আগুনে পুড়ে ছাই হলো বন্ধ থাকা দৈনিক আমার দেশ কার্যালয়। রাজধানীর কাওরান বাজারে বিএসইসি ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এ ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে।
গতকাল দুপুরে ভবনটির ১১ তলায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট প্রায় দুই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয় আমার দেশ কার্যালয়। গতকাল সকাল থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের মালামাল অন্য একটি অফিসে সরিয়ে নেয়ার কাজ চলছিল। গত বছরের এপ্রিলে সরকার পত্রিকাটির ছাপাখানা বন্ধ করে দেয়ার পর এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
একই তলায় থাকা অন্য দুটি প্রতিষ্ঠানেও ব্যাপক ক্ষতি হয়। ওই ভবনে থাকা এনটিভি ও আরটিভি’র সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। চ্যানেল দুটির সম্প্রচার ব্যবস্থা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর সন্ধ্যায় সীমিত পরিসরে সম্প্রচার শুরু করে চ্যানেল দুটি। ওই ভবনে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিকল্প জেনারেটর দিয়ে আরটিভি সম্প্রচার শুরু করে। তেজগাঁওয়ে অবস্থিত অন্য একটি টেলিভিশন চ্যানেলের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পুনরায় সম্প্রচারে আসে এনটিভি। অগ্নিকাণ্ডে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ঘটনা তদন্তে পৃথক দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদিকে আমার দেশ কার্যালয়টি স্থানান্তরের দিনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে রহস্যজনক বলে মনে করছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। এ ছাড়া আমার দেশ কার্যালয়ের পাশে ব্যারিস্টার তানজিব-উল-আলম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস-এর কার্যালয় কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুন নেভাতে দুই ল্যাডার ব্যবহার করে ফায়ার সার্ভিস। ঘটনার খবর শুনে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
আগুনের উৎস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগে।
ভবনের উপরের তলায় আগুন লাগায় ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে লোকজন নিরাপদে বাইরে বেরিয়ে আসেন। এ কারণে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আগুনের ঘটনার পরপরই কাওরান বাজারের বিএসইসি ভবনের চারপাশে হাজার হাজার উৎসুক মানুষ ভিড় করতে থাকে। একপর্যায়ে ফার্মগেট থেকে শাহবাগগামী সড়ক কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছুটে আসেন। উৎসুক মানুষের ভিড় সামলাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বেগ পেতে হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা জানান, গতকাল দুপুর ১১টা ৪৮ মিনিটে কাওরান বাজারের ১০২, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউয়ের বিএসইসি ভবনের ১১ তলার দৈনিক আমার দেশ কার্যালয়ের পূর্ব-দক্ষিণ কোনের স্টোর রুমে আগুনের সূত্রপাত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী আমার দেশের পিয়ন আব্বাস আলী জানান, আমার দেশ কার্যালয় গুলশানের নিকেতনের এক নম্বর সড়কে স্থানান্তর করার কাজ চলছিল। শুক্রবার তারা কয়েকটি এসি ও চেয়ার টেবিল নিয়ে যাচ্ছিলেন। আলী নামে এসি টেকনিশয়ান বলেন, বৈদ্যুতিক লাইনে হঠাৎ আগুন লাগার পর তারা কার্যালয়ের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ করে দেন। কিন্তু ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে তারা কার্যালয় থেকে নিজেরা নিরাপদে বেরিয়ে আসেন। দৈনিক আমার দেশের বৈদ্যুতিক অপারেটর আহমদ আলী জানান, দুপুর পৌনে ১২টায় অফিসের পূর্বপাশের ছোট স্টোর রুমের পাশে বৈদ্যুতিক তারে স্পার্কিং হওয়ার শব্দ শোনেন। এরপর ধোঁয়া বের হতে দেখেন। পরে তাদের বোতলে থাকা পানি দিয়ে তা নিভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু, ধোঁয়ার মাত্রা না কমে আস্তে আস্তে বেশি হতে দেখে আতঙ্কে তারা নিচে নেমে আসেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুনের সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে আমার দেশ কার্যালয়ে প্রচণ্ড ধোঁয়া সৃষ্টি হয়। ধোঁয়া বের হতে দেখে ওই ভবনে থাকা বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও চিৎকার করতে থাকেন। এ সময় ভবনের নিচ তলায় থাকা নিরাপত্তারক্ষীরা অ্যালার্ম বাজান। এতে পুরো ভবনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ভবনে থাকা কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যে যার মতো নিচে নেমে আসেন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে দুই ঘণ্টার বেশি সময় চেষ্টা চালিয়ে ১টা ৫৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর মাহাবুবুর রহমান জানান, আগুন লাগা অবস্থায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে আসেন। আগুন ওপর থেকে আর নিচে যেন নেমে না আসে এজন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হয়েছিল। প্রায় ১০০ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী আগুন নির্বাপণে অংশ নেন। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান বলেন, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগুন লাগার কক্ষে পত্রপত্রিকা ছিল। এতে আগুনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ভবনে আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতি কার্যকর ছিল না। তদন্ত সাপেক্ষে এই আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয় করা হবে।
সব পুড়ে ছাই
গতকাল বিকালে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বিএসইসি ভবনের এগার তলায় সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, আগুনে পুরো আমার দেশ কার্যালয় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এগার তলার সিঁড়ি দিয়ে উঠলে হাতের ডান দিকে আমার দেশের বিজ্ঞাপন, প্রশাসন, হিসাব বিভাগ, মার্কেটিং বিভাগ, স্টোর রুম ও একটি কনফারেন্স কক্ষ। যেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসার টেবিল চেয়ার ছিল সেখানে দেখা যায় কয়লার স্তূপ। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। স্টোর রুম ভর্তি ছিল বাণ্ডিল বাণ্ডিল পুরনো পত্রিকা। সেসব এখন ছাই। কনফারেন্স রুমে এসির খাঁচাগুলো পড়ে আছে। মেঝেতে ছড়ানো ছিটানো কয়লার স্তূপ আর আধপোড়া পত্রিকা, বই-খাতা। সিলিং পুড়ে পরিষ্কার ছাদ দেখা যাচ্ছে। বিকালের দিকেও কার্যালয়ের ভেতরে উত্তাপ পাওয়া যাচ্ছিল। মেঝেতে আগুন নিয়ন্ত্রণে ঢালা ফায়ার সার্ভিসের পানি জমে ছিল। এই কক্ষ থেকে সরু করিডর দিয়ে পশ্চিম দিকে ঢুকলেই প্রথমে পড়ে আমার দেশের নিউজ ডেস্ক। তার পরই দক্ষিণ দিকে বার্তা বিভাগের সারি সারি টেবিল-চেয়ার সাজানো। প্রায় প্রতিটি টেবিলেই রয়েছে কম্পিউটার। তবে এসব আধপোড়া হয়ে আছে। টেবিল চেয়ারগুলোও আধপোড়া। জানালার কাঁচ পুড়ে গেছে। গলে ঝুলে আছে অ্যালমুনিয়াম। বার্তা বিভাগের পাশ দিয়ে যেসব ছোট ছোট কক্ষ ছিল, যেখানে ঊর্ধ্বতনরা বসতেন পুড়ে গেছে সেসবও। বার্তা বিভাগের সিলিং খুলে পড়েছে কোথাও কোথাও। দৈনিক আমার দেশের নগর সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জানান, কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আগুনে অন্তত শতাধিক কম্পিউটার, দলিল-দস্তাবেজ, একাউন্টসসহ অন্যান্য বিভাগের হিসাবপত্রের কাগজ, সার্ভার রুমসহ সব শেষ হয়ে গেছে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কার্যালয়ের ৩১টি এসি। যেগুলো কার্যালয় স্থানান্তরের জন্য খুলে কনফারেন্স রুমে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, যেই স্টোর রুমে আগুনের সূত্রপাত বলে ধরা হচ্ছে সেখানে বৈদ্যুতিক তারের কোন চিহ্নই নেই।
দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা
বিএসইসি ভবনের আমার দেশ কার্যালয়ে আগুনের ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত নাশকতা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমার দেশ সংশ্লিষ্টরা জানান, পত্রিকাটির কার্যালয় স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছিল। বিএসইসি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এগার তলার এই ফ্লোরটি ভাড়া নিয়েছিলেন আমার দেশ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বিপুল পরিমাণ ভাড়া বাকি পড়ায় কার্যালয় স্থানান্তরে মালামাল নিতে বাধা দেয় বিএসইসি কর্তৃপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার দুই পক্ষ বৈঠকের পর বিএসইসি কর্তৃপক্ষ কিছু মালামাল নেয়ার অনুমতি দেয়। এজন্য গতকাল কয়েকটি এসি ও কিছু চেয়ার-টেবিল নেয়া হচ্ছিল। আমার দেশ-এর নির্বাহী সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ বলেন, সরকারের রোষানলে পড়ে আমার দেশ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভাড়া পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছিল না। এজন্য কার্যালয় স্থানান্তর করা হচ্ছিল। এই ভবনে (বিএসইসি) শেষ কার্যদিবসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি রহস্যজনক। এটি সাধারণ কোন অগ্নিকাণ্ড বলে মনে হচ্ছে না। আমার দেশ’র নগর সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, এটা পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড। আমার দেশকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে আগুন দেয়া হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে গতকাল বিকালে ঘটনাস্থলে যান বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনিও বলেন, একই সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের কার্যালয়ে বারবার আগুনের ঘটনা ঘটছে। এটা যেমন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর আঘাত হানছে তেমনি গণমাধ্যমকে ধ্বংসের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, আমি এখানে এসে যা শুনলাম তাতে মনে হয়েছে এটি পরিকল্পিত ঘটনা। আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান দুই বছর ধরে জেলে রয়েছেন। পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আর কাকতলীয়ভাবে তার পত্রিকাতেই বারবার আঘাত আসার কারণে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। মির্জা ফখরুল এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেন।
শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, অনেকেই ইন্স্যুরেন্সের টাকার জন্য নিজেরাই আগুন লাগিয়ে থাকে। এখানে সে রকম কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। আমির হোসেন আমু বলেন, এটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কিভাবে ঘটেছে বা কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা তদন্তের মাধ্যমে বের করে সরকারের তরফে সম্ভাব্য সবকিছু করা হবে। এদিকে বিকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ফায়ার সার্ভিসের সরঞ্জামের স্বল্পতার কারণে আগে নয় তলার ওপরে গিয়ে আগুন নেভানো সম্ভব হতো না। এখন সরঞ্জাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে আজকের ঘটনা ১১ তলায় হলেও কম সময়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সরকার বিষয়টি কিভাবে দেখছে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের দেখার কিছু নেই। এখানে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। আগুন নির্বাপণের প্রাথমিক ব্যবস্থা তারা নিজেরা রাখে। তিনি বলেন, আমি শুনলাম এখানে অনেক কাগজ ছিল। আর কাগজের আগুন নেভাতে সময় লাগে।
ধোঁয়া দেখে সবাই নেমে আসি
বিএসইসি ভবনের ষষ্ঠ, সপ্তম ও নমব তলার একাংশে রয়েছে বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভি’র কার্যালয়। এনটিভি’র সিনিয়র রিপোর্টার দিদার চৌধুরী বলেন, এই ভবনে বারবার আগুন লাগায় এখন আগুনের খবর শোনামাত্র সবাই নিচে নেমে আসে। এজন্য উপর থেকে ধোঁয়া আসছিল এবং কেউ একজন আগুনের কথা বলামাত্র সবাই নিরাপদে নিচে নেমে আসি। আরেক সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট চয়ন রহমান বলেন, আমি ভবেনর সাত তলায় অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ শুনি আগুন আগুন বলে আওয়াজ হচ্ছে। ধোঁয়ায় চারদিক আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। এরপরই বুঝতে পারি ভবনে আগুন লেগেছে। পরে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসি। একই টিভি’র স্টাফ রিপোর্টার তানজীব সুমন জানান, ভবনের চতুর্থ তলায় এনটিভি’র কনফারেন্স কক্ষে এনটিভি’র রিপোর্টারদের নিয়ে একটি প্রশিক্ষণের অনুষ্ঠান চলছিল। প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন দৈনিক মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। এ সময় অফিসের এক পিয়ন আমাদেরকে জানায় যে, ভবনে আগুন লেগেছে। এরপরই আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নিমে আসি। এনটিভি’র সিনিয়র মেকাপম্যান ইমন ও মেকাপম্যান মাসুম বলেন, আমরা একটি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি চারদিক থেকে ধোঁয়া আসছে। প্রাথমিক অবস্থায় বিষয়টি আমরা বুঝতে পারিনি। কিন্তু ভবনের নিচে তাকিয়ে দেখি রাস্তায় অনেক মানুষ উন্মুখ হয়ে আমাদের ভবনের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। তখনই বুঝতে পারি ভবনে আগুন লেগেছে। কিন্তু কোথায় বা কোন তলায় লেগেছে তা বুঝতে পারিনি। অতঃপর আর দেরি না করে ভবনের পিছনের বিকল্প সিঁড়ি দিয়ে আমরা দ্রুত নিচে নেমে আসার সময় ভবনের পিছনে উত্তর দিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখি। এ সময় অন্যদেরও নামার জন্য চিৎকার করে ডাকতে থাকি। আরটিভি’র বার্তা সম্পাদক আনোয়ার হোসেন জানান, সকাল থেকে নিউজের কাজ করছিলাম। আগুনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ভবনের বাম পাশের স্টিল দিয়ে তৈরি বিশেষ সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাই।
আগুনের ঘটনায় দুই কমিটি: বিএসইসি ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা) মিজানুর রহমানকে প্রধান করে এই কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমানকে। কমিটিকে আগামী সাত কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ফায়ার সূত্র জানায়, তদন্ত কমিটি আগুনের সূত্রপাত ও ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করবেন। এদিকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে বিএসইসি কর্তৃপক্ষ পাঁচ সদস্যের পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির প্রধান করা হয়েছে বিএসইসি’র পরিচালক (অর্থ) মোজাম্মেল হক ও সদস্য সচিব করা হয়েছে প্রধান প্রকৌশলী তাজুল ইসলামকে। বিএসইসি’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইমতিয়াজ হোসেন চৌধুরী বলেন, ভবনে সব ধরনের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল। এর আগে আগুন লাগার পর তদন্ত কমিটি যেসব সুপারিশ করেছিল তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটি আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান করবে।
বিশেষ ব্যবস্থায় সম্প্রচারে এনটিভি ও আরটিভি
বিশেষ ব্যবস্থায় সম্প্রচার শুরু করেছে এনটিভি ও আরটিভি। অগ্নিকাণ্ডের কারণে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে চ্যানেল দুটির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর থেকে অন্য একটি টেলিভিশন চ্যানেলের আর্থ স্টেশন ব্যবহার করে সম্প্রচারে ফেরে এনটিভি। অন্যদিকে আরটিভি জেনারেটরের মাধ্যমে সম্প্রচার কার্যক্রম চালাচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডের কারণে ভবনের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। একই সঙ্গে টিভি চ্যানেল দু’টির সম্প্রচার ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ভবনে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সচল হয়নি। এনটিভির বার্তা সম্পাদক সীমান্ত খোকন জানান, বিকল্প ব্যবস্থায় তেজগাঁওয়ে চ্যানেল নাইনের আর্থ স্টেশন ব্যবহার করে বিকালে সম্প্রচারে আসে এনটিভি। প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ওই চ্যানেলের অফিসেই গতকাল কাজ করেছেন। তিনি জানান, নিজস্ব আর্থ স্টেশন ব্যবহার করে সম্প্রচারে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০০৭ সালে ২৬শে ফেব্রুয়ারি বিএসইসি ভবনে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে এনটিভি, আরটিভি ও দৈনিক আমার দেশ আগুনে পুড়ে যায়। ওই আগুনের ঘটনায় প্রায় ৩ মাস এনটিভি ও আরটিভি সম্পচার বন্ধ ছিল। দৈনিক আমার দেশ অন্য প্রেস থেকে প্রকাশিত হচ্ছিল।
একই তলায় থাকা অন্য দুটি প্রতিষ্ঠানেও ব্যাপক ক্ষতি হয়। ওই ভবনে থাকা এনটিভি ও আরটিভি’র সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। চ্যানেল দুটির সম্প্রচার ব্যবস্থা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর সন্ধ্যায় সীমিত পরিসরে সম্প্রচার শুরু করে চ্যানেল দুটি। ওই ভবনে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিকল্প জেনারেটর দিয়ে আরটিভি সম্প্রচার শুরু করে। তেজগাঁওয়ে অবস্থিত অন্য একটি টেলিভিশন চ্যানেলের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পুনরায় সম্প্রচারে আসে এনটিভি। অগ্নিকাণ্ডে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ঘটনা তদন্তে পৃথক দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদিকে আমার দেশ কার্যালয়টি স্থানান্তরের দিনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে রহস্যজনক বলে মনে করছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। এ ছাড়া আমার দেশ কার্যালয়ের পাশে ব্যারিস্টার তানজিব-উল-আলম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস-এর কার্যালয় কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুন নেভাতে দুই ল্যাডার ব্যবহার করে ফায়ার সার্ভিস। ঘটনার খবর শুনে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
আগুনের উৎস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগে।
ভবনের উপরের তলায় আগুন লাগায় ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে লোকজন নিরাপদে বাইরে বেরিয়ে আসেন। এ কারণে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আগুনের ঘটনার পরপরই কাওরান বাজারের বিএসইসি ভবনের চারপাশে হাজার হাজার উৎসুক মানুষ ভিড় করতে থাকে। একপর্যায়ে ফার্মগেট থেকে শাহবাগগামী সড়ক কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছুটে আসেন। উৎসুক মানুষের ভিড় সামলাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বেগ পেতে হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা জানান, গতকাল দুপুর ১১টা ৪৮ মিনিটে কাওরান বাজারের ১০২, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউয়ের বিএসইসি ভবনের ১১ তলার দৈনিক আমার দেশ কার্যালয়ের পূর্ব-দক্ষিণ কোনের স্টোর রুমে আগুনের সূত্রপাত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী আমার দেশের পিয়ন আব্বাস আলী জানান, আমার দেশ কার্যালয় গুলশানের নিকেতনের এক নম্বর সড়কে স্থানান্তর করার কাজ চলছিল। শুক্রবার তারা কয়েকটি এসি ও চেয়ার টেবিল নিয়ে যাচ্ছিলেন। আলী নামে এসি টেকনিশয়ান বলেন, বৈদ্যুতিক লাইনে হঠাৎ আগুন লাগার পর তারা কার্যালয়ের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ করে দেন। কিন্তু ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে তারা কার্যালয় থেকে নিজেরা নিরাপদে বেরিয়ে আসেন। দৈনিক আমার দেশের বৈদ্যুতিক অপারেটর আহমদ আলী জানান, দুপুর পৌনে ১২টায় অফিসের পূর্বপাশের ছোট স্টোর রুমের পাশে বৈদ্যুতিক তারে স্পার্কিং হওয়ার শব্দ শোনেন। এরপর ধোঁয়া বের হতে দেখেন। পরে তাদের বোতলে থাকা পানি দিয়ে তা নিভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু, ধোঁয়ার মাত্রা না কমে আস্তে আস্তে বেশি হতে দেখে আতঙ্কে তারা নিচে নেমে আসেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুনের সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে আমার দেশ কার্যালয়ে প্রচণ্ড ধোঁয়া সৃষ্টি হয়। ধোঁয়া বের হতে দেখে ওই ভবনে থাকা বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও চিৎকার করতে থাকেন। এ সময় ভবনের নিচ তলায় থাকা নিরাপত্তারক্ষীরা অ্যালার্ম বাজান। এতে পুরো ভবনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ভবনে থাকা কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যে যার মতো নিচে নেমে আসেন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে দুই ঘণ্টার বেশি সময় চেষ্টা চালিয়ে ১টা ৫৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর মাহাবুবুর রহমান জানান, আগুন লাগা অবস্থায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে আসেন। আগুন ওপর থেকে আর নিচে যেন নেমে না আসে এজন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হয়েছিল। প্রায় ১০০ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী আগুন নির্বাপণে অংশ নেন। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান বলেন, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগুন লাগার কক্ষে পত্রপত্রিকা ছিল। এতে আগুনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ভবনে আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতি কার্যকর ছিল না। তদন্ত সাপেক্ষে এই আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয় করা হবে।
সব পুড়ে ছাই
গতকাল বিকালে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বিএসইসি ভবনের এগার তলায় সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, আগুনে পুরো আমার দেশ কার্যালয় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এগার তলার সিঁড়ি দিয়ে উঠলে হাতের ডান দিকে আমার দেশের বিজ্ঞাপন, প্রশাসন, হিসাব বিভাগ, মার্কেটিং বিভাগ, স্টোর রুম ও একটি কনফারেন্স কক্ষ। যেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসার টেবিল চেয়ার ছিল সেখানে দেখা যায় কয়লার স্তূপ। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। স্টোর রুম ভর্তি ছিল বাণ্ডিল বাণ্ডিল পুরনো পত্রিকা। সেসব এখন ছাই। কনফারেন্স রুমে এসির খাঁচাগুলো পড়ে আছে। মেঝেতে ছড়ানো ছিটানো কয়লার স্তূপ আর আধপোড়া পত্রিকা, বই-খাতা। সিলিং পুড়ে পরিষ্কার ছাদ দেখা যাচ্ছে। বিকালের দিকেও কার্যালয়ের ভেতরে উত্তাপ পাওয়া যাচ্ছিল। মেঝেতে আগুন নিয়ন্ত্রণে ঢালা ফায়ার সার্ভিসের পানি জমে ছিল। এই কক্ষ থেকে সরু করিডর দিয়ে পশ্চিম দিকে ঢুকলেই প্রথমে পড়ে আমার দেশের নিউজ ডেস্ক। তার পরই দক্ষিণ দিকে বার্তা বিভাগের সারি সারি টেবিল-চেয়ার সাজানো। প্রায় প্রতিটি টেবিলেই রয়েছে কম্পিউটার। তবে এসব আধপোড়া হয়ে আছে। টেবিল চেয়ারগুলোও আধপোড়া। জানালার কাঁচ পুড়ে গেছে। গলে ঝুলে আছে অ্যালমুনিয়াম। বার্তা বিভাগের পাশ দিয়ে যেসব ছোট ছোট কক্ষ ছিল, যেখানে ঊর্ধ্বতনরা বসতেন পুড়ে গেছে সেসবও। বার্তা বিভাগের সিলিং খুলে পড়েছে কোথাও কোথাও। দৈনিক আমার দেশের নগর সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জানান, কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আগুনে অন্তত শতাধিক কম্পিউটার, দলিল-দস্তাবেজ, একাউন্টসসহ অন্যান্য বিভাগের হিসাবপত্রের কাগজ, সার্ভার রুমসহ সব শেষ হয়ে গেছে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কার্যালয়ের ৩১টি এসি। যেগুলো কার্যালয় স্থানান্তরের জন্য খুলে কনফারেন্স রুমে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, যেই স্টোর রুমে আগুনের সূত্রপাত বলে ধরা হচ্ছে সেখানে বৈদ্যুতিক তারের কোন চিহ্নই নেই।
দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা
বিএসইসি ভবনের আমার দেশ কার্যালয়ে আগুনের ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত নাশকতা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমার দেশ সংশ্লিষ্টরা জানান, পত্রিকাটির কার্যালয় স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছিল। বিএসইসি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এগার তলার এই ফ্লোরটি ভাড়া নিয়েছিলেন আমার দেশ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বিপুল পরিমাণ ভাড়া বাকি পড়ায় কার্যালয় স্থানান্তরে মালামাল নিতে বাধা দেয় বিএসইসি কর্তৃপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার দুই পক্ষ বৈঠকের পর বিএসইসি কর্তৃপক্ষ কিছু মালামাল নেয়ার অনুমতি দেয়। এজন্য গতকাল কয়েকটি এসি ও কিছু চেয়ার-টেবিল নেয়া হচ্ছিল। আমার দেশ-এর নির্বাহী সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ বলেন, সরকারের রোষানলে পড়ে আমার দেশ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভাড়া পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছিল না। এজন্য কার্যালয় স্থানান্তর করা হচ্ছিল। এই ভবনে (বিএসইসি) শেষ কার্যদিবসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি রহস্যজনক। এটি সাধারণ কোন অগ্নিকাণ্ড বলে মনে হচ্ছে না। আমার দেশ’র নগর সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, এটা পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড। আমার দেশকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে আগুন দেয়া হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে গতকাল বিকালে ঘটনাস্থলে যান বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনিও বলেন, একই সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের কার্যালয়ে বারবার আগুনের ঘটনা ঘটছে। এটা যেমন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর আঘাত হানছে তেমনি গণমাধ্যমকে ধ্বংসের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, আমি এখানে এসে যা শুনলাম তাতে মনে হয়েছে এটি পরিকল্পিত ঘটনা। আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান দুই বছর ধরে জেলে রয়েছেন। পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আর কাকতলীয়ভাবে তার পত্রিকাতেই বারবার আঘাত আসার কারণে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। মির্জা ফখরুল এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেন।
শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, অনেকেই ইন্স্যুরেন্সের টাকার জন্য নিজেরাই আগুন লাগিয়ে থাকে। এখানে সে রকম কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। আমির হোসেন আমু বলেন, এটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কিভাবে ঘটেছে বা কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা তদন্তের মাধ্যমে বের করে সরকারের তরফে সম্ভাব্য সবকিছু করা হবে। এদিকে বিকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ফায়ার সার্ভিসের সরঞ্জামের স্বল্পতার কারণে আগে নয় তলার ওপরে গিয়ে আগুন নেভানো সম্ভব হতো না। এখন সরঞ্জাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে আজকের ঘটনা ১১ তলায় হলেও কম সময়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সরকার বিষয়টি কিভাবে দেখছে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের দেখার কিছু নেই। এখানে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। আগুন নির্বাপণের প্রাথমিক ব্যবস্থা তারা নিজেরা রাখে। তিনি বলেন, আমি শুনলাম এখানে অনেক কাগজ ছিল। আর কাগজের আগুন নেভাতে সময় লাগে।
ধোঁয়া দেখে সবাই নেমে আসি
বিএসইসি ভবনের ষষ্ঠ, সপ্তম ও নমব তলার একাংশে রয়েছে বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভি’র কার্যালয়। এনটিভি’র সিনিয়র রিপোর্টার দিদার চৌধুরী বলেন, এই ভবনে বারবার আগুন লাগায় এখন আগুনের খবর শোনামাত্র সবাই নিচে নেমে আসে। এজন্য উপর থেকে ধোঁয়া আসছিল এবং কেউ একজন আগুনের কথা বলামাত্র সবাই নিরাপদে নিচে নেমে আসি। আরেক সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট চয়ন রহমান বলেন, আমি ভবেনর সাত তলায় অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ শুনি আগুন আগুন বলে আওয়াজ হচ্ছে। ধোঁয়ায় চারদিক আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। এরপরই বুঝতে পারি ভবনে আগুন লেগেছে। পরে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসি। একই টিভি’র স্টাফ রিপোর্টার তানজীব সুমন জানান, ভবনের চতুর্থ তলায় এনটিভি’র কনফারেন্স কক্ষে এনটিভি’র রিপোর্টারদের নিয়ে একটি প্রশিক্ষণের অনুষ্ঠান চলছিল। প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন দৈনিক মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। এ সময় অফিসের এক পিয়ন আমাদেরকে জানায় যে, ভবনে আগুন লেগেছে। এরপরই আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নিমে আসি। এনটিভি’র সিনিয়র মেকাপম্যান ইমন ও মেকাপম্যান মাসুম বলেন, আমরা একটি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি চারদিক থেকে ধোঁয়া আসছে। প্রাথমিক অবস্থায় বিষয়টি আমরা বুঝতে পারিনি। কিন্তু ভবনের নিচে তাকিয়ে দেখি রাস্তায় অনেক মানুষ উন্মুখ হয়ে আমাদের ভবনের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। তখনই বুঝতে পারি ভবনে আগুন লেগেছে। কিন্তু কোথায় বা কোন তলায় লেগেছে তা বুঝতে পারিনি। অতঃপর আর দেরি না করে ভবনের পিছনের বিকল্প সিঁড়ি দিয়ে আমরা দ্রুত নিচে নেমে আসার সময় ভবনের পিছনে উত্তর দিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখি। এ সময় অন্যদেরও নামার জন্য চিৎকার করে ডাকতে থাকি। আরটিভি’র বার্তা সম্পাদক আনোয়ার হোসেন জানান, সকাল থেকে নিউজের কাজ করছিলাম। আগুনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ভবনের বাম পাশের স্টিল দিয়ে তৈরি বিশেষ সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাই।
আগুনের ঘটনায় দুই কমিটি: বিএসইসি ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা) মিজানুর রহমানকে প্রধান করে এই কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমানকে। কমিটিকে আগামী সাত কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ফায়ার সূত্র জানায়, তদন্ত কমিটি আগুনের সূত্রপাত ও ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করবেন। এদিকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে বিএসইসি কর্তৃপক্ষ পাঁচ সদস্যের পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির প্রধান করা হয়েছে বিএসইসি’র পরিচালক (অর্থ) মোজাম্মেল হক ও সদস্য সচিব করা হয়েছে প্রধান প্রকৌশলী তাজুল ইসলামকে। বিএসইসি’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইমতিয়াজ হোসেন চৌধুরী বলেন, ভবনে সব ধরনের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল। এর আগে আগুন লাগার পর তদন্ত কমিটি যেসব সুপারিশ করেছিল তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটি আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান করবে।
বিশেষ ব্যবস্থায় সম্প্রচারে এনটিভি ও আরটিভি
বিশেষ ব্যবস্থায় সম্প্রচার শুরু করেছে এনটিভি ও আরটিভি। অগ্নিকাণ্ডের কারণে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে চ্যানেল দুটির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর থেকে অন্য একটি টেলিভিশন চ্যানেলের আর্থ স্টেশন ব্যবহার করে সম্প্রচারে ফেরে এনটিভি। অন্যদিকে আরটিভি জেনারেটরের মাধ্যমে সম্প্রচার কার্যক্রম চালাচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডের কারণে ভবনের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। একই সঙ্গে টিভি চ্যানেল দু’টির সম্প্রচার ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ভবনে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সচল হয়নি। এনটিভির বার্তা সম্পাদক সীমান্ত খোকন জানান, বিকল্প ব্যবস্থায় তেজগাঁওয়ে চ্যানেল নাইনের আর্থ স্টেশন ব্যবহার করে বিকালে সম্প্রচারে আসে এনটিভি। প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ওই চ্যানেলের অফিসেই গতকাল কাজ করেছেন। তিনি জানান, নিজস্ব আর্থ স্টেশন ব্যবহার করে সম্প্রচারে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০০৭ সালে ২৬শে ফেব্রুয়ারি বিএসইসি ভবনে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে এনটিভি, আরটিভি ও দৈনিক আমার দেশ আগুনে পুড়ে যায়। ওই আগুনের ঘটনায় প্রায় ৩ মাস এনটিভি ও আরটিভি সম্পচার বন্ধ ছিল। দৈনিক আমার দেশ অন্য প্রেস থেকে প্রকাশিত হচ্ছিল।
Comments
Post a Comment