ভারত নিরপেক্ষ ভূমিকায় চলে গেলে সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে।

 বিরোধী শিবির থেকে প্রায়ই এ অভিযোগ উচ্চারিত হয়। তা হয়তো মিথ্যাও নয়। সামরিক ছাউনিতেই বিএনপির জন্ম। কিন্তু খালেদা জিয়ার ইতিহাস আলাদা। বাংলাদেশের ইতিহাসের এক দুঃখজনক সময়ে রাজপথেই তার রাজনৈতিক অভিষেক। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী এবং আপসহীন। রাজপথে প্রায় প্রতিদিনই ছিলেন সক্রিয়। অভয় দিয়ে গেছেন দলীয় নেতা-কর্মীদের। পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে যে কারণে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছিল বিএনপি। সবাই যখন আওয়ামী লীগের বিজয়ের অপেক্ষায় ছিল তখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসীন হয় বিএনপি। এর পরের দুই যুগের ইতিহাসে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছেন তিনি। কখনও প্রশংসিত হয়েছেন, কখনও বা সমালোচিত। তবে বহুল আলোচিত ওয়ান ইলেভেন বাস্তবিকই তার জীবনে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে। বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন তিনি। কেন তার দলের দুই সিনিয়র নেতা দল ছাড়লেন সে হিসাব হয়তো তিনি এখনও মিলাতে পারেননি। শেষ মুহূর্তে এসে রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীর পরিবর্তে মইন উ আহমেদকে কেন সেনাপ্রধান নিয়োগ দেয়া হয়েছিল খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই এখনও তা ভাবেন। জরুরি জমানা থেকেই তিনি অনেকটা নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেন। দুই ছেলে সপরিবারে নির্বাসিত। নবম সংসদ নির্বাচন থেকেও শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন তিনি। শরিক দল জামায়াতের চাপে তা করতে পারেননি। এখন ৫ই জানুয়ারি-পূর্ববর্তী আর পরবর্তী সময় নিয়ে ভাবছেন তিনি। নির্বাচনের পর পর আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ানোকে এখন ভুল হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিএনপি চেয়াপারসন। যদিও সে সময় তারেক রহমান আন্দোলন অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আরেকটি ৫ই জানুয়ারি যখন সন্নিকটে তখন সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে গত কিছু দিনে দলীয় নেতা, বুদ্ধিজীবী আর পেশাজীবীদের সঙ্গে টানা মতবিনিময় করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। যদিও তার সামনে আসলে আর কোন বিকল্পও নেই। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাটি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। আগামী ১লা ডিসেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। মামলাটিকে ঘিরে এরই মধ্যে বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। এ মামলায় তার গ্রেপ্তারের গুঞ্জনও শোনা যায় মাঝে মাঝে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় নিম্ন আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে একাধিকবার উচ্চ আদালতে গিয়েও কোন সুবিধা করতে পারেননি খালেদা জিয়া। বিএনপির আইনি পরামর্শকরা এটা বিশ্বাস করেন, আইনি লড়াইয়ে খালেদা জিয়া কোন সুবিধা পাবেন না। তাকে রাজনৈতিকভাবেই এ মামলা মোকাবিলা করতে হবে। খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো-ও একাধিক মামলার আসামি। বিএনপির পদধারী খুব কম নেতাই আছেন যাদের বিরুদ্ধে মামলা নেই। এ অবস্থায় দলকে রক্ষা করতে হলে বিএনপির সামনে আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। সম্প্রতি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে আসা একাধিক নেতা ও পেশাজীবী জানিয়েছেন, আলোচনায় সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে আত্মবিশ্বাসী আর দৃঢ়প্রত্যয়ী মনে হয়েছে। নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে মাঠে নামার ব্যাপারে নিজের দৃঢ়সংকল্প প্রকাশ করেছেন তিনি। বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীত্ব নয়, জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সামনের সারিতেই থাকবেন তিনি। এজন্য যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলায়ও প্রস্তুত রয়েছেন তিনি। নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় তাদের প্রতি সতর্কবার্তাও উচ্চারণ করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। অতীতে দলের সঙ্কটময় মুহূর্তে তাদের অসহযোগিতার কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কর্মসূচি ডেকে নেতাদের ঘরে বসে থাকার সমালোচনা করেছেন। গত কয়েক দিনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে একাধিকবার দেখা করা বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, সামনের সরকার বিরোধী আন্দোলনকে খালেদা জিয়া চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। যত ভয়ভীতিই দেখানো হোক না কেন তিনি আন্দোলন থেকে পিছু হটবেন না। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্রের শেষ দেখতে চান তিনি। বিএনপির একাধিক নেতা মনে করেন, আগামী বছরের শুরুর দিকেই বড় ধরনের পরিবর্তন হতে পারে। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে একটি নতুন নির্বাচনের ব্যাপারেও আশাবাদী তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ কয়েক দিন আগে একটি আলোচনা সভায় আগামী মার্চ-এপ্রিলে দেশে পরিবর্তন ঘটবে বলে মন্তব্য করেছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ও একাধিক আলোচনায় এ সময়সীমার কথা বলেছেন। তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের অনেকেই এ সময়সীমার ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি। তাদের আশাবাদ মধ্য ডিসেম্বর থেকেই আন্দোলন শুরু হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া মানবজমিনকে বলেন, আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ বলা সম্ভব নয়। তবে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন আন্দোলনের সম্ভাবনা বেশি। কারণ সরকারের দুর্নীতি আর অপশাসনে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। মানুষ আন্দোলনের জন্য অপেক্ষা করছে। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল নয়। দল এখন আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত। অতীতে আমাদের আন্দোলনে ভুল-ত্রুটি ছিল। বিশেষ করে ঢাকায় প্রত্যাশিত আন্দোলন হয়নি। আশা করি এবার সে ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে পারবো। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মধ্য ডিসেম্বরে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবেন খালেদা জিয়া। এ আন্দোলনে যত বেশি সংখ্যক দলকে সম্পৃক্ত করা যায় সে চেষ্টা করছেন তিনি। মাঝে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হলেও এখন তা অনেকটাই কেটে গেছে। আরও বেশ কিছু ছোট ছোট দলকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে মাঠে নামানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। বিদেশী শক্তিগুলোর সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ভারতকে নিরপেক্ষ ভূমিকায় নেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে দলটি। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, ভারত নিরপেক্ষ ভূমিকায় চলে গেলে সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে।

Comments