হিজাব খোলাটাকে চরম আদালত অবমাননা রূপে গণ্য করা হয়। রাগে দুঃখে আতেফা আদালতকে আরো অপমান করে। একপর্যায়ে সে তার জুতা খুলে বিচারককে ছুড়ে মারে। এরপর বিচারক তাকে ব্যভিচার ও ‘কুমারিত্বের বিরুদ্ধে অপরাধের’ দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেন?

সাম্প্রতিক কালে ইরান স্বদেশে ও বিদেশে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয় ১৬ বছরের কিশোরী আতেফা রাজাবি সালেহ-কে ফাসি দেওয়ায়।
আতেফার বয়স যখন পাচ তখন তার মা একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। এর কয়েক দিন পরে তার ছোট ভাই নদীর পানিতে ডুবে মারা যায়। শোকে দুঃখে আতেফার পিতা ড্রাগস আসক্ত হয়ে পড়ে। আশি উর্ধ দাদা-দাদিকে দেখাশোনার দায়িত্ব কিশোরী আতেফাকে নিতে হয়। কিন্তু এই পরিচর্যার বিনিময়ে কোনো দিনই কোনো মায়া-মমতা ওই বৃদ্ধ জুটি দেখাননি আতেফার প্রতি। আতেফা বেড়ে ওঠে ইরানের নেকা শহরে যেখানে সে পরিচিত হয় বু্রিমতি ও প্রাণোচ্ছল মেয়ে হিসেবে। বাড়িতে তার কোনো বন্ধন ছিল না। তাই সে প্রায়ই পথে ঘুরে বেড়াত।
আতেফার এই আচরণের সুযোগ নিয়ে ৫১ বছর বয়সী এক পুরুষ তাকে ধর্ষণ করে। আলি দারাবি নামে এই পুরুষটি এক সময়ে বিপ্লবী সেনাবাহিনীতে কাজ করত। পরে ট্যাক্সি ড্রাইভার হয়েছিল। সে বিবাহিত ছিল এবং তার ছেলেমেয়ে ছিল।
আতেফাকে একবার ধর্ষণ করে আলি দারাবি থেমে যায়নি। সে বুঝেছিল গভীর লজ্জায় বিষয়টি আতেফা কাউকে খুলে বলতে পারবে না। এমনকি তার দাদা-দাদিকেও নয়। (বাংলাদেশেও বহু ধর্ষিতা নারী কলংকিনী রূপে সমাজে অপমানিত হবার আশংকায়, ধর্ষণ এবং ধারাবাহিক ধর্ষণের ঘটনা আজীবন গোপন রাখেন।)
এরপর আলি দারাবি টানা তিন বছর আতেফাকে ধর্ষন এবং বিভিন্ন ধরনের যৌন টর্চার করে যায়। বিষয়টি পুলিশ জানার পরে আতেফাকে গ্রেফতার করে। তখন জেলে থাকা অবস্থায় আতেফা তার দাদিকে ঘটনাটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলে। আতেফা বলে তাকে আলি দারাবি এত যৌন অত্যাচার করতো যে এক সময়ে সে ব্যথায় হাটাচলা করতে পারত না। হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হতো।
আদালতে বিচারক ছিলেন হাজি রেজাই। আতেফা যখন বুঝতে পারে যে বিচারক তার কথা বিশ্বাস করছেন না এবং ফলে তার শাস্তি হবেই, তখন সে তার হিজাব খুলে বলে, শাস্তি হওয়া উচিত আলি দারাবির —তার নয়।
ইরানে হিজাব খোলাটাকে চরম আদালত অবমাননা রূপে গণ্য করা হয়। রাগে দুঃখে আতেফা আদালতকে আরো অপমান করে। একপর্যায়ে সে তার জুতা খুলে বিচারককে ছুড়ে মারে। এরপর বিচারক তাকে ব্যভিচার ও ‘কুমারিত্বের বিরুদ্ধে অপরাধের’ দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেন।
রায়টি আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র সমালোচিত হয়। কারণ ‘নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি’-তে (ওহঃবত্হধঃরড়হধষ ঈড়াবহধহঃ ড়হ ঈরারষ ধহফ চড়ষরঃরপধষ জরমযঃং) ইরান অন্যতম স্বাক্ষরদাতা দেশ যেখানে ১৮ অনূর্ধ্ব কাউকে মৃত্যুদণ্ড না দিতে ইরান অঙ্গীকার আবদ্ধ।
আতেফার আত্মীয়-স্বজন যখন মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে সুপৃম কোর্টে আপিল করেন তখন কর্তৃপক্ষ একটি নতুন কৌশল করে। বিবিসি জানায়, সুপৃম কোর্টে যেসব নথিপত্র পুলিশ জমা দেয় তাতে দেখানো হয় আতেফার বয়স ২২। কিন্তু আতেফার বার্থ (জন্ম) সার্টিফিকেটে এবং ডেথ (মৃত্যু, ১৫ আগস্ট ২০০৪) সার্টিফিকেটে তার বয়স ছিল ১৬।
চূড়ান্ত রায়ের সাত দিন পরেই নেকা শহরে নির্মীয়মান একটি ভবনের পাশে উচু ক্রেইন থেকে ফাসিতে ঝুলিয়ে প্রকাশ্যে আতেফার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। অভিযোগ ওঠে, বিচারক হাজি রেজাই সেখানে এসে নিজের হাতে আতেফার গলায় ফাসির রশি পরিয়ে দিয়েছিলেন।
এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সহ বিশ্বজুড়ে অন্যান্য মানব অধিকার সংস্থাগুলো বলে হত্যাকাণ্ডটি হয়েছে মানবতার বিরুদ্ধে এবং এটি বিশ্বের শিশুদের প্রতি অপরাধ।
এই ঘটনাটির গুরুত্ব ও তাত্পর্য বুঝে বিবিসি একটি গোপন মুভি মেকিং টিম পাঠিয়ে দেয় ইরানে। সেখানে মুভি ডিরেক্টর মিজ মনিকা গার্নসি এবং সহ প্রযোজক আরাশ সাহামি গোপনে তথ্য সংগ্রহ করে একটি ডকুমুভি বানান। এছাড়া ডিসকভারি টিভি-ও “একজিকিউশন ইন ইরান” (ইরানে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া) নামে এক ঘণ্টার ডকুমুভি বানায়।
আন্তর্জাতিকভাবে ইরান খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাওয়ার ফলে কর্তৃপক্ষ নতুন তদন্ত করে। ইরানি মিডিয়া জানায় বিচারপতি রেজাই এবং ক্যাপ্টেন জাবিহি ও ক্যাপ্টেন মোলাইসহ কয়েকজন আধাসামরিক ব্যক্তিকে গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় গ্রেফতার করে।
এরপর ইরানের সুপৃম কোর্ট রায় দেন বিচারক রেজাই যথাযথভাবে মামলাটি পরিচালনা করেননি এবং আদেশ দেন আতেফাকে মুক্ত করে দিতে।
কিন্তু মরণোত্তর মুক্তির আদেশ বিশ্বে এটাই ছিল প্রথম। ইরানি আদালত কোনোদিনই বলেননি মরণোত্তর মুক্তির অর্থাত্ পুনর্জ্জীবিত করার আদেশ কিভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব।

Comments