, এ জাজিরাতুল আরবের লোকেরা কিভাবে চলবে? তারা তো ছিল ডাকাত। তখন একটা ব্যবস্থা করল যে, আমার অনুসারীরা প্রতি বছর একবার একসঙ্গে মিলিত হবে। এর মধ্য দিয়ে একটা আয়-ইনকামের ব্যবস্থা হবে।’ তাবলিগ জামাতের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তাবলিগ জামাত প্রতি বছর ২০ লাখ লোকের জমায়েত করে। নিজেদের তো কোনো কাজ নাই। সারা দিন গাড়ি-ঘোড়া তারা বন্ধ করে দেয়।’ আর প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কথায় কথায় আপনারা জয়কে টানেন কেন? জয় ভাই কে? জয় বাংলাদেশ সরকারের কেউ নন। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ারও কেউ নন।’ এ ছাড়া লতিফ সিদ্দিকী দাবি করেন, জয়কে প্রতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে দুই লাখ ডলার কনসালটেন্সি ফি দেয়া হয়। তিনি এর যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
অপ্রাসঙ্গিক, তবুও আর একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়। সে সময়ের তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী প্রবাসী অভিবাসীদেরও একহাত নিতে ছাড়েননি। যে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের টাকায় তিনি নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলেন এবং সেখানকার বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করছিলেন, তাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আপনারা বিদেশে এসেছেন কামলা দিতে এবং সব সময় কামলাই দেবেন।’ বিদেশ থেকে বাংলায় প্রকাশিত নিয়মিত সংবাপত্রগুলোকে তিনি টয়লেট-পেপার বলে অভিহিত করেন। আর বাংলাদেশের টিভি টকশোতে যারা অংশ নেন, তাদের তিনি ‘টকমারানি’ (এখানে তিনি ‘চুৎমা...’ অশ্লীল শব্দটি ব্যবহার করে কথাটি বুঝিয়ে দেন) বলে অভিহিত করেন।
আমাদের অবিরাম শুনানো হচ্ছে, শেখ হাসিনা অতিশয় ধর্মপ্রাণ মুসলমান। সংবিধান থেকে মহান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের বিধান তুলে দিলেও তিনি নাকি ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেন। তারপর তিনি ইবাদত-বন্দেগি করেন। এরপর তিনি ফজরের নামাজ আদায় করেন। তারপর তিনি পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করেন। তারপর দিনের কাজ শুরু করেন। আলহামদুলিল্লাহ। এমন একজন পরহেজগার প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভায় এমন ইসলামদ্রোহীর কিভাবে ঠাঁই হলো, সেটা ভাবলে অবাকই হতে হয়।
এরপর শুরু হয় রহস্য-নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক। মুসলমানপ্রধান একটি দেশের ৭৭ বছর বয়স্ক একজন সিনিয়র মন্ত্রী যখন ইসলাম ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নিয়ে এমন উক্তি করেন, তখন তা জ্যাকসন হাইটসের হোটেলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ফেসবুক-টুইটারের মাধ্যমে তা পৃথিবীর সাড়ে ৬০০ কোটি মানুষের মধ্যে যে ২০০ কোটি মুসলমান, তাদের কাছে মুহূর্তেই পৌঁছে যায়। এতে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। ইসলামি দুনিয়া মুহূর্তেই স্তম্ভিত হয়ে যায়। আমাদের পরহেজগার প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভায় এই কাউনটি কে? যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, কে কোথায় মুসলমান, কোন রাষ্ট্রের মুসলমানদের জন্য কী দরদ, তার ব্যাপারে এই সরকারের কোনো উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নেই। অনির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য হলো, পৃথিবীর অন্য রাষ্ট্র যে যার মতো যার যা খুশি বলে যাক, আমি ‘বঙ্গবন্ধু কন্যা’ কিছুই পরোয়া করি না। তাদের মতো তারা কথা বলে যাক। আমার মতো আমি কাজ করে যাবো। বিচার হতে থাকবে। ফাঁসি হতে থাকবে।
এরপরও সম্ভবত লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে খানিকটা বিপাকেই পড়েছে সরকার। যদিও এই সরকার ‘ওয়ান ম্যান শো’। কেননা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে নিজের ক্ষেত্রে লিঙ্গভেদ দূর করে তাকে স্যার সম্বোধনের আদেশ দিয়েছেন। ফলে তার অধস্তন কর্মকর্তারা তাকে ‘স্যার’ বলেই সম্বোধন করেন। আওয়ামী লীগের যারা সমর্থক তাদের সবাই লতিফ সিদ্দিকীর মতো ধর্মদ্রোহীÑ এমন ধারণা আমার নেই। আওয়ামী লীগের লাখ লাখ সমর্থক আছেন যারা ধর্মপ্রাণ মুসলমান। ফলে শেখ হাসিনা নিজেও লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া থেকে দূরে থাকতে পারেননি। যাই ঘটে ঘটুক বলে চোখ বন্ধ করে রাখতে পারেননি। নিউ ইয়র্কে লতিফ সিদ্দিকীর বক্তৃতার পরপরই এ বিষয়ে সারা পৃথিবীতে তোলপাড় শুরু হয়।
সে তোলপাড়ে দারুণ অস্বস্তিতে পড়েন শেখ হাসিনা নিজেও। ফলে তাকে একটা না একটা ঘোষণা দিতেই হতো। প্রাথমিকভাবে সে ঘোষণার একটি হলো, তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দেয়া। রহস্য-নাটকের দ্বিতীয় পর্ব এখান থেকে শুরু। এ ঘটনায় যখন দেশব্যাপী তোলপাড়, বিদেশেও কূটনৈতিক উত্তাপ, তখন জাতিসঙ্ঘ সম্মেলনে যোগদান শেষে নিউ ইয়র্ক থেকে লন্ডনে ছিলেন শেখ হাসিনা। সেখান থেকেই তিনি জানালেন, লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করা হবে। কথাটি মন্দ নয়। সারা দেশ তখন বিক্ষোভে উত্তাল। লতিফ সিদ্দিকীর গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে বহুমুখী বিক্ষোভের প্রভাব দেশব্যাপী। শেখ হাসিনার বক্তব্যগুলো ছিল কথার কথা। শেখ হাসিনা এই ঘোষণার পর দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা হয় এর আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য।
আমাদের জানানো হয়, কোনো মন্ত্রীকে বরখাস্ত করার একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। সেটা কার্যকর করা সময়ের ব্যাপার। এই চিঠি রাষ্ট্রপতিকে স্বাক্ষর করতে হয়। রাষ্ট্রপতি বিদেশে আছেন। অতএব সময় লাগবে। এভাবে লম্বা সময় ধরে কালক্ষেপণ করা হয়। এই প্রযুক্তির যুগে এমন বাজে যুক্তি কিছুতেই ধোপে টেকে না। প্রধানমন্ত্রী যদি আন্তরিকভাবে চাইতেন যে, লতিফ সিদ্দিকী আর মন্ত্রিসভায় থাকবেন না, তাহলে এটা ছিল মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার। রাষ্ট্রপতি যেখানেই থাকুন সেখানেই প্রধানমন্ত্রী তাকে অনুরোধ করতে পারতেন যে, অমুক মন্ত্রীকে তিনি আর চান না। সে ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে লতিফ সিদ্দিকীকে দ্রুতই অপসারণ করা যেত। সরকার সেটা করতে পারেনি। এটাকে কেউ কেউ গোপনে লতিফ সিদ্দিকীর নেগোশিয়েট করার চেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন, যাতে লতিফ আরো বেশি ড্যামেজ করে না বসেন।
মনে হয়, লতিফ সিদ্দিকী কোথায় যেন দেন-দরবার করার ক্ষমতা রাখেন। সেই দেন-দরবারের কারণেই তিনি নিউ ইয়র্কের পর ভারতে চলে আসেন এবং সেখানে মাসাধিককাল অজ্ঞাতবাসে থাকেন। প্রথম দিকে টেলিফোন ধরলেও পরে তিনি তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। জনতার চাপে তার মন্ত্রিত্ব যায় গত ১২ অক্টোবর। আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদ যায় ২৪ অক্টোবর। কিন্তু তিনি কলকাতায় পালিয়ে থাকেন। এরপর ২৩ নভেম্বর এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে আকস্মিকভাবেই ঢাকায় ফিরে আসেন লতিফ সিদ্দিকী। লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার দায়ে ১৮টি জেলায় ২২টি মামলা হয়েছে। প্রতিটি মামলায়ই যথাসময়ে হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তারপরেও তিনি ২৩ নভেম্বর ঢাকা বিমানবন্দরে এসে হাজির হন। লতিফ সিদ্দিকী টোকাই নন যে, কেউ তাকে চেনে না। বিমানবন্দরেও সবাই তাকে চেনেন। এত মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা সত্ত্বেও লতিফ সিদ্দিকী ‘আমি এখনো এমপি আছি’ এই দাবিতে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করেছেন। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে নজরে রেখেছিল বটে, কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না পাওয়ায় গ্রেফতার করেনি।
লতিফ সিদ্দিকী নির্বিঘেœ বিমানবন্দর থেকে তার নিজের গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো গ-৩৫...) চড়ে গুলশানে নিজের বাড়িতে রাত যাপন করেন। পরদিন থাকেন গুলশানে তার এক বন্ধুর বাসায়। অর্থাৎ সরকারের সাথে ফের আলাপ-আলোচনার একটা সুযোগ তিনি হাতে রাখেন। তারপর ২৫ নভেম্বর তিনি গুলশান থানায় না গিয়ে নিউ মার্কেট থানায় আত্মসমর্পণ করেন। জেল গেটেও তিনি নাটক করেন। বলেন, পকেট গেট দিয়ে তিনি জেলখানায় ঢুকবেন না। তাকে মূল ফটক খুলে দিতে হবে। সরকার তার সে আবদারও মেনে নিতে বাধ্য হয়। তবে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো জামিনযোগ্য। আর অপরাধ প্রমাণ হলে শাস্তি হতে পারে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় ধরনের শাস্তি। এর বেশি কিছু নয়। সুতরাং আশা করা যায়, শিগগিরই জামিনে বের হয়ে আসবেন লতিফ সিদ্দিকী।
সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
Comments
Post a Comment