দাপটেরই জয় ;সাংবাদিকরা হচ্ছে কুকুর।


বৃহস্পতিবার দিনটি ছিল নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে উপনির্বাচনের দিন৷ বিকেলে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে বসে নির্বাচনের খোঁজখবর রাখছিলেন শামীম ওসমান৷ নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার মো. বশিরউদ্দীনকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগের ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য নিতে সাংবাদিকেরা সেখানে যান৷ এঁদের মধ্যে ছিলেন দুটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান, প্রথম আলোর দুই সাংবাদিক৷ তিনি সবাইকে কক্ষে নিয়ে বসান৷ তবে শুরুতে পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি তিনি৷ বললেন, ‘তোমাদের সঙ্গে এমনি কথা বলি৷’ সাংবাদিকেরাও একে একে নানা প্রসঙ্গ তুললেন৷ নিজের আত্মবিশ্বাস, তাচ্ছিল্য, ক্ষমতার প্রকাশ ঘটিয়ে সেসব বিষয়ে কথা বলেন তিনি৷ প্রায় শেষ পর্যায়ে একজন সাংবাদিক এই আলাপচারিতায় উঠে আসা কিছু বিষয় এবং এ-সংশ্লিষ্ট অভিব্যক্তি প্রকাশের বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি ঘাড় নেড়ে সায় দেন৷
আলাপচারিতায় শামীম ওসমান গণমাধ্যম নিয়ে তাঁর মনোভাব অকপটে প্রকাশ করেন৷ তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকরা হচ্ছে কুকুর। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন পাড়ার অনেকে পয়সা হলে বাড়িতে কুকুর পুষত। ওদের বাড়ির সামনে গেলে কুকুরগুলো মুখ ভেংচাত। এর পর যাদের আরও পয়সা হলো, তারা মিডিয়া পোষা শুরু করল। এগুলো হলো অ্যালসেশিয়ান কুকুর। প্রশিক্ষিত। লাত্থি দিলেও এগুলো কামড়াতে আসে।’
শামীম ওসমান বলে চলেন, ‘যেমন ধরেন, বসুন্ধরার শাহ আলম। ওর আছে চারটা। কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, একটি অনলাইন পত্রিকা আর আরেকটি সান না কী যেন নামের ইংরেজি পত্রিকা। বাবুলের একটা পত্রিকা ছিল, আরেকটা টেলিভিশন নিছে। আজাদ সাহেব, ওনার আগে পত্রিকা ছিল একটা, তাঁর আরেকটা লাগবে। নতুন করে একটি টিভি চ্যানেল নিছে। পত্রিকা আছে একটাই, সেইটা হইলো ইত্তেফাক৷’
দম নিয়ে আবার শুরু করলেন শামীম ওসমান, ‘সালমান—ও তো একটা চোর। বড় চোর। ২৩ হাজার কোটি টাকা ও চুরি করছে। তারও পত্রিকা ছিল, এখন একটা টিভি চ্যানেল নিছে। আমি তো তারে দেখা হইলে বলি—চোর, চোর, চোর।’
প্রসঙ্গত, নুরুল ইসলাম বাবুল যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান৷ এই গ্রুপের মিিডয়া হচ্ছে দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টিভি৷ এ কে আজাদ হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান৷ দৈনিক সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোর এই গ্রুপের মিডিয়া৷ সালমান এফ রহমান বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান৷ এই গ্রুপের পত্রিকা ইংরেজি দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট ও ইনডিপেনডেন্ট টিভি৷
শামীম ওসমান বললেন, ‘কালকে যদি তোমাদের মালিক বলে, শামীম ওসমানের পক্ষে লিখো। তোমরা তাই করবা।’ এ সময় একজন সাংবাদিক বলেন, ‘মালিক যা বলবে আমরা তা-ই করব, তা সব সময় ঠিক না। আমরা চাকরি ছেড়েও দিতে পারি।’ আরেকজন সাংবাদিক বললেন, ‘কিছু কুকুর যেমন লেজ নাড়ায়, আবার কেউ কেউ ডাকাত আসলে চিৎকার করে৷ অনেক সময় তারা গ্রামও পাহারা দেয়।’
জবাবে শামীম ওসমান বলেন, ‘তোমরা যাইবাটা কই। হ্যাঁ, তোমরা চাকরি ছাড়তে পারো। কিন্তু সব মালিক যদি একই কথা বলে। কই যাইবা।’ তিনি বললেন, ‘এরা সবাই আমার বিরুদ্ধে লেখে। আমি কিচ্ছু বলি না। লেখুক। ওরা (মিডিয়ার মালিকেরা) কোত্থেকে উঠে আসছে, তা তো আমি জানি। ওরা অনেক ছোট জায়গা থেকে আজকে বড় জায়গায় আসছে। ওদের সবার সঙ্গে আমার ভালো খাতির আছে।’
ঘড়ির কাঁটার সময় তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। কথা শুরু হয়েছিল নির্বাচন কেমন হলো, ফলাফল কী আশা করছেন—এসব নিয়ে। জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ানো বড় ভাই সেলিম ওসমানের নিশ্চিত বিজয় হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন শামীম ওসমান।
আলাপের একপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোনে হুমকি দেওয়ার প্রসঙ্গটি আবার উঠে আসে৷ এবার শামীম ওসমান বলেন, ‘আমার নাম করে তো অনেকেই


‘সন্ত্রাসের জনপদ’ নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনে শেষ পর্যন্ত পেশিশক্তির দাপটেরই জয় হয়েছে৷ খুন-গুম এবং বিতর্কিত একটি পরিবারের হুমকি-ধমকির কারণে সম্প্রতি এই েজলায় যে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে শান্তিপ্রত্যাশী বেশির ভাগ সাধারণ ভোটারই কেন্দ্রে যাওয়ার সাহস পাননি৷
ভোট গ্রহণের সময় কোথাও কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা না ঘটলেও ওসমান পরিবারের লোকজনের দাপট আঁচ করেছেন সবাই৷ দিনভর ভোটার উপস্থিতি খুবই কম থাকার পরও বেলা শেষে বেড়ে যায় ভোট পড়ার হার৷ দুপুরের পর জাল েভাটের ছড়াছড়ির কারণেই ওসমান পরিবারের কাছে হেরে যান নাগরিক সমাজ-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম আকরাম৷
নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেিণ-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এবং ভোটের দিন পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা গণমাধ্যমকর্মীসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে৷ ২২ জুন বন্দর উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম আকরামের পথসভার মঞ্চ ও মাইক ভেঙে ফেলার ঘটনা জানতে চাইলে ওই দিন সেলিম ওসমান সাংবাদিকদের বলছিলেন, যে ব্যিক্ত একটি মঞ্চ রক্ষা করতে পারেন না, তিনি কেন নির্বাচন করছেন৷ অবশ্য তিনি এও দাবি করেছিলেন, তাঁর কোনো লোকজন এ ঘটনায় জড়িত নন৷
সেলিম ওসমান ওই বক্তব্যেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, নারায়ণগঞ্জে নির্বাচনে জেতার জন্য কেবল সততা বা জনপ্রিয়তাই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে পেিশশক্তি-টাকার জোরও থাকতে হবে৷ গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার আগে ওই দিন দুপুরের পর বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়া হয়েছে৷ এস এম আকরামের সমর্থকেরা এ বিষয়ে অভিযোগ করেছেন ঠিকই, কিন্তু কেন্দ্রে জাল ভোটের বিরুদ্ধে আপত্তি বা প্রতিবাদ জানানোর সাহসও করেননি তাঁরা৷ এ ছাড়া সকালে মদন ইউনিয়নের একটি কেন্দ্র দখলের সুযোগ না দেওয়ায় একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে সেলিম ওসমানের ভাই সরকাির দলের সাংসদ শামীম ওসমান হুমকি ও গালিগালাজ করেছেন, তা টেলিভিশনে প্রচার হওয়ার পর আকরামের সমর্থকসহ সাধারণ ভোটাররা আরও ভীত হয়ে যান৷
এর আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নানা ভয়ভীতি উপেক্ষো করেও ভোটাররা কেন্দ্রে গিয়ে সাংসদ শামীম ওসমানকে পরাজিত করে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে নির্বাচিত করেছিলেন৷ তখন ভীতি কাটিয়ে ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে এস এম আকরামসহ আওয়ামী লীগের একাংশ ও নাগরিক সমাজ যেভাবে কাজ করেছিল, এই উপনির্বাচনে এমন তৎপরতা ছিল অনেক কম৷
এর কারণ হিসেবে নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র আইভীর পক্ষে কাজ করায় এবং পরিবহনে চাঁদাবাজি নিয়ে ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে নাগরিক আন্দোলন গড়ে তোলায় রফিউর রাব্বির মেধাবী ছেলে ত্বকীকে অপহরণ করে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। এ কারণে এবার সমাজের অনেকেই আগ্রহী থাকা সত্ত্বেও নিজের ও সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে সেভাবে প্রকাশ্যে প্রচারে নামেননি৷
তা ছাড়া সম্প্রতি সাত খুন ও তারপর জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ওসমান পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণার কারণেও অনেকে আকরামের পক্ষে নামতে সাহস করেননি৷ এ প্রসঙ্গে স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, পানিতে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না৷
সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বললেন, অপহরণ, গুম, খুন, বিশেষ করে ত্বকী হত্যাকাণ্ড ও সাত খুনের ঘটনায় যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তাতে নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থা রাখতে পারেননি৷ তাই তাঁরা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সাহস পাননি৷

Comments