মাই জার্নি ফ্রম হোমলেস টু হার্ভার্ড
সরকারি সামান্য ভাতার টাকা বাবা-মা কোকেন আর হেরোইন সেবন করে উড়িয়ে
দিতেন; লিজ ও তার বোনকে ক্ষুধার্ত রেখেই। শৈশবের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে
লিজ বলেন, ‘এমন দিন গেছে, যখন আমরা খাবারের অভাবে বরফের টুকরো চুষে
খেয়েছি, যেন মনে করতে পারি কিছু তো খাচ্ছি। ক্ষুধায় দুবোন ভাগাভাগি করে
টুথপেস্টও খেয়েছি।’ প্রতিবেশীদের কাছে খাবার ভিক্ষা করে বেড়াতেন তিনি,
মাঝেমধ্যে খাবার চুরি করেও খেতেন। এখন নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সর্বাধিক
বিক্রীত বইয়ের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে তাঁর লেখা বই মাই জার্নি ফ্রম
হোমলেস টু হার্ভার্ড।
মাদকাসক্তি আর তীব্র দারিদ্র্য লিজের বাবা-মাকে সম্পূর্ণ অসহায় করে ফেলেছিল, সন্তানদের প্রতি কোনো দায়িত্ব তাঁরা পালন করতে পারেননি। মেয়ের জন্মদিনের উপহার, ঘরের টেলিভিশন, এমনকি উৎসবের দিনে গির্জা থেকে পাওয়া টার্কিটিও তার মা বিক্রি করে দিয়েছিলেন; কোকেন কিনতে হবে যে! লিজের মাথাভর্তি ছিল উকুন, সহপাঠীরা বলত, তার শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এভাবে বেশি দিন স্কুলে টিকতে না পেরে ছোট্ট লিজ স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
লিজের মা বলতেন, ‘একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে,’ বলতে বলতেই বমি করে ফেলতেন কিংবা সারা দিন মৃতপ্রায় হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতেন, তত দিনে তার সারা বাহুতে সুচের দাগ। লিজের বয়স যখন ১৫, তখন তার মায়ের এইডস রোগ ধরা পড়ে। এরপর তিনি আর বেশি দিন বাঁচেননি। তাঁর মৃতদেহ রাখার কফিনটিও ছিল কোনো একজনের দান করা।
মায়ের মৃত্যুর পর লিজের ঠাঁই হয় শহরের পার্কের বেঞ্চগুলোয় আর দিন-রাত চালু থাকা রেলস্টেশনে। তিনি বলেন, ‘মায়ের মতো আমিও ভাবতাম, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই যখন চোখের সামনে মাকে মারা যেতে দেখলাম, তখন বুঝলাম আমাকে এই মুহূর্ত থেকেই সব ঠিক করতে হবে, নয়তো কোনো দিনই কিছু ঠিক হবে না।’
বহুদিন স্কুলের পড়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, তাও হাল ছাড়লেন না লিজ। একের পর এক স্কুলে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন, কিন্তু কেউই তাকে নিতে রাজি হচ্ছিল না। অবশেষে বহু কষ্টে ম্যানহাটনের হিউম্যানিটিস প্রিপারেটরি একাডেমিতে ভর্তি হলেন। শুরু হল এক নতুন সংগ্রাম। এক বছরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যতটা শেখে, তা এক টার্মের মধ্যেই শেষ করতে লাগলেন তিনি। এক শিক্ষকের চোখে পড়ল লিজের এই প্রাণান্তকর চেষ্টা আর অধ্যবসায়। তার সহায়তায় ও নির্দেশনায় দুই বছরের মাথায় কলেজের পড়া শেষ করে ফেললেন। সেই শিক্ষক একদিন লিজসহ তার সেরা ১০ শিক্ষার্থীকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরিয়ে দেখাতে নিয়ে গেলেন। এত বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে লিজের মতো মেয়ের ভয়ে বুক শুকিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু কেন যেন তার হার্ভার্ডের পরিবেশ দারুণ ভালো লেগে গেল, মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলেন এর স্থাপত্যশৈলীর দিকে। মনে মনে ঠিক করলেন, এখানেই পড়তে হবে, চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই সম্ভব। কিছুদিন পরেই জানতে পারলেন, নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা হার্ভার্ডে পড়ার জন্য বৃত্তি দেয়। ব্যস, পড়াশোনার জন্য তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
লিজের বাবা ২০০৬ সালে এইডসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। নিজে মাদকাসক্ত হলেও তিনি লাইব্রেরি থেকে বই চুরি করে মেয়েকে এনে দিতেন। বাবা হিসেবে মেয়েকে কিছু দিতে না পারলেও মেয়ের মনে তিনি পড়াশোনার প্রতি, সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলেছিলেন, এটিই ছিল তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা। অবশেষে ২০০৯ সালের জুনে হার্ভার্ড থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন লিজ। পরে আবার একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়ার জন্য। হার্ভার্ডে থাকার সময় তিনি বিভিন্ন স্থানে অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন, যেসব তরুণ-তরুণী তাঁর মতো সংগ্রাম করে টিকে আছেন, তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তিনি। অতঃপর তিনি ‘ম্যানিফেস্ট লিভিং’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, যা এমন মানুষের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মোন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে সাহায্য করে। তিনি এখন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বক্তা ও লেখক। তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র—হোমলেস টু হার্ভার্ড: দ্য লিজ মারি স্টোরি। অপরাহ উইনফ্রের কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেছেন, প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে দেখা করেছেন, এমনকি টনি ব্লেয়ার, মিখাইল গর্বাচেভ ও দালাই লামার মতো বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে একই অনুষ্ঠানে বক্তৃতাও করেছেন। লিজ কিশোর-কিশোরীদের মাদক ও অপরাধের চক্রে জড়িয়ে না পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। জানান, শৈশবের দুঃখ-কষ্ট-সংগ্রামের পরও চেষ্টা থাকলে ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করলে জীবনে সফল হওয়া যায়। এর বাস্তব উদাহরণ তিনি নিজে। একদিন রাস্তায় ছোট্ট লিজকে দেখে লোকজন মুখ ফিরিয়ে নিত, আর আজ তার স্থান অসংখ্য তরুণ-তরুণীর হৃদয়ে, যারা নিজের চেষ্টায় জীবন বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান www.theguardian.com এর নিবন্ধ অবলম্বনে
মাদকাসক্তি আর তীব্র দারিদ্র্য লিজের বাবা-মাকে সম্পূর্ণ অসহায় করে ফেলেছিল, সন্তানদের প্রতি কোনো দায়িত্ব তাঁরা পালন করতে পারেননি। মেয়ের জন্মদিনের উপহার, ঘরের টেলিভিশন, এমনকি উৎসবের দিনে গির্জা থেকে পাওয়া টার্কিটিও তার মা বিক্রি করে দিয়েছিলেন; কোকেন কিনতে হবে যে! লিজের মাথাভর্তি ছিল উকুন, সহপাঠীরা বলত, তার শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এভাবে বেশি দিন স্কুলে টিকতে না পেরে ছোট্ট লিজ স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
লিজের মা বলতেন, ‘একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে,’ বলতে বলতেই বমি করে ফেলতেন কিংবা সারা দিন মৃতপ্রায় হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতেন, তত দিনে তার সারা বাহুতে সুচের দাগ। লিজের বয়স যখন ১৫, তখন তার মায়ের এইডস রোগ ধরা পড়ে। এরপর তিনি আর বেশি দিন বাঁচেননি। তাঁর মৃতদেহ রাখার কফিনটিও ছিল কোনো একজনের দান করা।
মায়ের মৃত্যুর পর লিজের ঠাঁই হয় শহরের পার্কের বেঞ্চগুলোয় আর দিন-রাত চালু থাকা রেলস্টেশনে। তিনি বলেন, ‘মায়ের মতো আমিও ভাবতাম, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই যখন চোখের সামনে মাকে মারা যেতে দেখলাম, তখন বুঝলাম আমাকে এই মুহূর্ত থেকেই সব ঠিক করতে হবে, নয়তো কোনো দিনই কিছু ঠিক হবে না।’
বহুদিন স্কুলের পড়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, তাও হাল ছাড়লেন না লিজ। একের পর এক স্কুলে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন, কিন্তু কেউই তাকে নিতে রাজি হচ্ছিল না। অবশেষে বহু কষ্টে ম্যানহাটনের হিউম্যানিটিস প্রিপারেটরি একাডেমিতে ভর্তি হলেন। শুরু হল এক নতুন সংগ্রাম। এক বছরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যতটা শেখে, তা এক টার্মের মধ্যেই শেষ করতে লাগলেন তিনি। এক শিক্ষকের চোখে পড়ল লিজের এই প্রাণান্তকর চেষ্টা আর অধ্যবসায়। তার সহায়তায় ও নির্দেশনায় দুই বছরের মাথায় কলেজের পড়া শেষ করে ফেললেন। সেই শিক্ষক একদিন লিজসহ তার সেরা ১০ শিক্ষার্থীকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরিয়ে দেখাতে নিয়ে গেলেন। এত বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে লিজের মতো মেয়ের ভয়ে বুক শুকিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু কেন যেন তার হার্ভার্ডের পরিবেশ দারুণ ভালো লেগে গেল, মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলেন এর স্থাপত্যশৈলীর দিকে। মনে মনে ঠিক করলেন, এখানেই পড়তে হবে, চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই সম্ভব। কিছুদিন পরেই জানতে পারলেন, নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা হার্ভার্ডে পড়ার জন্য বৃত্তি দেয়। ব্যস, পড়াশোনার জন্য তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
লিজের বাবা ২০০৬ সালে এইডসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। নিজে মাদকাসক্ত হলেও তিনি লাইব্রেরি থেকে বই চুরি করে মেয়েকে এনে দিতেন। বাবা হিসেবে মেয়েকে কিছু দিতে না পারলেও মেয়ের মনে তিনি পড়াশোনার প্রতি, সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলেছিলেন, এটিই ছিল তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা। অবশেষে ২০০৯ সালের জুনে হার্ভার্ড থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন লিজ। পরে আবার একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়ার জন্য। হার্ভার্ডে থাকার সময় তিনি বিভিন্ন স্থানে অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন, যেসব তরুণ-তরুণী তাঁর মতো সংগ্রাম করে টিকে আছেন, তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তিনি। অতঃপর তিনি ‘ম্যানিফেস্ট লিভিং’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, যা এমন মানুষের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মোন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে সাহায্য করে। তিনি এখন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বক্তা ও লেখক। তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র—হোমলেস টু হার্ভার্ড: দ্য লিজ মারি স্টোরি। অপরাহ উইনফ্রের কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেছেন, প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে দেখা করেছেন, এমনকি টনি ব্লেয়ার, মিখাইল গর্বাচেভ ও দালাই লামার মতো বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে একই অনুষ্ঠানে বক্তৃতাও করেছেন। লিজ কিশোর-কিশোরীদের মাদক ও অপরাধের চক্রে জড়িয়ে না পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। জানান, শৈশবের দুঃখ-কষ্ট-সংগ্রামের পরও চেষ্টা থাকলে ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করলে জীবনে সফল হওয়া যায়। এর বাস্তব উদাহরণ তিনি নিজে। একদিন রাস্তায় ছোট্ট লিজকে দেখে লোকজন মুখ ফিরিয়ে নিত, আর আজ তার স্থান অসংখ্য তরুণ-তরুণীর হৃদয়ে, যারা নিজের চেষ্টায় জীবন বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান www.theguardian.com এর নিবন্ধ অবলম্বনে
Comments
Post a Comment