লতিফ সিদ্দিকী বিভিন্ন বক্তৃতায় শিবির ধরে ধরে হত্যার পরামর্শ দিতেন ছাত্রলীগকে। কিন্ত্ ুতার শেষটি এসে দাঁড়ায় ইসলামের পাঁচ ফরজের একটি হজের বিরুদ্ধে কথা বলে।
ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে চর্চা ও এর অনুসরণের প্রচেষ্টাকে দীর্ঘ সময় মৌলবাদ হিসেবে প্রচার করা হতো। এখন এটাকে চিহ্নিত করা হয় ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ হিসেবে (Political Islam)। ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ নিষিদ্ধ করার কথা বলা এখন আন্তর্জাতিকভাবে একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এটি করতে গিয়ে যারা ইসলামি জীবনপদ্ধতিকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের নিষিদ্ধ করার পক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও দার্শনিক যুক্তি হাজির করা হচ্ছে। আবার অনেক সময় এ ক্ষেত্রে বুদ্ধি বা আইনি বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে মোটা দাগে ইসলামি সংগঠনগুলোকে বিভিন্ন রাষ্ট্রিক-অরাষ্ট্রিক ফোরাম থেকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ আখ্যা দেয়া হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের পর এই প্রবণতা বেশ জোরালো হয়ে ওঠে। উপমহাদেশে এর প্রাবল্য দেখা যায়, বিশেষভাবে বাংলাদেশে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পর এ প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের অ্যাকাডেমিক যুক্তিতর্কের মোড়কে ফেলে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোকে যারা নিষিদ্ধ করার পক্ষে বক্তব্য রাখেন, তাদের একজন হলেন অধ্যাপক তাজ হাশমি (পূর্ণ নাম তাজুল ইসলাম হাশমি)। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বা রাজনৈতিক ইসলামের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেন। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দু’টি ইংরেজি দৈনিকে তার লেখা অনেকটা নিয়মিতভাবে প্রকাশ হয়। আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসির অস্টিন পিই ইউনিভার্সিটির সিকিউরিটি স্টাডিজ বিভাগে অধ্যাপনা করেন তিনি। তাজের পরিবার ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর ভারতের আসাম ত্যাগ করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। হাশমির বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাজীবন কাটে পূর্ব পাকিস্তানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি ইসলামের ইতিহাসে অনার্স ও মাস্টার্স করে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে আধুনিক দক্ষিণ এশীয় ইতিহাস বিষয়ে পিএইচডি করেন। নিরাপত্তা সমীক্ষার ওপর তিনি যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত-অনিয়মিত লেকচার দিয়ে থাকেন। ভারতে জন্ম, পাকিস্তানে চলে আসা বাংলাদেশে শিক্ষাজীবন ও পাশ্চাত্যে অধ্যাপনা করার প্রভাব তাজ হাশমির লেখালেখিতে প্রত্যক্ষ করা যায়। নিরাপত্তা হাশমির শিক্ষকতার মূল ক্ষেত্র হলেও তার এখন লেখালেখির প্রধান বিষয় হলো ‘রাজনৈতিক ইসলাম’। তার প্রকাশিত সাম্প্রতিক বই হলো Global Jihad and America : The Handred Years War Beyond Iraq and Afghanistan. তিনি ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকে জামায়াতকে নিয়ে বাংলাদেশের কী করা উচিত (What should Bangladesh do with Jamaats) শীর্ষক এক নিবন্ধ লিখেছেন। এতে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার ব্যাপারে তাজ হাশমির লেখালেখি ও বক্তব্যের প্রতিফলন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রত্যক্ষ করা যায়। আওয়ামী লীগ ও সেকুলার ঘরানার রাজনৈতিক শক্তির পক্ষ থেকে ১৯৭১ সালে ‘পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বাঙালিদের ওপর গণহত্যা ধর্ষণ চালানোতে নেতাকর্মীদের সহায়ক ভূমিকা পালন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ অবস্থান’ নেয়ার জন্যই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা উচিত বলে যে কথা বলা হয়, তার সাথে একমত নন তাজ হাশমি। তিনি মনে করেন, অন্য দু’টি মুখ্য বিবেচনায় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা উচিত। প্রথমত, সংবিধান বাংলাদেশে কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অনুমোদন করে না। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে সংসদ সংবিধান-সংশোধনী অনুমোদন করে। দ্বিতীয়ত, জামায়াত শুধু একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাই নয়, অধিকন্তু একটি সর্বাত্মকবাদী ইসলামি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সংখ্যালঘু ও অমুসলিমরা যেখানে নিপীড়নের শিকার হবে, হীন অধিকার নিয়ে জিম্মি বা নিরাপত্তা রক্ষিত মানুষ হিসেবে বাস করবে। দলটির এ নীতি (হাশমির মতে, মওলানা মওদূদীর লেখায় স্পষ্ট) সৌদি আরব, ইরান, পাকিস্তান এবং ইরান-সিরিয়ায় আইসিস যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, তার চেয়ে আলাদা কিছু হবে না। এখানে তাজ হাশমি যে দু’টি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন, তার ব্যাখ্যায় বলেছেনÑ সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সংবিধানে যে সংশোধনী আনার কারণে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর পুনরুত্থান ঘটেছে, তাতে সংবিধান লঙ্ঘিত হয়েছিল। কারণ রাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো মৌলিক আদর্শ কেবল দেশব্যাপী গণভোটের মাধ্যমে পরিত্যক্ত বা সংশোধিত হতে পারে। সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন নিয়ে তা বদলানো যাবে না। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাজ হাশমি বাংলাদেশের সংবিধান সম্পর্কে এক ধরনের অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। যে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা পরিবর্তন করে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিল, তা শুধু সংসদের দুই-তৃতীয়াংশে অনুমোদন লাভ করেনি, একই সাথে গণভোটেও তা অনুমোদন লাভ করে। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে এই গণভোটের বিধান ছিল না। এটি করা হয় পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে। আর এটি সংবিধান থেকে বাদ দেয়া হয় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। এই সংশোধনীতে অবশ্য সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশকে মৌলিক বিষয় চিহ্নিত করে অপরিবর্তনীয় করা হয়। তাজ হাশমি জামায়াত ‘ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র’ কায়েম করতে চায়Ñ এ ধারণা প্রমাণিত করতে এমন কিছু যুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন যেগুলোর ভিত্তি একেবারেই দুর্বল। তিনি মওলানা মওদূদীকে কোনো আলেম বা স্কলার নন বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন অনেক দেওবন্দ ও সুফি তার ও তার দলের সমালোচনা করেছেন। এমনকি কংগ্রেস নেতা (ভারতের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী) মওলানা আবুল কালাম আজাদ এ দলকে ফ্যাসিস্ট ও মূলচ্যুত বলেছেন। এসব কথা তিনি বলেছেন একেবারে কোনো উদ্ধৃতি ছাড়া। তিনি মওলানা মওদূদীর বক্তব্যের একটি অংশ উদ্ধৃত করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে, ‘ইসলামের আদর্শ ও কর্মসূচির বিরোধিতা করে এমন সব রাষ্ট্র ও সরকার যেখানে থাকুক না কেন ইসলাম তার ধ্বংস কামনা করে...।’ যদিও মওলানা মওদূদী এ কথা কোথায় বলেছেন সে উদ্ধৃতি তিনি দেননি। এ লেখায় তিনি মওলানা মওদূদী, হাসান আল বান্না, সাইয়েদ কুতুবকে ওসামা বিন লাদেন ও আইমান আল জাওয়ারির একই কাতারে ফেলেছেন । প্রথম তিনজনের কাউকে তিনি স্কলার বলতে চান না। অন্য একটি লেখায় (The shariah Mullah and Muslims in Bangladesh) হাশমি আরো একধাপ এগিয়েছেন। তিনি সিয়াহ সিত্তার হাদিস সঙ্কলক ইমাম বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ এবং অন্যদের মধ্যযুগের স্বল্পমাত্রার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার মানুষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ লেখায় জামায়াত মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করে এক বা একাধিক ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় বলে উল্লেখ করে তাজ হাশমি বলেছেন, দলটি ধীরে ধীরে যে ধরনের সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্র গঠন করতে চায় আলকায়েদা, তালেবান ও আইসিস এ লক্ষ্য অর্জন করতে চায় সহিংসতার মাধ্যমে। তিনি আবার ১৯৯১ সালে দলটির ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান তাকে তার দল ভোটের মাধ্যমে নয় বরং অন্য উপায়ে বা সমাজে ধীরে ধীরে অনুপ্রবেশ করে ইসলামি বিপ্লব ঘটাতে চায় জানিয়েছিলেন মর্মে দাবি করেছেন। তাজ হাশমি আব্বাস আলী খানের কোনো বই অথবা দলটির গঠনতন্ত্র কর্মপদ্ধতি বা নিজস্ব কোনো বইপত্রের উদ্ধৃতি দেননি। বরং আব্বাস আলী খান এমন কথা তাকে বলেছেন বলে দাবি করেছেন, যে কথাটি জনাব খানের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে প্রকাশিত কোনো বক্তব্য অথবা তার লেখা কোনো বইয়ে পাওয়া যায় না। মওলানা মওদূদী ‘ইসলামের আদর্শের বিরোধিতা করে এমন সব রাষ্ট্র বা সরকার ধ্বংস করতে চান’ বলে যে বক্তব্য উদ্ধৃতিহীনভাবে তাজ হাশমি উল্লেখ করেছেন, সেরকম কথাও মওলানা মওদূদীর বইয়ে দেখা যায় না। হাশেমী বইটির উদ্ধৃতি দিলে যাচাই করা যেত আসলে তিনি কী বলেছেন এবং বলে থাকলে কোন প্রেক্ষিতে কিভাবে বলেছেন। জামায়াত বা ইসলামি দলগুলো যে ধরনের ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে তা কার্যকর হলে সেখানে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ থাকবে কি না অথবা জনসমর্থন ছাড়া অন্য উপায়ে তারা বিপ্লব করতে চায় কি না, এ বিষয়ে পাশ্চাত্যে অনেকের সংশয় রয়েছে। এ সংশয়ের একটি কারণ হলো ইরানে যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তাতে ইসলামের মৌল আদর্শের সাথে ভিন্নমতের রাজনৈতিক দলের কাজ করার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে সংশয় দূর করতে ইসলামি দলগুলোর বক্তব্য ব্যাপকভাবে প্রচারিত নয় বলে এখনো যথেষ্ট বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। বাংলাদেশের জামায়াতকে ইসলামি রাজনৈতিক দল হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ব্রাদারহুড ঘরানার দলগুলোর সাথে তুলনা করা হয়। এ ধরনের ইসলামি দলগুলোকে চিহ্নিত করা হয় মধ্যপন্থী ইসলামি দল হিসেবে। এর বাইরে আলকায়েদা, তালেবান বা আইসিসÑ যার কথা তাজ হাশমি উল্লেখ করেছেনÑ সেগুলোকে বলা হয় কট্টর ধারার ইসলামি দল। তারা সশস্ত্র প্রক্রিয়ায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণা সমর্থন করে। ‘মুসলিম ব্রাদারহুড-জামায়াত ঘরানার মধ্যপন্থী ইসলামি দলগুলো (বিভিন্ন দেশে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন নামে সক্রিয়) জনগণের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে চায়। নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে তারা মুক্ত বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রাখবে নাকি ইরানের মতো ব্যবস্থা কায়েম করবে, সে বিষয়টি একসময় কেবল অনুমান করা যেত। কিন্তু তুরস্কে নমনীয় ইসলামি দল হিসেবে খ্যাত একে পার্টির তিন মেয়াদে ক্ষমতায় যাওয়া, তিউনিসিয়ার নির্বাচনে আন নাহদার ক্ষমতায় যাওয়া ও দেশটির শাসনতন্ত্র তৈরি এবং মিসরে ড. মুরসির সরকারের এক বছরে সংবিধান প্রণয়ন ও তা কার্যকর করার প্রচেষ্টার পর এ নিয়ে আর আন্দাজ অনুমানের প্রয়োজন হয় না। তাদের বাস্তব কাজ থেকে মধ্যপন্থী ইসলামি দলগুলোর রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়। প্রথমত, তারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়। ক্ষমতায় যাওয়ার পর জনগণের রায় তাদের পক্ষে না থাকলে বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা রাখতে চায়। তিউনিসিয়ায় আন নাহদা প্রথমবার ভোটে জয়ী হলেও দ্বিতীয় দফায় তারা হেরে গেছে। মিসরে যে সংবিধান মুরসি সরকার কার্যকর করেছিল সেটিতে পরের নির্বাচনে জনগণের রায় ব্রাদারহুডের বিপক্ষে গেলে তাদের সরকারে থাকার সুযোগ নেই। তুরস্কে ২০১৫ সালে যে সংসদীয় নির্বাচন হওয়ার কথা, তাতে জনগণ একে পার্টিকে ভোট না দিলে দলটির সরকার গঠনের কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর যে সর্বশেষ গঠনতন্ত্র তাতে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে কাজ করে যাওয়ার কথা রয়েছে। ফলে সশস্ত্র পদ্ধতিতে যারা ক্ষমতায় যেতে চায় তাদের সাথে এ দলকে এক করার অবকাশ যেমন নেই, তেমনিভাবে তারা বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তে সর্বাত্মকবাদী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র করতে চায় এমন কথা বলারও সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে তাজ হাশমির বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। তাজ হাশমির স্লোগান হলো ‘নো টু পলিটিক্যাল ইসলাম’। তার লেখার লক্ষ্যও আসলে বিশেষ কোনো দল নয়। যে কারণে নিষিদ্ধের সুপারিশ করতে তিনি ১৯৭১-এর জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক অবস্থানের চেয়েও দলটির ইসলামি আদর্শকে বেশি বিবেচনায় এনেছেন। হাশমির পরিবার ১৯৭১ সালে অখণ্ড পাকিস্তান সমর্থন করায় এক ধরনের অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। হয়তোবা এ কারণে তিনি এক লেখায় বলেছেন শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে পাকিস্তানের জাতির পিতা হিসেবে দেখায় তার আপত্তি রয়েছে। যদিও এ দুই নেতার প্রতি তার রয়েছে যথেষ্ট সম্মানবোধ। হাশমির লেখাগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলে বোঝা যায় তার আক্রমণের লক্ষ্য হলো ইসলামের মূল আদর্শ। তিনি কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ভুল অনুবাদ হাদিস শরিয়াহ ইত্যাদির নিজের মতো ব্যাখ্যা দিয়ে ইসলামের মূল ভাবাদর্শকে বিতর্কিত করতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, শরিয়াহ বলতে যেটি আছে, সেটি ইসলামবিরোধী। এ জন্য যেসব উদ্ধৃতি দিয়েছেন তার বেশির ভাগই বিভ্রান্তিকর। ইসলামের মূল বিষয় হিসেবে দেখা হয় আল্লাহর ইবাদতকে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরিক করার কোনো ধরনের অবকাশ রাখা হয়নি। আল্লাহর ইবাদত করতে হবে রাসূল সা. যেভাবে করেছেন এবং বলেছেন সেভাবে। তার পদ্ধতির বাইরে গিয়ে আল্লাহর ইবাদতের অবকাশ নেই। তাজ হাশমি তার লেখায় এই মূল জায়গাটিতে আঘাত করেছেন। তিনি অব্যাহতভাবে বলে যাচ্ছেন শরিয়াহ হলো ইসলামের পরিপন্থী। যেসব হাদিসকে বিশুদ্ধ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তাতে অনেক সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। কানাডায় বসবাসরত মুসলিমদের জন্য ইসলামি শরিয়াহ অনুসরণের জন্য পৃথক মুসলিম বোর্ড করার উদ্যোগের বিরোধিতা করতে গিয়ে হাশমি একটি নিবন্ধ লিখেছেন। শরিয়াহ ইসলামিকও নয় কানাডীয়ও নয় (Sharia is neither Islamic nor Canadian) শীর্ষক এই নিবন্ধে তিনি অদ্ভুত কিছু যুক্তি হাজির করেছেন। তিনি বলেছেন, শরিয়ার মূল উৎস হলো হজরত মোহাম্মদ সা:-এর কয়েক হাজার হাদিস (যা তিনি বলেছেন বা নির্দেশনা দিয়েছেন)। এসব হাদিস তার ইন্তেকালের ২০০ বছরের বেশি সময় পর সংগ্রহ করা হয়েছে। অষ্টম থেকে ১২ শ’ শতক পর্যন্ত সময়ে কুরআনকে উপলব্ধি বা বিবেচনায় রেখে, রসূলের সা: আচার-ঐতিহ্য, স্থানীয় রীতিনীতি ও সবকিছুর ওপর সাধারণ বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে মুসলিম আইন বিশারদদের যে আইনি মতামত সেটিই শরিয়াহ। তাজ হাশমি বলতে চাইছেন শরিয়ার বিধান কুরআন ও ইসলামের সাথে বিভিন্নভাবে সাংঘর্ষিক। এ ক্ষেত্রে তিনি কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কুরআনে ব্যভিচারের জন্য শাস্তি হিসেবে ৮০ দোররার কথা বলা হয়েছে। অথচ শরিয়া অনুযায়ী ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ উভয়ের জন্য পাথর মেরে মৃত্যু ঘটানোর বিধান রয়েছে। (অথচ এ ধরনের মৃত্যু ঘটানোর রায়টি মদিনায় রাসূল সা: কার্যকর করেছিলেন এক ইহুদির ওপর ইহুদি ধর্মের বিধান অনুসারে।); ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগের জন্য কুরআনে কোনো মৃত্যুদণ্ডের বিধানের কথা বলা নেই, যদিও শরিয়ায় এ জন্য মৃত্যুদণ্ডের কঠোর শাস্তি রয়েছে। (এ বিধানের প্রবক্তারা রাসূলের সা: ইন্তেকালের পর মদিনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহীদের ব্যাপারে প্রথম খলিফা আবু বকর রা:-এর অবস্থানকে দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে রাখেন।) কুরআনে আল্লাহর চোখে পুরুষ এবং মহিলা, মুসলমান ও অমুসলিমদের জন্য সমান মর্যাদার কথা এসেছে। কিন্তু শরিয়ায় কুরআনের এ বিধান থেকে সরে আসা হয়েছে। এ জাতীয় বিভ্রান্তিকর বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে তাজ হাশমি শরিয়তের বিধান ইসলাম পরিপন্থী এবং হাদিস সঙ্কলনগুলো অগ্রহণযোগ্য প্রমাণ করতে ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। শরিয়ার প্রকৃত বিধান সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং নানাবিধ অপপ্রচারের কারণে এ ধরনের ধারণা বিস্তার লাভ করে। আর ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে এ ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য কোন্ কোন জিনিসকে অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করা যাবে এ ব্যাপারে বিভিন্ন বই ও ওয়েবসাইট্ রয়েছে। ফলে ইসলাম সম্পর্কে কোনো বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ছাড়াই তাজ হাশমির মতো ব্যক্তিরা মৌলিক বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে পারেন। শরিয়াহর যেসব শাস্তির কথা হাশমি তার লেখায় উদ্ধৃত করেছেন রাসূল সা: ও খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলে এমনকি উমাইয়া ও আব্বাসীয় খেলাফতের সময়েও এ ধরনের শাস্তি কত সংখ্যক লোকের ওপর প্রয়োগের দৃষ্টান্ত রয়েছে সেটি দেখতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র এমনকি বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্র যেখানে শরিয়া আইন নেই সেখানে কতটা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে তার সাথে সৌদি আরব বা ইরানের মৃত্যুদণ্ডের তুলনা করা যায়। শেষোক্ত ক্ষেত্রে এ ধরনের শাস্তির সংখ্যা বেশ কম। আসলে ‘নো টু পলিটিক্যাল ইসলাম’ নামে যে প্রচারণা তাজ হাশমি ও অন্যরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের মূল লক্ষ্য কিন্তু ইসলামের বিধিবিধান। বিশেষ কোনো ইসলামি দল দিয়ে তারা শুরুটা করেন। বাংলাদেশে মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী বিভিন্ন বক্তৃতায় শিবির ধরে ধরে হত্যার পরামর্শ দিতেন ছাত্রলীগকে। কিন্ত্ ুতার শেষটি এসে দাঁড়ায় ইসলামের পাঁচ ফরজের একটি হজের বিরুদ্ধে কথা বলে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এরকম অনেক উদাহরণ রয়েছে, যাদের দল বিরোধিতার শেষ গন্তব্য দাঁড়ায় ইসলাম। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ইসলামি ধর্মীয় বিশ্বাস বা স্বাতন্ত্র্য মুছে গেলে দেশটির উপমহাদেশে স্বাধীন হিসেবে টিকে থাকার মূল যুক্তিটিই আর থাকবে না।
Comments
Post a Comment