কৃতজ্ঞ হতেও ভুলে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী
তার চেয়েও বেশি মারাত্মক ভুল হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের কথা ভুলে যাওয়া। একাত্তরে বাংলাদেশের আপামর ছাত্র-জনতা কিসের লক্ষ্যে অত্যাধুনিক পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল? শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, গণতন্ত্র নেশার মতো বাংলাদেশের মানুষের শিরায় শিরায়। এই গণতন্ত্রের জন্যই তারা একাত্তরে প্রায় খালি হাতে হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। গণতন্ত্রকে হত্যা করে বর্তমান সরকারও পঁচাত্তরের বাকশালী সরকারের মতো জনতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। পঁচাত্তরে পরিণতি ভালো হয়নি। এবারে হবে কী?
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতিশক্তি দুর্বল। ওয়াশিংটনের মুখে চপেটঘাত করার সময় তিনি ভুলে যান যে মার্কিন সরকারের কাছে তার কৃতজ্ঞ থাকার অনেক ব্যক্তিগত কারণও আছে। ২০১০ সালে শেখ হাসিনার সাথে দীর্ঘ টেলিফোন আলাপে সন্তুষ্ট হতে না পেরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন সে টেলিফোন কথোপকথনের পূর্ণ বিবরণ মিডিয়ায় ফাঁস করে দিয়েছিলেন। সে বিবরণে স্পষ্ট শেখ হাসিনাকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছিল যে ২০০৮ সালে দিল্লি আর ওয়াশিংটন সম্মিলিত চেষ্টা করে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী এবং তাকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তিনি এখন এক পৃষ্ঠপোষককে পরিত্যাগ করে ও চটিয়ে সম্পূর্ণরূপে অন্য পৃষ্ঠপোষককে আঁকড়ে ধরেছেন। সেটা ওয়াশিংটনের জন্য সুখকর অনুভূতি নয়।
রফতানিতে জিএসপি সুবিধা হারানো ছাড়া আরো একটা গুরুতর হুমকি দেয়া হয়েছে মার্কিন সিনেট পররাষ্ট্র কমিটির দ্বিতীয় এবং সর্বসাম্প্রতিক শুনানিতে। বলা হয়েছে, নতুন করে বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা না হলে এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে শুধু এমন প্রকল্পেই অর্থ সাহায্য দেবে যেসব প্রকল্পে সংসদ সদস্যদের ভূমিকার সুযোগ থাকবে না। বিগত সংসদে আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যদের কারো কারো সম্পদ শত গুণ এবং হাজার গুণ বেড়েছিল। সে লালসায় পড়ে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনেও কেউ কেউ লাখের এবং কোটির অঙ্কে টাকা ব্যয় করেছেন। মার্কিন সিনেটের উপরোল্লিখিত ঘোষণা অবশ্যই তাদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হবে।
বিদেশী মুদ্রা অর্জনের ওপর এ দু’টি হুমকি আসছে এমন সময় যখন রেমিট্যান্সের আয় দ্রুত পড়ে যাচ্ছে। সরকারের ভুল পররাষ্ট্রনীতির কারণে উপসাগরীয় দেশগুলোসহ বহু দেশ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে কিংবা কমিয়েছে। অর্থাৎ রেমিট্যান্স আরো কমে যাবে।
সরকারের অন্তরে আতঙ্ক?
মনে হচ্ছে সরকারের কোথাও না কোথাও দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টায় পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের নেতৃত্বে একটা প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়েছে ওয়াশিংটনে। কিছু গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢাললে কোনো লাভ হবে? বাংলাদেশ নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগের কারণ মৌল। মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশকে অর্থ সাহায্য, রাজনৈতিক সমর্থন এবং বাণিজ্যিক সুবিধা দেয় সে দেশে এবং সে অঞ্চলে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র মজবুত করার আশায়। বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ঘটেছে সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার-স্যাপার। এই পাঁচ বছরে মানবাধিকার বলতে তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই বাংলাদেশে। রাজনৈতিক মতদ্বৈধের কারণে বিচারবহির্ভূতভাবে বহু লোককে হত্যা করা হয়েছে এ সময়ে। মিথ্যা সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে, ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের মিথ্যা অজুহাতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে। গুম ও খুনের ঘটনা এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গণতন্ত্রের নাম-নিশানা মুছে ফেলার সব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বাংলাদেশে। গদি পাওয়ার সময় থেকেই সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের সব রকমের ব্যবস্থা হয়েছে। বিরোধীদের সভা-সমাবেশ এবং মিছিল করে রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিএনপি দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একাধিকবার পুলিশ হামলা করেছে, কার্যালয়টি বহুবার বন্ধ কিংবা পুলিশ বেষ্টিত করা হয়েছে। হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মী সাজানো মামলায় কারারুদ্ধ আছেন। সরকার মুখে অস্বীকার করলেও কারোই বুঝতে বাকি নেই যে, সংবাদের স্বাধীনতা সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
মেহেরুন রুনি ও তার স্বামী সাগরসহ ২৩ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন এই পাঁচ বছরে। আহত ও নির্যাতিত হয়েছেন আরো কয়েক শ’। মাহমুদুর রহমান আজো বিনা বিচারে বন্দী আছেন। আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানা এখনো তালাবন্ধ। দিগন্ত ও ইসলামী টেলিভিশন এখনো নীরব। ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরের সত্য বিবরণ প্রকাশের দায়ে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের নেতাদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা রুজু করা হয়েছে। এই পাঁচ বছর ধরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সরকার সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত হেনেছে গণতন্ত্রের ওপর। কোনো কোনো মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতা গোড়া থেকেই বলে এসেছেন যে, একটা বাকশালী ধাঁচের (একদলীয়) সরকার প্রতিষ্ঠাই তাদের কাম্য। সরকারের কাজকর্মেও অহরহ দেখা গেছে যে তারা যেকোনো মূল্যে গদি দখল করে থাকতে চায়। যেভাবে তারা দশম সংসদ নির্বাচনে এগোচ্ছিল তাতে নির্বাচন ন্যায্য এবং নিরপেক্ষ হবে বলে কেউ আশা করতে পারেনি। দেশ-বিদেশে এ বিশ্বাসই বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, একটা লোক-দেখানো নির্বাচনের অভিনয় করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাই সরকারের লক্ষ্য। সে কারণে কোনো দেশই সে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে রাজি হয়নি। একমাত্র ভারত ছাড়া পৃথিবীর অন্য সব দেশই সংলাপের মাধ্যমে স্বীকৃত একটা পদ্ধতিতে সবার গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন করার পরামর্শ দিয়েছিল সরকারকে। কিন্তু সবাই লক্ষ করেছেন একমাত্র দিল্লি ছাড়া অন্য কারো পরামর্শ এ সরকারের গ্রহণযোগ্য নয়।
সাজানো ভিডিওতে কেউ বিভ্রান্ত হবে না
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্য সব সাহায্য দাতা দেশ ও সংস্থা যে শেখ হাসিনার সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট এসব হচ্ছে তার কারণ। সাধারণ বুদ্ধির একটা প্রবাদ বহু দেশে আছে। ইংরেজিতে ‘ডোন্ট বাইট দ্য হ্যান্ড, দ্যাট ফিডস ইউ’ Ñ যে হাত ভাত দেয় সে হাত কামড়াতে নেই। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জেও বলেÑ যে গাই দুধ দেয় তার লাথিও সই। এগুলোসহ বহু হিত কথাতেই যে তাদের বিশ্বাস নেই বর্তমান সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা বারবার তার প্রমাণ দিয়েছেন।
পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে যে প্রতিনিধিদলটি ওয়াশিংটনে গেছে তাকে কতখানি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে জানি না। কিন্তু এ কথা মোটামুটি বলা যায় যে, উপরোল্লিখিত পুরানো দাবিগুলো গ্রহণ করা না হলে মার্কিন সরকার জিএসপি কিংবা প্রকল্প সাহায্যের ব্যাপারে তাদের মনোভাব শিথিল করবে বলে মনে হয় না। অনেকে মনে করছেন, হয়তো সেটা বুঝে গিয়েই সরকার এখন হিটলারি ছলনার আশ্রয় নিয়েছে। আলকায়েদা প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির নামে যে ভিডিওটি গত কয় দিনে প্রচার করা হচ্ছে সেটাকে এ আলোকেই বিচার করতে হবে বলে তারা মনে করেন। নাইন-ইলেভেনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আলকায়েদা ভীতি তুঙ্গে উঠেছিল। তার অপসুযোগ নিয়ে মার্কিন জনমতকে প্রভাবিত করা অবশ্যই এই ওয়েবসাইটের আনাড়ি প্রচেষ্টা। সরকারের গয়েবলসরা আদাজল খেয়ে এ নিয়ে অপবাদ ছড়াচ্ছেন। কেউ হেফাজতে ইসলাম, কেউ জামায়াত আর কেউ বিএনপিকে সেজন্য দায়ী করার চেষ্টা করেছেন। সরকারের মি. গয়েবলস হাছান মাহমুদ তো সরাসরি খালেদা জিয়াকেই সেজন্য দায়ী করেছেন।
তারা সবাই সরকারের অপপ্রচারকে খণ্ডন করেছেন। তারপর থেকে আলকায়েদা নেতা স্বয়ং বলেছেন যে এই ভিডিওর সাথে তার সংস্থার কোনো সম্পর্ক নেই। অবশ্য সাধারণ মানুষও সরকারের অপপ্রচারে কান দেয়নি। তারা সন্দেহ করছে র-কে। তা ছাড়া ইন্টারনেট প্রচারের আবাসিক বিশেষজ্ঞ তো গণভবনেই আছেন। পররাষ্ট্র সচিবের মিশনের সায়াহ্নের এসব অপপ্রচারে ওয়াশিংটনের মনোভাব প্রভাবিত হবে কি না সে প্রশ্ন অনেকের মনেই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আলোচ্য ভিডিও সম্বন্ধে স্টেট ডিপার্টমেন্টের (মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর) প্রতিক্রিয়া থেকে তো মনে হয় সরকারের আশাবাদী হওয়ার কারণ নেই।
(লন্ডন, ১৮.০২.১৪)
বিবিসি বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান
serajurrahman34@gmail.com
Comments
Post a Comment