কষ্ট করে নিজেই কেন ধরে খাস না?

হিন্দুধর্মীয় সংস্কৃতির অতি পুরনো কাহিনী। ধরে নিন লোকটার নাম হরিহর। স্কুল-কলেজে পড়ার পরও বহু দিন বেকার। বেকার ছেলের কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। সংসার শুরু করার জন্য অধৈর্য হয়ে উঠেছিল হরিহর। একদিন কালীমন্দিরে গিয়ে উপুড় হয়ে ধরনা দিলো। মনে মনে মানত করল ভালো একটা চাকরি হলে মা কালীর নামে জোড়া পাঁঠা বলি দেবে।
কিছু দিনের মধ্যেই একটা চাকরি হলো, চাকরি পাকাও হলো; কিন্তু পাঁঠা বলির নাম নেই। মা কালী স্বপ্নে দর্শন দিলেন। হরিহর তার কথা রাখেনি বলে তম্বি করলেন। সে সবিনয়ে বললÑ একটু ধৈর্য ধরো মা, একটা বাসা কেনার চেষ্টা করছি, হয়ে গেলে পাঁঠা ঠিকই দেবো তোমাকে। বাসা কেনা হয়ে গেল, মা কালী আবার স্বপ্নে তাগিদ দিলেন। হরিহর বলল, মা কালী, পাঁঠার দাম আজকাল কেমন তুমি জানো। দুটোর বদলে একটা দিলে হয় না? দেবী বললেনÑ বেশ, তাই দে। তারপরও পাঁঠা বলির নাম-নিশানা নেই। দেবী স্বপ্নে আবার আবির্ভূত হলেন তাগিদ দিতে। হরিহর বলল, ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, বিয়েটা হয়ে গেলেই পাঁঠা বলি দেবো। 
 যথাসময়ে ঘটা করে বিয়ে হয়ে গেল; কিন্তু কোথায় কার পাঁঠা? মা কালী এবার স্বপ্নে ঈষৎ রাগতস্বরে কৈফিয়ত চাইলেন। হরিহর মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, বিয়ে ইত্যাদিতে অনেক টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। তুমি যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা কবুতরই না হয় বলি দিলাম। দেবী তাতেও রাজি হলেন। কবুতরও বলি দেয়া হলো না। তার বদলে ফড়িং বলিতেও রাজি হলেন দেবী। তাতেও বিলম্ব দেখে দেবী আবার স্বপ্নে দেখা দিলেন। হরিহর আর কৈফিয়ত খুঁজে পাচ্ছিল না। সরাসরি বলে দিলোÑ দেবী, তোর যখন এতই খাঁকতি, কষ্ট করে নিজেই কেন ধরে খাস না?
পদ্মার ওপর সেতুনির্মাণ নিয়ে বর্তমান সরকারের কথা ও কাজ নিশ্চয়ই সবাইকে হরিহরের কাহিনী মনে করিয়ে দেবে। সেতুর নকশা তৈরি ও অনুমোদন আগেই হয়েছিল। অর্থায়নেরও আয়োজন পাকাপাকি। মোট ব্যয়ের মূল অংশ খুবই সস্তা সুদে ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১১-১২ সালেই মাওয়া থেকে সোয়া ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক ও রেল সেতু নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা; কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো আওয়ামী লীগ সরকারের চরিত্র নিয়ে। প্রকল্পের কাজ হবে কিন্তু মন্ত্রী, তাদের লেজুড় আর শাসক দলের সংসদ সদস্যরা মোট বাজেটের বখরা পাবে না, এ কেমন কথা? পদ্মা সেতুর কাজ শুরু না হতেই উপদেষ্টা ও ঠিকাদার নির্বাচনের পর্যায়েই হরির লুট শুরু হয়ে গেল। বিদেশে অন্তত তিনটি প্রাসাদোপম অট্টালিকার মর্টগেজ রাতারাতি শোধ হয়ে গেল!
এই হরির লুটের কেলেঙ্কারি বিশ্বব্যাংকেরও দৃষ্টি এড়াল না। তারা বেঁকে বসল। এসব দুর্নীতির তদন্ত ও বিচার না হলে তারা সেতু নির্মাণের টাকা দেবে না। বিশ্বব্যাংকের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। এজাতীয় প্রকল্পে কিছু কিছু দুর্নীতি বহু দেশেই হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের আমলে সেটা যে বহু গুণে বেড়েছে তা এখন আর কারো অজানা নেই। সংশ্লিষ্ট মহলে এখন বলা-কওয়া হয় যে বাজেট বরাদ্দের ৬০ শতাংশই এখন শাসক দলের মন্ত্রী-সংসদ সদস্য আর তাদের লেজুড়দের পকেটে চলে যায়। ফলে বাংলাদেশে বহু প্রকল্পের কাজ এখন অর্থাভাবে মাঝপথে থেমে যায়। বিশ্বব্যাংক প্রমাদ গুনল। পদ্মা সেতুর কাজও যদি মাঝপথে থেমে যায় সরকার তখন বিশ্বব্যাংককে ব্ল্যাকমেইল করবে, ব্যাংকের গলায় পা দিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করার জন্য বাড়তি টাকা আদায় করে নেবে। বলাই বাহুল্য, মন্ত্রী ও লেজুড়দের পকেট তাতে আরো ভারী হতে থাকবে। ব্যাংক সাফ বলে দিলো তদন্ত, বিচার ও শাস্তি না হলে তারা টাকা দেবে না। 
 ব্যাংকের এ অবস্থানে প্রধানমন্ত্রীসহ সর্বস্তরে সরকারের অবিশ্বাস্য ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার কথা আপনারা ভুলে যাননি, আশা করি। আসলে এটা হচ্ছে এই সরকারের চরিত্রের আরেকটা বড় দিক। হাজার অন্যায় আর দুষ্কর্ম করে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। কোথাও ধরা পড়ে গেলে কপট ক্রোধ আর গালাগালির ধূলিঝড় তুলে তারা নিজেদের দুষ্কর্মগুলো চাপা দিতে চায়। আবার বড় কোনো দুষ্কর্ম করার কিংবা খুবই বিতর্কিত কোনো কাজ করার আগে তারা বিএনপি এবং খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অযথা অসত্য গালিগালাজের ঝড় তুলে দেশবাসীর দৃষ্টি ভিন্নমুখী করতে চায়, যেমন বর্তমান সময়ে সরকারপ্রধান রোজই সকালে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নতুন অসত্য গালাগালি করে চলেছেন। 
হ্যাটের ভেতর জাদুকরের খরগোশ
বলছিলাম পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাফ জবাবের পর সরকারের প্রতিক্রিয়ার কথা। বহু ধানাইপানাই করে সরকার বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের তালিকা থেকে কয়েকজন মন্ত্রীর নাম তাদের নতজানু দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠাতে রাজি হলেও প্রধান অভিযুক্ত তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্তে কিছুতেই সম্মতি দেয়নি। পাঠকদের আরো মনে থাকার কথা যে, দেশব্যাপী ব্যাপক ধারণা হচ্ছে যে, ওই মন্ত্রী সরকারের শীর্ষতমপর্যায়ের কারো কারো পক্ষে প্রক্সিতে দুর্নীতি করতেন। এ ধারণায় কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতা থাকা স্বাভাবিক। অন্যদের বাদ দিয়ে শুধু এ মন্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য সরকারের মরণপণ বাধাদানের আর কী ব্যাখ্যা হতে পারে? সরকারের পক্ষ থেকে প্রচারণা শুরু হয়ে যায় যে (সাধাসাধি করলেও) তারা বিশ্বব্যাংকের টাকা নেবে না। পরিবর্তে জাতির কাছ থেকে চাঁদা তুলে সেতুর ব্যয়নির্বাহ করা হবে। ছাত্রলীগ-যুবলীগ আরো এক দফায় চাঁদাবাজির ত্রাস সৃষ্টি করে। কিছু দিন পরে নতুন ঘোষণা হয় যে চাঁদার টাকা থেকে নয়, সরকার রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে সেতু নির্মাণের টাকা দেবে। এই তুঘলকি কাণ্ডকারখানার ফাঁকতালে সরকারের ক্যাডারেরা কত কোটি টাকা দেশের মানুষের কাছ থেকে আদায় করেছে, তার হিসাব কে দেবে? 
ও দিকে ভেতরে ভেতরে সেতুর জন্য ঋণ সংগ্রহের তদবির চলছে বহু দেশে। প্রথমত, কোনো দেশই ঋণ দিতে রাজি হয়নি। বিশ্বব্যাংক যে দেশকে বিশ্বাস করতে পারে না সে দেশকে ঋণ দেয়ার ঝুঁকি কে নেবে? কোনো কোনো দেশ এত উঁচু হারে সুদ চাইল যে, এ সরকারও তাতে রাজি হতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঋণের তদবিরে দেশ-বিদেশে ঘুরে এলেন। শেষে নাকি চীন ঋণ দিতে এবং সেতুটি নির্মাণ করতে রাজি হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের অবস্থা এখন ম্যাজিক শোর দর্শকের মতো। ম্যাজিশিয়ান তার হ্যাট থেকে জ্যান্ত খরগোশ বের করেছেন। কী করে বিশ্বাস করা যায় যে, সে খরগোশ আসলেই খরগোশ? তার ওপর সরকারের মন্ত্রীরা অনবরত সেতু তৈরীর কাজ শুরু ও শেষ হওয়ার নিত্যনতুন সন-তারিখ দিয়ে চলেছেন। এখন আর কোনো কথাতেই মানুষ বিশ্বাস করতে পারছে না।

Comments