মুজিব কাকুর অসন্তুষ্টি
১৯৭১-এ ভারত ও বাংলাদেশের চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭২-এর ১৫ মার্চ বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার হয়। আব্বুর উদ্যোগে সূচিত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চুক্তি এবং সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে ঐ চুক্তির প্রতি ভারতীয় সরকারের শ্রদ্ধা প্রদর্শন সারা বিশ্বের জন্যই ছিল গৌরবোজ্জ্বল এক বিরল দৃষ্টান্ত। নিজের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার বর্ণনা দিয়ে তিনি লিখেছেন, কাঁচা আমের মৌসুমে আমরা দরদরিয়া গ্রামে গেলাম আব্বু ও আম্মার সঙ্গে। আমাদের নিয়ে হেলিকপ্টারটি অবতরণ করল দরদরিয়া প্রাইমারি স্কুলের খেলার মাঠে। আমাদের বরণ করতে এসেছে অগণিত মানুষ। হেলিকপ্টার থেকে নামতেই রিমি, আমি দৌড়ে গেলাম বাড়ির দিকে। পশ্চিমের কোঠাবাড়ি, যেখানে আব্বুর জন্ম, হানাদার বাহিনী সেটা পুড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের প্রপিতামহের সময়ের গজারি কাঠ ও এঁটেল লাল মাটির মিলনে গঠিত কাঠের বারন্দা দিয়ে ঘেরা এই দোতলা বাড়িটির জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কঙ্কাল পোড়ামাটি। মানুষজন আগ্রহভরে বললেন যে, দেশ স্বাধীন হয়েছে এখন আর চিন্তা নেই। ঐ পোড়া-ভিটায় আবারো বাড়ি উঠবে। আব্বু উত্তর দিলেন, যত দিন বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা না হবে তত দিন ঐ ভিটায় বাড়ি উঠবে না। (আব্বু বেঁচে থাকতে ঐ ভিটায় বাড়ি ওঠেনি। মফিজ কাকুর পরিবার বহু পরে একটি সাধারণ ঘর তুলেছিলেন।) এলাকার উন্নয়ন প্রসঙ্গে আব্বু বললেন যে, তিনি তো শুধু তাঁর এলাকার মন্ত্রী নন, তিনি সারা বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী। উন্নয়ন শুরু করতে হবে সারা বাংলাদেশেই, সমানভাবে। তাঁর এলাকাকে প্রাধান্য দিলে তা হবে স্বার্থপরের মতো কাজ। এ প্রসঙ্গে আব্বু এক সহজ সুন্দর উদাহরণ টানলেন। বললেন, আমাদের দেশের রীতি হলো মেহমানকে আদর-যতœ করে ভালো ভালো খাবার খাইয়ে তারপর যা থাকে নিজেরা ভাগ করে খাওয়া। সুতরাং এলাকাবাসীকেও চিন্তা করতে হবে সামগ্রিকভাবে। সারা বাংলাদেশকে আদর-যতœ করে গড়ার কথা ভাবনায় রাখতে হবে। আমরা একনিষ্ঠভাবে আব্বুর কথা শুনছি, হƒদয়ে গেঁথে নিচ্ছি তাঁর প্রতিটি কথা। প্রত্যক্ষ করছি তাঁর কাজের মাঝে কথার অসামান্য প্রতিফলনকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বর্বরতার বর্ণনার পাশাপাশি এক পাকিস্তানি অফিসারের মানবিকতারও বর্ণনা দিয়েছেন শারমিন আহমদ। তিনি লিখেছেন, বিজয়ের মাত্র ক’দিন আগেই বড় মামু ও তাঁর পরিবার প্রাণে বেঁচে যান এক পাকিস্তানি সেনা অফিসারের বদান্যতায়। বিজয়ের চার মাস আগে বড় মামুর পাশের হিন্দু প্রতিবেশীর বাড়িটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দখল করে নেয় এবং সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। বাড়ির মালিক তার আগেই পরিবারসহ আত্মগোপন করেছেন। ক্যাম্প স্থাপনের পর ক্যাম্পের মেজর বোখারী নামের এই অফিসার বড় মামুর বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেন। তাঁর ব্যবহার খুব ভালো। তিনি জানান যে পরিবার থেকে এতদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে তাঁর আর ভালো লাগছে না। ঘরের খাবার, ঘরোয়া পরিবেশ ইত্যাদি তিনি খুব মিস করছেন। অতিথিপরায়ণ, উদারচিত্ত বড় মামু তাঁকে প্রায়ই মধ্যাহ্নভোজ বা নৈশভোজে ডেকে নিতেন। অফিসার বড় মামির রান্নার খুব প্রশংসা করতেন এবং বড় মামুকে সম্বোধন করতেন ‘ভাই’ বলে। ১৩ ডিসেম্বর সকালে কারফিউ ওঠার পর বড় মামু বাজার নিয়ে ঘরে ফেরেন। তার কিছুক্ষণ পরই সেই অফিসার ঘরে ঢুকে বড় মামুকে নিভৃতে কিছু কথা বলে বেরিয়ে যান। বড় মামু মামিকে বলেন যে অতিসত্বর ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি যেন গাড়িতে ওঠেন। গোটা বাজার রান্নাঘরে যেখানে আছে তেমনই থাকুক। ঘটনা গুরুত্বর। গাড়িতে উঠে বড় মামু ঘটনা খুলে বলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে ঐ অফিসারকে নিয়োগ করা হয়েছিল বড় মামুর ওপর নজর রাখতে। তারা জানত যে জোহরা তাজউদ্দীন তাঁর বোন। বোনের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ রয়েছে কি না সে সম্বন্ধে তথ্য আদায়ের জন্য তিনি বড় মামুর সঙ্গে ভাব করেন। ক’মাস মেলামেশার পর বুঝতে পারেন যে বোনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই। ঘর-সংসারের দায়িত্ব পালনেই এই ব্যক্তি ব্যস্ত। এরই মধ্যে ব্যক্তিগতভাবেও বড় মামুকে তাঁর ভালো লেগে যায়। সেইদিন তিনি খবর পেয়েছেন যে আজ কিবরিয়া সাহেবের (বড় মামু) বাড়ির প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হবে। সংকেতটি গুরুত্বর। তিনি যেহেতু তাঁকে ভাই সম্বোধন করেছেন সেই কারণে ভাই হিসেবে তিনি এসেছেন তাঁকে সতর্ক করতে। অবিলম্বে কিবরিয়া ভাই যেন পরিবারসহ গৃহ ত্যাগ করেন। অফিসারের সতর্কবাণী অনুসারে বড় মামু তাঁর পরিবারকে নিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন ধানমন্ডি থেকে অনেক দূরে গোপীবাগে তাঁর বন্ধুর বাড়িতে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা মুক্ত হওয়ার পর বিজয়ের আনন্দমুখর পরিবেশে ফিরে এলেন নিজ গৃহে। ফিরে এসে বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছে শুনলেন যে তিনি গৃহত্যাগ করার পর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অবাঙালি, বাঙালি রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের বাড়ি ঘেরাও করে তল্লাশি চালায়। তারা যে ট্রাকে করে এসেছিল সেই ট্রাকের মধ্যে কালো কাপড়ে চোখ ও মুখ বাঁধা বেশ কিছু তরুণ ও মধ্যবয়সীকেও সে দেখতে পায়। তাদের কারো কারো আচরণে মনে হয় যে তারা যেন পিতা ও পুত্র বা নিকট আত্মীয়। কুখ্যাত বদরবাহিনী বুদ্ধিজীবীদের অনেককে তো এভাবেই কালো কাপড়ে চোখমুখ বেঁধে হত্যা করে বিজয়ের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। বড় মামু ও তাঁর পরিবারকে যে অফিসার বাঁচিয়েছিলেন তার খোঁজ বড় মামু স্বাধীনতার পর পান বহু কষ্টে। ঢাকা সেনানিবাসে তিনি ছিলেন অন্য যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে। বড় মামুকে দেখে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ভারতে এ চ.ঙ.ড ক্যাম্পে না যাওয়া পর্যন্ত বড় মামু এই যুদ্ধবন্দির খোঁজখবর নিতেন। কখনো তিনি তাঁর জন্য নিয়ে যেতেন শীতের কাপড়, খাবারদাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। সীমা লঙ্ঘন, নিষ্ঠুরতা ও নিমর্মতার মধ্যেও মান
Comments
Post a Comment