প্রতিপক্ষের সাথে হাত মেলাচ্ছে পাশ্চাত্য!
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশারের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর গোপন সহযোগিতার ঘটনা এ
স্বৈরশাসকের সাথে একসময়ের অচিন্তনীয় জোট গঠনের ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে। ইসলামিক
স্টেট (আইএস) সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের ঘাঁটিগুলো থেকে যেভাবে পূর্ব দিকে
অগ্রসর হচ্ছে তাতে তাদের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে সেখানে মার্কিন সামরিক
হস্তক্ষেপের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আইএস নিজেই ইসলামি রাষ্ট্রের ধাঁচে
প্রশাসন গড়ে তুলেছে। তারা অন্য সব সরকারবিরোধী বিদ্রোহী গ্রুপকে তাড়িয়ে
দিয়ে নিজেদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং গোটা আলেপ্পো অঞ্চল
দখলের হুমকি সৃষ্টি করেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের দমন করতে প্রকাশ্যে অথবা
গোপনে প্রেসিডেন্ট বাশারের সাথে হাত মেলাতে পারে। অথচ দৃশ্যত এত দিন তারা
বাশারের অপসারণের জন্য কাজ করে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে গোপনে বাশার সরকারের সাথে সহযোগিতা শুরু করে দিয়েছে।
তারা জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা বিএনডির মাধ্যমে প্রাপ্ত আইএসএর অবস্থান
সম্পর্কিত তথ্য বাশার সরকারকে সরবরাহ করেছে। এর ফলেই বাশারের জঙ্গিবিমান ও
কামানগুলো আইএস কমান্ডারদের ও তাদের দফতরগুলোর ওপর সম্প্রতি নিখুঁতভাবে
হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে।
সিরিয়ার সরকারি বাহিনী রাক্কা প্রদেশের তাবকা বিমানঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ ধরে
রাখতে আইএসের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াইয়ে লিপ্ত রয়েছে। এ বিমানবন্দরটি আইএসের
দখলে চলে গেলে দেশটির চতুর্থ বৃহত্তম শহর হামাতে বিদ্রোহীদের যাওয়ার পথ সহজ
হবে। আরো উত্তরে আইএস একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখল করে নিয়ে তুরস্ক
সীমান্ত থেকে আলেপ্পোয় অন্য বিদ্রোহীদের রসদ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
আইএস গত ২৯ জুন তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা নিয়ে খেলাফত গঠনের ঘোষণা দেয়।
সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ ও ইরাকের এক-চতুর্থাংশ এলাকা এ রাষ্ট্রের
নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ সীমানা ইরান সীমান্ত থেকে ২০ মাইল দূরের জালাওয়ালা
শহর থেকে আলেপ্পোর ৩০ মাইল উত্তরের আরেকটি শহর পর্যন্ত বিস্তৃত। এর আয়তন
প্রায় এক লাখ বর্গকিলোমিটার। ইরাকি সেনাবাহিনী ও কুর্দি যোদ্ধারা মার্কিন
বিমান হামলার ছত্রছায়ায় জালাওয়ালা শহরটি পুনর্দখলের চেষ্টা করছে।
ওয়াশিংটনে জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জে. মার্টিন ডেম্পসে বলেন,
‘সিরিয়ায় অবস্থানকারী আইএস গ্রুপের অংশকে দমন করা ছাড়া আইএসকে পরাজিত করা
সম্ভব নয়।’ তার এ মন্তব্যে সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে মার্কিন বিমান হামলা
চালানোর বিষয়টি রাজনৈতিক এজেন্ডার শীর্ষে এসে পড়েছে।
আইএস সিরীয় আলকায়েদা সংশ্লিষ্ট দল জাবহাত আল-নুসরাকে ফোরাত নদীর অববাহিকার
তেলসমৃদ্ধ দেইর ইজ্জর প্রদেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। এরপর তারা সিরীয়
সেনাবাহিনীর দু’টি গুরুত্বপূর্ণ চৌকি দখল করে নেয়। এ চৌকি দু’টির একটি
রাক্কা প্রদেশে ১৭ সেনা ডিভিশনের এবং অপরটি হাশকাহ প্রদেশে ১২১ রেজিমেন্টের
দখলে ছিল। সেখানে যুদ্ধে রেজিমেন্টাল কমান্ডার নিহত হন। ইরাকের চেয়ে
সিরিয়ায় আইএস সম্প্রসারণের বেশি সুযোগ রয়েছে। কারণ, দেশটির জনসংখ্যার ৬০
শতাংশেরও বেশি সুন্নি। অন্য দিকে ইরাকে জনসংখ্যার মাত্র ২০ শতাংশ সুন্নি।
তিন বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও তাদের
মিত্রদের নীতি ছিল সিরিয়ার ‘মধ্যপন্থী’ বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে সমর্থন করা,
যারা আইএস ও অন্যান্য জঙ্গি গ্রুপ এবং দামেস্কের বাশার সরকারের বিরুদ্ধে
লড়াই করবে। কিন্তু পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট ফ্রি সিরিয়ান আর্মি ক্রমেই দুর্বল ও
কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। অন্য দিকে জাবহাত আল-নুসরা, আহরার আল-শাম ও ইসলামিক
ফ্রন্টের মতো জিহাদি গ্রুপও আইএসকে ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০১৪ সালে অন্য বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সাথে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার আগে আইএসআইএস
আলেপ্পো প্রদেশে ও আরো পশ্চিমের ইদলিব প্রদেশের বিভিন্ন এলাকা নিজেদের দখলে
রেখেছিল। তারা সেখান থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। সে সময় একে তাদের
সেখান থেকে পিছু হটে যাওয়া বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু তারা আসলে তাদের এ
বাহিনীকে ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য নতুন করে সংগঠিত করেছিল।
সিরিয়ার সরকারি বাহিনী আইএসের কাছে কয়েকটি যুদ্ধে মারাত্মক বিপর্যয়কর
পরাজয়ের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও তারা গত জুলাইয়ে পালমাইরার কাছে আল-শায়ের
গ্যাসক্ষেত্র পুনর্দখল করতে সক্ষম হয় এবং তাবকা বিমানঘাঁটি এখনো নিজেদের
নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়েছে। এ ছাড়া তারা আবু মুসা নামে আইএসের একজন
কমান্ডারসহ অনেক যোদ্ধাকে হত্যা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও তাদের আঞ্চলিক মিত্ররা কেবল বিমান হামলা চালিয়ে
আইএসকে দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন করত পারবে না। আইএসের শক্তি বৃদ্ধির মূলে রয়েছে
হাজার হাজার বিদেশী যোদ্ধা, যারা তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করেছে। এখন
তুরুস্কও আইএসের বিরোধিতা করছে।
ফ্রিম্যান বলেন, সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তনের চেষ্টারত ওয়াশিংটনের উদার
হস্তক্ষেপবাদী ও নয়া রক্ষণশীলেরা তাদের নীতি পরিবর্তন করতে রাজি হবেন কি না
তা নিয়ে তার সংশয় রয়েছে। এটি করলে তাদেরকে নিরর্থক রক্তপাতের দায়দায়িত্ব
স্বীকার করে নিতে হবে, যাতে প্রায় দুই লাখ সিরীয়ের জীবন দিতে হয়েছে। তার
মতে, সরাসরি হামলা চালিয়ে আইএসকে ধ্বংস করা সম্ভব হবে না, গ্রুপটির পথ
রুদ্ধ করে তার ভেতর থেকেই নিজস্ব ধ্বংসাত্মক তৎপরতার পরিণতিতে ধ্বংস হওয়ার
জন্য অপেক্ষা করা উচিত। ফ্রিম্যান এর মতে, ‘সিরিয়া, সৌদি আরব ও উপসাগরীয়
অন্যান্য আরব দেশ, ইরান, রাশিয়া ও তুরস্কের সহযোগিতা ছাড়া গ্রুপটিকে একঘরে
করা যাবে কি না, তা আমি বলতে পারব না।’ এ ছাড়া ওয়াশিংটনে বিভক্তি এবং
মধ্যপ্রাচ্যে ঘৃণাবিদ্বেষের কারণে ঘোষিত নীতি হিসেবে এ ধরনের কোনো সহযোগিতা
করা সম্ভব কি না, তাও ভেবে দেখতে হবে।
মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনার পশ্চিমা বিশ্লেষণ দৃশ্যত যা-ই হোক না কেন-এর ভেতরের
রহস্য উদঘাটনের প্রচেষ্টায় ভিন্ন কিছু সমীকরণও পাওয়া যায়। এ সমীকরণ অনুযায়ী
আরব বসন্তের পর জনসমর্থন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মধ্যপন্থী
ইসলামি দলগুলোর ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিলে আরব রাজতান্ত্রিক দেশগুলো
এটাকে তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করে। সেই সাথে মধ্যপন্থী
শক্তিকে নির্মূল বা দমন করতে গোপন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে দিয়ে উগ্র
দলগুলোকে অস্ত্র ও ইন্ধন জোগায়। এর অংশ হিসেবে আইসিস সিরিয়ায় বাশারবিরোধী
লড়াইয়ে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে ফ্রি সিরিয়া আর্মিসহ মধ্যপন্থী দলগুলোর
কাছ থেকে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা দখল করে নেয়। সিরিয়ার একটি বড় অংশে
কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর তাদেরকে ইরাকের সুন্নি অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার
সুযোগ করে দেয়া হয়। ইসরাইলের প্রতি নমনীয় হিসেবে পরিচিত আরব দেশগুলোর গোপন
সমীকরণ ছিল এর মাধ্যমে এক দিকে তাদের নিয়ন্ত্রিত গ্রুপগুলো গৃহযুদ্ধকবলিত
আরব দেশগুলোতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে; অন্য দিকে ইরানের ওপর চাপ
বাড়িয়ে আরব রাজতান্ত্রিক বলয়ের সাথে তাদের সমঝোতায় আসতে বাধ্য করা যাবে।
এই সমীকরণে ইসরাইলের হিসাব ছিল সুন্নি চরমপন্থী মিলিশিয়ারা সিরিয়া ও ইরাক
অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলে শিয়া-সুন্নি সঙ্ঘাত আরো বাড়বে। একই
সাথে ফিলিস্তিনের ওপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তা
সহায়ক হবে। এ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের একটি অংশ ইসরাইলের মধ্যপ্রাচ্যের
দেশগুলোকে বিভাজন করে তেলআবিব ও পাশ্চাত্যের প্রতি অধিক নির্ভরশীল করে
রাখার পরিকল্পনা সহায়ক হবে বলে মনে করছে। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে যুক্তি দেখানো
হয় যে, সুন্নি চরমপন্থীদের একটি রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে নিয়ে আসা গেলে
শিয়া প্রতিপক্ষকে ইন্ধন দিয়ে
তাদের বিনাশ সাধন সম্ভব হবে। অন্য দিকে শিয়া-সুন্নি সঙ্ঘাতকে দীর্ঘায়িত করা
যাবে।
কিন্তু আইএস তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় যেভাবে অগ্রসর হয়েছে তা আরব
দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
একই সাথে শিয়া শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সুন্নি শক্তিকে দমন করার পরিকল্পনা
কার্যকর হলে তা মধ্যপ্রাচ্যে আরব প্রাধান্য বজায় রাখাকে হুমকির মধ্যে ঠেলে
দিতে পারে। তারপর কৌশলে কোন পক্ষ আইএসকে সৌদি আরবের অভ্যন্তরে ঠেলে দিলে এ
শক্তি তাদের জন্য ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এসব
বিবেচনায় মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রিক শক্তিগুলো ইসলামিক
রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি যেমন দিচ্ছে না তেমনিভাবে এখনই তাদের নির্মূল করার জন্য
সর্বাত্মক যুদ্ধে যেতে চাইছে না। তবে তাদের দমন ও ধীরে ধীরে শক্তিহীন করতে
বাশার আসাদ, কুর্দি ও ইরাকি সেনাবাহিনী সীমিত সহযোগিতা দেয়ার নীতি গ্রহণ
করা হচ্ছে।
Comments
Post a Comment