রাষ্ট্রের চেয়েও বড় ক্ষমতাধর
রাষ্ট্রের চেয়েও বড় ক্ষমতাধর বনে গেছে রাজধানীর মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ! দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারের নির্দেশনা মানলেও এই প্রতিষ্ঠানটিই ব্যতিক্রম। সরকারের কোনো নির্দেশনা মানছেই না। উল্টো সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে নানা অনিয়ম আর দুর্নীতি করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ।
এর প্রমাণ মেলে একটি ঘটনার দিকে তাকালেই। ২০১২ সালে শিক্ষার্থী ভর্তির সময় তিন হাজার ৫৪ জন ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে ‘উন্নয়ন ফি’র নামে অতিরিক্ত পাঁচ কোটি ২৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বার বার তাগাদা দিলেও সেই টাকা ফেরত দেয়নি কর্তৃপক্ষ। বরং শিক্ষামন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাবে কলেজের অধ্যক্ষ ছাপ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘শিক্ষার্থী ভর্তিতে নেয়া অতিরিক্তি পাঁচ কোটি ২৩ লাখ টাকা ফেরত দেয়া হবে না।’
জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ভর্তির সময় নেয়া একটি টাকাও ফেরত দেব না। আমরা যা করেছি ঠিকই করেছি। মন্ত্রণালয় আমাদের অযথা দোষ দিচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি বলতে পারবো না। ফাইল দেখতে হবে।’ তিনি যুগ্ম সচিব এএস মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।’ এ এস মাহমুদের সঙ্গে কথা বলার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
কয়েক দফা নির্দেশের পরেও ভর্তির সময় নেয়া অতিরিক্ত অর্থ ফেরত না দেয়ায় ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর ফরহাদ হোসেনসহ মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ অধ্যক্ষের এমপিও স্থগিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর মতিঝিল আইডিয়াল ও ভিকারুননিসা কর্তৃপক্ষ আদায় করা অতিরিক্ত অর্থ শিক্ষার্থীদের বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করতে শুরু করে যা এখনো চলছে।
মতিঝিল আইডিয়াল ও ভিকারুননিসার পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সাংসদ রাশেদ খান মেননও বলেছেন, অতিরিক্ত অর্থ শিক্ষার্থীদের বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে, সব টাকাই পরিশোধ করা হবে। তবে অধ্যক্ষের এমপিও স্থগিতের পরও সিদ্ধান্ত বদলায়নি মণিপুর কর্তৃপক্ষ। এই কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদার। ভর্তিতে অতিরিক্ত অর্থ নেয়ার বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে একই বছর এক নারী সাংবাদিক তার হাতে লাঞ্ছিত হন । তবে অতিরিক্ত অর্থ ফেরতের বিষয়ে কামাল মজুমদারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মণিপুরের অধ্যক্ষের দাবি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘গায়ের জোরে’ তার এমপিও স্থগিত রেখেছে এবং এ বিষয়ে তিনি কিছু ভাবছেনও না।
২০১২ সালে শিক্ষার্থী ভর্তিতে রাজধানীর ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে। এর মধ্যে নামকরা এই তিনটি বিদ্যালয় নয় কোটি ১২ লাখ ৮১ হাজার টাকা অতিরিক্ত নেয় বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে জানানো হয়।
ভর্তি ফি বাবদ মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় তিন হাজার ৫৪ জন ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে পাঁচ কোটি ২৩ লাখ ৭৬ হাজার একশ টাকা, মতিঝিল আইডিয়াল দুই হাজার ৬৬৭ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তিন কোটি ৩৯ লাখ ৩৪ হাজার ৯০০ টাকা এবং ভিকারুননিসা এক হাজার ৬২৭ ছাত্রীর কাছ থেকে ৬৮ লাখ ১৭ হাজার একশ টাকা অতিরিক্ত ফি আদায় করে। এই অর্থ শিক্ষার্থীদের ফেরত দিতে অথবা বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করতে গত বছরের ৩০ জানুয়ারি নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পরও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ওই অর্থ ফেরত না দিলে গত বছরের ২ জুলাই সংসদে শিক্ষামন্ত্রী জানান, এক মাসের মধ্যে নির্দেশনা না মানলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। এরপর ১৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টি ভর্তিতে নেয়া অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেয়। বাকি তিনটি প্রতিষ্ঠানকে আরো ১৫ দিন সময় দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর পরও অর্থ ফেরত না দেয়ায় তিন প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের এমপিও স্থগিত করা হয়। এরপর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজ বাড়তি অর্থ বেতনের সাথে সমন্বয় করে টাকা পরিশোধ করে। কিন্তু মনিপুর টাকা পরিশোধ করেনি।
মনিপুর স্কুলের আরও যতো অনিময়-দুর্নীতি:
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির তিনটি শাখা ক্যাম্পাসের মধ্যে দুটিই চলছে সরকারি অনুমোদন ছাড়া। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি নিয়ে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর সঙ্গে জড়িত এমপি কামাল মজুমদারের ঘনিষ্ঠজনরা। প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ নিজেও ভর্তি-বাণিজ্যের জন্য তার অনুসারীদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। টাকা দিলেই এ স্কুলে ভর্তি করানো যায়। শিক্ষকদের মালিকানা ও পরিচালনায় প্রতিটি শাখার প্রধান ফটক থেকে শুরু করে ৫০ গজের মধ্যে গড়ে উঠেছে ১৫-২০টি কোচিং সেন্টার। এসব কোচিং সেন্টার স্কুলে ভর্তির শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। অন্যান্য শিক্ষক ক্লাসে মনোযোগ না দিয়ে সারাদিন এসব সেন্টারে সময় ব্যয় করেন। ২০১২ সালের ভর্তিতে এ স্কুলের অভিভাবকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত আদায় করা প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় কয়েক দফা নির্দেশ দিলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করছে না।
রাজধানীর মিরপুর এলাকার প্রত্যেকেই এখন জানেন, টাকা দিলে মনিপুর স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করা যায়। বেপরোয়া বাণিজ্যের কারণে প্রতিষ্ঠানটি ক্রমেই মান হারাচ্ছে। গত বছর এসএসসিতে ঢাকা বোর্ডে অষ্টম স্থান অধিকারী এ প্রতিষ্ঠানটি এ বছর এসএসসিতে ২০তম হয়েছে। মেধায় ক্রমাবনতি হলেও দুর্নীতিতে এখন শীর্ষে।
জানা গেছে, প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তির সরকারি নীতিমালা লঙ্ঘন করে কয়েক বছরে স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে ২৫-৩০ জন করে কোটা ভাগ করে নিয়েছেন। ৫০ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত এ স্কুলের ভর্তিতে ঘুষ নেওয়া হয়।
সম্প্রতি মনিপুর স্কুলে ভর্তি-বাণিজ্যের সিংহভাগই এমপি কামাল আহমেদ মজুমদারের লোকজনের দখলে। তারা সরকারদলীয় নেতাকর্মী এবং এমপির অতি ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। জানা গেছে, প্রতি বছর ভর্তি-বাণিজ্যের সঙ্গে অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেন সরাসরি জড়িত থাকেন। এর বাইরে এমপির দলীয় লোকজন জড়িত। এ বিষয়ে বারবার যোগাযোগের পরও কামাল মজুমদার কথা বলতে রাজি হননি।
অধ্যক্ষ মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, এ বিদ্যালয়ের ভর্তি নিয়ে অনেকে দালালি করে থাকেন। এর সঙ্গে এমপি কামাল আহমেদ মজুমদার এবং তিনি নিজে (অধ্যক্ষ) কোনোভাবেই জড়িত নন। কেউ যদি তাদের নাম ভাঙিয়ে টাকা আদায় করে, তবে তার দায় তাদের নয়। তিনি বলেন, ভর্তি নিয়ে যারা দালালি করত তাদের সন্তানদের স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
‘লটারির বাইরেও অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় কেন’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত ও রেজুলেশন ছাড়া কোনো একটি ভর্তিও নেওয়া হয় না। আর লটারিতে চান্স পাওয়ার পরও অনেক শিক্ষার্থী ভিকারুননিসা বা অন্য কোনো বিদ্যালয়ে চলে যায়। তাদের খালি আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।'
নিয়ম-কানুনের বালাই নেই: এর আগে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণ না করে মনিপুর স্কুলের দুটি শাখা অবৈধভাবে খোলা হয়। ইব্রাহিমপুরে ২০১০ সালে ও শেওড়াপাড়ায় ২০১১ সালে চালু করা দুটি শাখার অনুমোদন আজও নেয়নি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। বিদ্যালয়ে কয়েক দফায় অনুষ্ঠিত শিক্ষক নিয়োগে কোনো স্বচ্ছতা ছিল না। এমনকি প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অধ্যক্ষও তার সাক্ষাৎকার বোর্ডে একক প্রার্থী ছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী, একজন প্রার্থী থাকলে পত্রিকায় পুনর্নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার কথা। মজার ব্যাপার, এমপি কামাল মজুমদারের ছবি স্কুলের প্রতিটি শাখায় টানানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
Comments
Post a Comment