ডেমোক্র্যাসি নাউ
ডেমোক্র্যাসি নাউ’-এর জন্য নোয়াম চমস্কির এই সাাৎকার নিয়েছেন অ্যামি
গুডম্যান ও জুয়ান গঞ্জালেস। ম্যাসাচুসেটস টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের প্রফেসর
এমেরিটাস, বিশ্ববিখ্যাত রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী, ভাষাতত্ত্ববিদ, লেখক
নোয়াম চমস্কি এখন থেকে ৫০ বছর আগে কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা ইসরাইল-ফিলিস্তিন
দ্বন্দ্ব সম্পর্কে লিখেছেন বিস্তারিত। তার এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে চমস্কি
ফিলিস্তিন সমস্যার অনেক অনুদঘাটিত দিকের ওপর আলোকপাত করেছেন। সাক্ষাৎকারটির
অনুবাদ করেছেন মাসুমুর রহমান খলিলী। আজ প্রকাশ হলো এর দ্বিতীয় পর্ব
অ্যামি গুডম্যান : আমি ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কথায় আসতে চাই। তিনি গতকাল বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু : ১৫ জুলাই দেয়া মিসরীয়
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব ইসরাইল গ্রহণ করেছে আর হামাস তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
আর আমি আপনাদের জানাতে চাই তখন পর্যন্ত সঙ্ঘাতে নিহতের সংখ্যা ছিল ১৮৫। গত
সোমবার মাত্র হামাস সেই একই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে, গতকাল সকাল থেকে সেটি
কার্যকর হয়েছে। এর অর্থ হলো, এ সঙ্ঘাতে নিহতদের মধ্যে ৯০ শতাংশ, পূর্ণ ৯০
শতাংশ এড়ানো যেত হামাস এখন যে প্রস্তাবে রাজি হয়েছে তাতে তখন যদি হতো। এত
জীবনের বিয়োগাত্মক তির জন্য হামাসকে দায়ী হতে হবে।
অ্যামি গুডম্যান : নোয়াম চমস্কি, আপনি কি ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর এ বক্তব্যের উত্তর দিতে পারেন?
নোয়াম চমস্কি : [অস্পষ্ট] এর সংক্ষিপ্ত জবাব দেয়া যায়, আবার বলা যায়
বিস্তৃত। এ ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য হলো, নেতানিয়াহু অবশ্যই জানেন,
মিসরীয় সামরিক একনায়কতন্ত্র ও ইসরাইল মিলে এই যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব তৈরি
করেছে, তারা দু’পক্ষই হামাসের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। এ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব
সম্পর্কে হামাসকে আগে জানানো পর্যন্ত হয়নি। তারা সামাজিক মাধ্যম থেকে এটি
জানতে পেরেছে। স্বাভাবিকভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল ুব্ধ। তারা বলেছে, যেসব
শর্ত দেয়া হয়েছে তা গ্রহণ করবে না তারা। এটিই হলো এর সংক্ষিপ্ত জবাব।
এর বিস্তৃত জবাব হলো, ২০১২ সালের নভেম্বরের পর ক্রমাগতভাবে যুদ্ধবিরতি
যদি ইসরাইল লঙ্ঘন না করত তাহলে শতভাগ প্রাণক্ষয়, ধ্বসযজ্ঞ ও বিপর্যয় এড়ানো
যেত। এরপর ইসরাইল কিভাবে ঐকমত্যের সরকারকে বাধাগ্রস্ত করেছে এবং
যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করতে করতে এ পর্যন্ত এসে ঠেকেছে তার বর্ণনা আমি আগে
দিয়েছি। বলেছি কিভাবে তারা ঐকমত্যের সরকারে বাধা সৃষ্টি করেছে এবং পশ্চিম
তীরকে গাজা থেকে আলাদা করার জন্য তাদের নীতি বাস্তবায়ন করেছে, ডোভ উইসলাসের
বিখ্যাত মন্তব্য অনুযায়ী যেটাকে তারা নাম দিয়েছে ‘খাদ্য’। যে লোকটি ২০০৫
সালে তথাকথিত প্রত্যাহারের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন তিনি বলেছেন,
প্রত্যাহারের উদ্দেশ্য হলো যেকোনো রাজনৈতিক সমাধান আলোচনার ইতি ঘটানো এবং
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের যেকোনো সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত করা। তাদের কৌশল হলো
গাজাবাসীকে কোনোমতো বেঁচে থাকার মতো খাবার দেয়া হবে। কারণ, তারা মরে যাওয়া
ইসরাইলের দুর্নামের কারণ হবে। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
আর ইসরাইল প্রযুক্তিগত সক্ষমতার বড়াই করে থাকে। ইসরাইলি বিশেষজ্ঞরা
সুনির্দিষ্টভাবে হিসাব করেছে, গাজাবাসীকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে কতটুকু ক্যালরি
না হলেই নয়; অবরুদ্ধ করে, রফতানি বন্ধ করে, আমদানিতে বাধা দিয়ে এর বেশি
যাতে সেখানে ঢুকতে না পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানকার মৎস্যজীবীরা
মাছ ধরতে পারে না। জাহাজকে উপকূল থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। গাজার এক-তৃতীয়াংশ
বা তার চেয়েও বেশি আবাদি জমিতে তাদের যেতে দেয়া হয় না। এটাকে বলা হয়
‘প্রতিবন্ধকতা’। এটিই হলো তাদের আদর্শ। এটিই হলো তাদের ‘খাদ্য’। এর ওপরই
তারা গাজাকে রাখতে চায়। অন্য দিকে পশ্চিম তীরকে গাজা থেকে আলাদা করে সেটাকে
বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চায়। এর বিস্তারিত বর্ণনা আমি আগে দিয়েছি। তবে এটি
অস্পষ্ট নয় যে, পশ্চিম তীরের একটি অংশ হজম করা তাদের উদ্দেশ্য, সেটাকে
ইসরাইলের সাথে তারা মিশিয়ে নেবে। যত দিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন
অব্যাহত থাকবে এবং রাজনৈতিক সমাধানে বাধা দেয়াকে মেনে নেয়া হবে, তত দিন এই
বসতি সম্প্রসারণ চলতে থাকবে।
জুয়ান গঞ্জালেস : নোয়াম, এই পুরোটা মাস ধরে সেখানকার ঘটনা যেভাবে
উদঘাটিত হয়েছে এবং গাজায় হত্যাকাণ্ডের ছবি সারা বিশ্বে যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে
তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং আরব ও মুসলিম সম্পর্কে এর কী প্রভাব
পড়তে পারে বলে আপনার ধারণা? আমি বিশেষ করে সারা বিশ্বের তরুণ মুসলিম ও
আরবদের কথা ভাবছি। এর আগে বিশ্বে হয়তো ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের নৃশংসতা
এতটা উন্মুক্ত হয়নি।
নোয়াম চমস্কি : আচ্ছা, প্রথমত মুসলিম এবং আরব জনগোষ্ঠী আর তাদের
সরকারের মধ্যে যে পার্থক্য সেটি আমাদের ধরতে হবে। সরকারগুলোর বেশির ভাগই
হলো একনায়কতান্ত্রিক। আপনি যখন পত্রিকা পড়বেন তখন দেখবেন আরবরা আমাদের
এভাবে এভাবে সমর্থন করছে, তার মানে হলো একনায়কেরা সমর্থন করছে, সেখানকার
জনগণ নয়। একনায়কেরা আমেরিকা ও ইসরাইল যা করছে তাকে মোটামুটি সমর্থন করছে।
এর মধ্যে মিসরের সামরিক একনায়কতন্ত্রও রয়েছে, যেটি অতিমাত্রায় নির্মম; সৌদি
আরবের একনায়কতন্ত্রও রয়েছে। সৌদি আরব হলো ওই অঞ্চলে আমেরিকার সবচেয়ে
ঘনিষ্ঠ মিত্র। আর এটি হলো বিশ্বে সবচেয়ে চরমতম মৌলিবাদী রাষ্ট্র। এটি
বিশ্বব্যাপী চরমপন্থী মৌলবাদী ধারণা সালাফি-ওয়াহাবি মতবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
বছরের পর বছর ধরে এ দেশটি আমেরিকার সবচেয়ে কাছের মিত্র। যেটি এর আগে
ব্রিটেনের ক্ষেত্রে ছিল। তারা উভয়ে সেকুলার জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের জন্য
ক্ষতিকর রেডিক্যাল ইসলামকে পছন্দ করছে। তারা হামাসকে সমর্থন করে না,
হামাসকে ঘৃণা করে। ফিলিস্তিনের ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহই নেই। তারা শুধু
তাদের জনগণকে সন্তুষ্ট রাখতে যতটুকু বলার বলে। মনে রাখা দরকার, রেটরিক বা
গালভরা বুলি আর বাস্তব কাজ কিন্তু আলাদা জিনিস। সুতরাং যা ঘটছে তাতে
একনায়কেরা আতঙ্কিত নয়। সম্ভবত তারা বেশখানিকটা উল্লসিত।
এসব দেশের জনগণ অবশ্যই পুরোপুরি ভিন্ন, তবে এটি সব সময় সত্য ছিল।
উদাহরণস্বরূপ, মোবারক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে মিসরের তাহরির স্কোয়ারে
বিােভের প্রাক্কালে নেতৃস্থানীয় জনমত যাচাই সংস্থা দিয়ে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র জরিপ করে দেখেছে যে, ৮০ শতাংশ মিসরীয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে
তাদের প্রধান হুমকি মনে করে। আর আমেরিকা ও তার নীতির ব্যাপারে তাদের
সংুব্ধতা এমন পর্যায়ে যে, তারা ইরানকে পছন্দ না করলেও দেশটির হাতে
পারমাণবিক অস্ত্র থাকাকে এ অঞ্চলের জন্য নিরাপদ মনে করে। আপনি সারা বছরের
জরিপগুলোর প্রতি তাকান, সব ক্ষেত্রে এ রকমই দেখতে পাবেন। তবে সেটি হলো
জনগণের অবস্থা। মুসলিম জনগণ কোথাও এটাকে পছন্দ করছে না। তবে শুধু মুসলিমরা
নয়, অন্যরাও তা পছন্দ করছে না। লন্ডনের সাম্প্রতিক একটি বিােভের কথাই ধরুন,
সেখানে লাখ লাখ মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বিশাল বিােভের মাধ্যমে গাজায়
ইসরাইলি নৃশংসতার প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ ধরনের বিক্ষোভ বিশ্বে অন্যান্য
স্থানেও হয়েছে। স্মরণ করুন বিশ্বে ইসরাইল ছিল একসময় সবচেয়ে কাক্সিত একটি
দেশ। এখন এটিই হলো বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও ঘৃণ্য একটি রাষ্ট্র। ইসরাইলের
প্রোপাগান্ডাকারীরা এটি বলতে পছন্দ করে যে, এসব কথাবার্তা ইহুদিবিদ্বেষী
বক্তব্য ছাড়া আর কিছু নয়। এর মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষের কিছু উপকরণ হয়তো আছে তবে
তা একেবারেই সামান্য, সেটিও তৈরি হয়েছে ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের কারণে, তাদের
নীতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে। যত দিন ইসরাইল এই নীতি চালাবে, এটি হতেই
থাকবে।
বাস্তবিকপক্ষে সেই ১৯৭০-এর দশক থেকে এটি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।
আমি তারপর থেকে এ সম্পর্কে লেখা শুরু করেছি। আমি অবশ্য এর জন্য কৃতিত্ব
নিতে চাইছি না। ১৯৭১ সালে ইসরাইল তার ইতিহাসে একটি চরম সিদ্ধান্ত, আমার মনে
হয় ইতিহাসে সবচেয়ে চরম সিদ্ধান্তটি নেয়। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত
মিসরীয় সিনাই থেকে ইসরাইলি প্রত্যাহারের বিপরীতে একটি পূর্ণাঙ্গ
শান্তিচুক্তির প্রস্তাব দেন। তখন ছিল লেবার দলীয় সরকার, সে সময়ের তথাকথিত
মধ্যপন্থী সরকার। তারা প্রস্তাবটি বিবেচনা এবং প্রত্যাখ্যান করে। তারা
সিনাইয়ে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রমের পরিকল্পনা করে। এর আওতায় ভূমধ্যসাগরে এক
বিরাট শহর, কয়েক ডজন বসতি প্রকল্প, যৌথ খামারসহ বৃহৎ স্থাপনা নির্মাণের
পরিকল্পনা করে। সেখান থেকে কয়েক হাজার বেদুইনকে উচ্ছেদ করে, তাদের গ্রাম
জ্বালিয়ে দেয়। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে ইসরাইল নিরাপত্তার
ওপরে সম্প্রসারণকে অগ্রাধিকার দেয়। আর যখন আপনি নিরাপত্তার ওপর দমন ও
সম্প্রসারণ নীতির অন্বেষণ করবেন তখন বেশ কিছু জিনিস ঘটতে থাকবে। দেশের
মধ্যে নৈতিক অধঃপতন হবে। দেশের বাইরের জনগণের মধ্যে বিরোধ, ক্ষোভ ও শত্রুতা
সৃষ্টি হতে থাকবে। আপনি একনায়কতন্ত্রের কাছ থেকে এবং মার্কিন প্রশাসন থেকে
সমর্থন নিয়ে চালিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু জনগণের সমর্থন আপনি হারাচ্ছেন। আর
এর একটি পরিণতিও আছে। এসব বিষয় আমি এবং অন্যরা ১৯৭০-এর দশকে বলেছিলাম। আমরা
তখন বলেছিলাম, ‘যারা আজ ইসরাইলের সমর্থক বলে দাবি করছে তারা আসলে নৈতিক
অধঃপতনকে, আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়াকে এবং সম্ভবত চূড়ান্তভাবে ধ্বংসকে
সমর্থন করছে।’ এটি হলো সেটি যা এখন ঘটতে চলেছে।
Comments
Post a Comment