জনপ্রিয়তা প্রমাণে ফলাফল পাল্টে দেয়ার ছক চূড়ান্ত?
বিরোধী নেতা-কর্মীদের হত্যা-নির্যাতন ও গ্রেফতার চলছেই
মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : দশম জাতীয় সংসদের আদলে উপজেলা নির্বাচনেও আরেকটি ‘প্রহসনের’ নির্বাচন আয়োজনের ছক চূড়ান্ত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। তারা চায় জাতীয় সংসদের মতো একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন। যাতে করে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে ফলাফল নিজেদের মতো করে ঘোষণা করতে পারে। এমন অভিযোগ বিএনপিসহ দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, কাল বুধবার অনুষ্ঠিতব্য প্রথম দফার ৯৭টি উপজেলা নির্বাচনকে টার্গেট করেছে তারা। সরকারি দলের বাইরে অন্য প্রার্থী এমনকি তাদের ভোটাররাও যাতে কেন্দ্রে আসতে না পারে তার সবরকম আয়োজনও করেছে সরকারি দল। অনুষ্ঠিতব্য অধিকাংশ উপজেলার বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দেয়া হয়েছে। অনেকে রয়েছেন কারাগারে। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধেও মামলা দেয়া হয়েছে অসংখ্য। সরকারের আজ্ঞাবহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দলের ক্যাডারদের হামলা, গুম, নির্যাতন, মেরে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া অব্যাহত রয়েছে। বিরোধী জোটের অভিযোগ, পরাজয় নিশ্চিত জেনেই সরকারি দল এখন উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল ‘হাইজ্যাক’ করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে দেশব্যাপী প্রশাসন ও সরকারি দলের এমন তা-বী ও অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে বিএনপি নির্বাচন বয়কটেরও হুমকি দিয়েছে। তবে বিরোধী দলের এমন অভিযোগ আমলে না নিয়ে নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। এমনকি প্রশাসন যদি পক্ষপাতমূলক কিছু করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সূত্র মতে, আসন্ন চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে এক ধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছে। দুর্নীতি, অপশাসন, নির্যাতন, গুম, লুটপাট, দখল, হত্যা, মিথ্যা মামলা দায়েরসহ নানান অপকর্মের কারণে ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা এখন শূন্যের কোটায়। যার প্রমাণ মিলেছে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে। বিরোধী জোটবিহীন নির্বাচনে মাত্র ৫ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না ১৫৩টি আসনে। অর্ধশত কেন্দ্রে কোনো ভোটারই যাননি। এমন পরিস্থিতিতে উপজেলা নির্বাচনে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াত এই নির্বাচনে অংশ নেয়ায় তাদের মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে। জনপ্রিয়তা প্রমাণে তারা এখন কেন্দ্র দখল, ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদান, প্রশাসনকে ব্যবহার করে ফলাফল পাল্টে দেয়ার কৌশল অবলম্বন করছে। তার পাশাপাশি মামলা, গ্রেফতার, হুমকি দেয়াসহ এমন কিছু নেই যা তারা করছে না।
বিএনপিকে প্রতিহতের পাশাপাশি দেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীদেরকে যেকোন মূল্যে পরাজিত করতে সব ধরনের আটঘাট বেঁধে নেমেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের নামে মিথ্যা অভিযোগে দলটির শীর্ষ নেতাদের বিচারের বিরুদ্ধে যাতে ভোটাররা তাদের মত প্রকাশ করতে না পারে সেজন্য জামায়াতের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে তারা। এমনকি সম্ভাব্য স্থানে প্রার্থী ও ভোটারদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানির পাশাপাশি গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে। ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে না যায় সেজন্য জীবননাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব ও নির্বাচন মনিটরিংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, উপজেলা নির্বাচনকে ‘প্রহসনের’ নির্বাচনে পরিণত করতে সুপরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ষড়যন্ত্রের ‘সবুজ সংকেত’ দেয়া হয়েছে। দেশে এখন কোনো আইনের শাসন নেই। এক ব্যক্তির ইচ্ছা বাস্তবায়নে চলছে হুকুমবাদ চর্চা। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘ডেথ ওয়ারেন্ট’ দেয়া হয়েছে। রিজভী বলেন, আওয়ামী লীগ মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রকে হত্যা করে। ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে এখন অপ্রতিরোধ্য সন্ত্রাস চালাচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচনে যাতে বিরোধী দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হতে না পারে সেজন্য দেশব্যাপী সরকারি দল সন্ত্রাস চালাচ্ছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পাইকারিভাবে গ্রেফতার করা হচ্ছে। গুম, খুন অব্যাহত আছে। র্যাব, পুলিশ ও প্রশাসন সবাই শুধু এক ব্যক্তির হুকুমই পালন করছে।
এদিকে উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতার, হয়রানি এবং অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে জ্যেষ্ঠ নেতাদের জেলে ঢোকানোর প্রতিবাদে খুলনা বিভাগে উপজেলা নির্বাচন বয়কটের হুমকি দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম। গতকাল দুপুরে যশোর প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এ বিষয়ে তার দলের এই অবস্থানের কথা জানান। তিনি বলেন, বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিগত জাতীয় নির্বাচনে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাননি। ফলে সরকার একটি প্রহসনের নির্বাচন করতে পেরেছে। এবারের উপজেলা নির্বাচনেও তারা জনগণকে ভোটকেন্দ্রে দেখতে চায় না। তিনি বলেন, খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় তার দলের নেতা-কর্মীদের ওপর সরকারি বিভিন্ন বাহিনী ও শাসক দলের গু-ারা নির্যাতন চালাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যেতে ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। নেতা-কর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা করা হচ্ছে। এসব মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে পুলিশ ‘গ্রেফতার বাণিজ্য’ করছে।
তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজানো হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে আক্ষেপ করে তরিকুল ইসলাম বলেন, প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তারা আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি দেখবেন। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের কাছে এসব অভিযোগ দিয়ে কোনো লাভও নেই। তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাচন অন্তত ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ সুষ্ঠু হলেও খুলনা বিভাগে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের বেশিরভাগই নির্বাচিত হবেন।
সূত্র জানায়, উপজেলা নির্বাচনে বিরোধীদলীয় প্রার্থী এবং ভোটারা যাতে কেন্দ্রে যেতে না পারেন সেজন্য দেশব্যাপী সন্ত্রাস চালাচ্ছে সরকারি দল। একাজে তাদের সহায়তা করছে প্রশাসন। জানা গেছে, হামলার অংশ হিসেবে গতকাল ফেনী সদর উপজেলার ফরহাদনগরে ১৯ দলীয় জোট সমর্থিত ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী মুহাম্মদ আবদুর রহীম ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী জুলেখা আক্তার ডেইজীর সাথে গণসংযোগে অংশ নেয়ায় জামায়াত নেতা আবুল খায়েরের (৭০) ওপর অতর্কিত হামলা করেছে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ ক্যাডাররা। এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গুরুতর আহতাবস্থায় তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। জেলার লেমুয়ার উত্তর চাঁদপুরে ১৯ দলীয় প্রার্থীর পোস্টার ছিঁডে ফেলার অভিযোগ করেছে বিএনপি নেতারা। ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফেরদৌস কোরাইশি জানান, চাঁদপুর এলাকার বিভিন্ন স্থানে সরকারদলীয় নেতারা বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের হুমকি-ধমকি ও এলাকার বিভিন্ন স্থানে প্রার্থীদের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছে।
দেশব্যাপী সরকারি দলের তা-ব ও প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) জাবেদ আলী বলেছেন, আসন্ন উপজেলা নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে কমিশন বদ্ধপরিকর। এজন্য মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রার্থীদের আচরণ বিধি লংঘনের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে নওগাঁর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপির উপজেলা নির্বাচন মনিটরিং সেলের সদস্য, দলের যুগ্ম-মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, উপজেলা নির্বাচনকে পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজি হিসেবে গ্রহণ করেছে ১৯ দলীয় জোট। এই নির্বাচন সরকারের জন্য অ্যাসিড টেস্ট। নির্বাচন যদি মোটামুটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, তাহলে প্রথম পর্বের ৯৭টি উপজেলার মধ্যে বিএনপি ও ১৯ দলীয় জোটের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিজয়ী হবেন কমপক্ষে ৭০ থেকে ৭৫টিতে। অন্যদিকে সরকার যদি ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা প্রহসনের নির্বাচনের অপচেষ্টা চালায়, তবে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই বিএনপি তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলবে। কোনো ছাড় দেয়া হবে না।
সূত্র মতে, চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামীকাল বুধবার ৯৭ উপজেলা নির্বাচনের সংশ্লিষ্ট উপকরণ ইতোমধ্যে নির্বাচনী এলাকায় পৌঁছেছে বলে নিশ্চিত করেছেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আশফাকুর রহমান। ইসি সূত্র জানায়, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ব্যালট, বক্স ও অন্যান্য উপকরণ নেয়া শুরু হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রতিনিধির মাধ্যমে এসব উপজেলায় উপকরণ পাঠানো হয়েছে। আইনশৃংখলা রক্ষায় নির্বাচনী উপজেলাগুলোতে বিজিবি মোতায়েনের পাশাপাশি সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য বাহিনী ভোটারদের নিরাপদে ভোট দেয়ার জন্য মাঠে কাজ করবে বলে ইসি সূত্র জানিয়েছে।
ইসির তথ্যানুযায়ী ৯৭টি উপজেলায় ১ হাজার ২৭৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান প্রার্থী রয়েছেন ৪৩২ জন। ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ৫১৩ জন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ৩২৯ জন। এসব এলাকায় মোট ভোটার সংখ্যা ১ কোটি ৬৪ লাখ ৭৮ হাজার ১৭২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৮১ লাখ ৯১ হাজার ৫৩৭ জন আর নারী ভোটার ৮২ লাখ ৮৬ হাজার ৬৩৫ জন। ৯৭টি উপজেলায় মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৬ হাজার ৯৯৫টি ও ভোটকক্ষ ৪৩ হাজার ২৯০টি। পোলিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ৮৬ হাজার ৫৮০ জন। নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী, নির্বাচনী কর্মী বা ভোটাদের আইন লংঘনে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিতে ৯৭ উপজেলায় ৩৮৮ জন নির্বাহী ও ৯৭ জন বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। মোবাইল টিমের দায়িত্বে থাকা এসব ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আচরণবিধি লংঘনের জন্য সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয়দ- দিতে পারবেন। অপরদিকে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটরা নির্বাচনপূর্ব অনিয়ম তদন্তে সামারি ট্রায়ালের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিক সাজা ও অর্থদ- দিতে পারেন। এসব কর্মকর্তারা নির্বাচনী এলাকায় নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করবেন।
মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : দশম জাতীয় সংসদের আদলে উপজেলা নির্বাচনেও আরেকটি ‘প্রহসনের’ নির্বাচন আয়োজনের ছক চূড়ান্ত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। তারা চায় জাতীয় সংসদের মতো একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন। যাতে করে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে ফলাফল নিজেদের মতো করে ঘোষণা করতে পারে। এমন অভিযোগ বিএনপিসহ দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, কাল বুধবার অনুষ্ঠিতব্য প্রথম দফার ৯৭টি উপজেলা নির্বাচনকে টার্গেট করেছে তারা। সরকারি দলের বাইরে অন্য প্রার্থী এমনকি তাদের ভোটাররাও যাতে কেন্দ্রে আসতে না পারে তার সবরকম আয়োজনও করেছে সরকারি দল। অনুষ্ঠিতব্য অধিকাংশ উপজেলার বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দেয়া হয়েছে। অনেকে রয়েছেন কারাগারে। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধেও মামলা দেয়া হয়েছে অসংখ্য। সরকারের আজ্ঞাবহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দলের ক্যাডারদের হামলা, গুম, নির্যাতন, মেরে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া অব্যাহত রয়েছে। বিরোধী জোটের অভিযোগ, পরাজয় নিশ্চিত জেনেই সরকারি দল এখন উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল ‘হাইজ্যাক’ করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে দেশব্যাপী প্রশাসন ও সরকারি দলের এমন তা-বী ও অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে বিএনপি নির্বাচন বয়কটেরও হুমকি দিয়েছে। তবে বিরোধী দলের এমন অভিযোগ আমলে না নিয়ে নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। এমনকি প্রশাসন যদি পক্ষপাতমূলক কিছু করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সূত্র মতে, আসন্ন চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে এক ধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছে। দুর্নীতি, অপশাসন, নির্যাতন, গুম, লুটপাট, দখল, হত্যা, মিথ্যা মামলা দায়েরসহ নানান অপকর্মের কারণে ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা এখন শূন্যের কোটায়। যার প্রমাণ মিলেছে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে। বিরোধী জোটবিহীন নির্বাচনে মাত্র ৫ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না ১৫৩টি আসনে। অর্ধশত কেন্দ্রে কোনো ভোটারই যাননি। এমন পরিস্থিতিতে উপজেলা নির্বাচনে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াত এই নির্বাচনে অংশ নেয়ায় তাদের মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে। জনপ্রিয়তা প্রমাণে তারা এখন কেন্দ্র দখল, ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদান, প্রশাসনকে ব্যবহার করে ফলাফল পাল্টে দেয়ার কৌশল অবলম্বন করছে। তার পাশাপাশি মামলা, গ্রেফতার, হুমকি দেয়াসহ এমন কিছু নেই যা তারা করছে না।
বিএনপিকে প্রতিহতের পাশাপাশি দেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীদেরকে যেকোন মূল্যে পরাজিত করতে সব ধরনের আটঘাট বেঁধে নেমেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের নামে মিথ্যা অভিযোগে দলটির শীর্ষ নেতাদের বিচারের বিরুদ্ধে যাতে ভোটাররা তাদের মত প্রকাশ করতে না পারে সেজন্য জামায়াতের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে তারা। এমনকি সম্ভাব্য স্থানে প্রার্থী ও ভোটারদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানির পাশাপাশি গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে। ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে না যায় সেজন্য জীবননাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব ও নির্বাচন মনিটরিংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, উপজেলা নির্বাচনকে ‘প্রহসনের’ নির্বাচনে পরিণত করতে সুপরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ষড়যন্ত্রের ‘সবুজ সংকেত’ দেয়া হয়েছে। দেশে এখন কোনো আইনের শাসন নেই। এক ব্যক্তির ইচ্ছা বাস্তবায়নে চলছে হুকুমবাদ চর্চা। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘ডেথ ওয়ারেন্ট’ দেয়া হয়েছে। রিজভী বলেন, আওয়ামী লীগ মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রকে হত্যা করে। ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে এখন অপ্রতিরোধ্য সন্ত্রাস চালাচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচনে যাতে বিরোধী দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হতে না পারে সেজন্য দেশব্যাপী সরকারি দল সন্ত্রাস চালাচ্ছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পাইকারিভাবে গ্রেফতার করা হচ্ছে। গুম, খুন অব্যাহত আছে। র্যাব, পুলিশ ও প্রশাসন সবাই শুধু এক ব্যক্তির হুকুমই পালন করছে।
এদিকে উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতার, হয়রানি এবং অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে জ্যেষ্ঠ নেতাদের জেলে ঢোকানোর প্রতিবাদে খুলনা বিভাগে উপজেলা নির্বাচন বয়কটের হুমকি দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম। গতকাল দুপুরে যশোর প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এ বিষয়ে তার দলের এই অবস্থানের কথা জানান। তিনি বলেন, বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিগত জাতীয় নির্বাচনে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাননি। ফলে সরকার একটি প্রহসনের নির্বাচন করতে পেরেছে। এবারের উপজেলা নির্বাচনেও তারা জনগণকে ভোটকেন্দ্রে দেখতে চায় না। তিনি বলেন, খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় তার দলের নেতা-কর্মীদের ওপর সরকারি বিভিন্ন বাহিনী ও শাসক দলের গু-ারা নির্যাতন চালাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যেতে ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। নেতা-কর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা করা হচ্ছে। এসব মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে পুলিশ ‘গ্রেফতার বাণিজ্য’ করছে।
তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজানো হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে আক্ষেপ করে তরিকুল ইসলাম বলেন, প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তারা আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি দেখবেন। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের কাছে এসব অভিযোগ দিয়ে কোনো লাভও নেই। তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাচন অন্তত ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ সুষ্ঠু হলেও খুলনা বিভাগে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের বেশিরভাগই নির্বাচিত হবেন।
সূত্র জানায়, উপজেলা নির্বাচনে বিরোধীদলীয় প্রার্থী এবং ভোটারা যাতে কেন্দ্রে যেতে না পারেন সেজন্য দেশব্যাপী সন্ত্রাস চালাচ্ছে সরকারি দল। একাজে তাদের সহায়তা করছে প্রশাসন। জানা গেছে, হামলার অংশ হিসেবে গতকাল ফেনী সদর উপজেলার ফরহাদনগরে ১৯ দলীয় জোট সমর্থিত ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী মুহাম্মদ আবদুর রহীম ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী জুলেখা আক্তার ডেইজীর সাথে গণসংযোগে অংশ নেয়ায় জামায়াত নেতা আবুল খায়েরের (৭০) ওপর অতর্কিত হামলা করেছে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ ক্যাডাররা। এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গুরুতর আহতাবস্থায় তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। জেলার লেমুয়ার উত্তর চাঁদপুরে ১৯ দলীয় প্রার্থীর পোস্টার ছিঁডে ফেলার অভিযোগ করেছে বিএনপি নেতারা। ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফেরদৌস কোরাইশি জানান, চাঁদপুর এলাকার বিভিন্ন স্থানে সরকারদলীয় নেতারা বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের হুমকি-ধমকি ও এলাকার বিভিন্ন স্থানে প্রার্থীদের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছে।
দেশব্যাপী সরকারি দলের তা-ব ও প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) জাবেদ আলী বলেছেন, আসন্ন উপজেলা নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে কমিশন বদ্ধপরিকর। এজন্য মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রার্থীদের আচরণ বিধি লংঘনের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে নওগাঁর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপির উপজেলা নির্বাচন মনিটরিং সেলের সদস্য, দলের যুগ্ম-মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, উপজেলা নির্বাচনকে পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজি হিসেবে গ্রহণ করেছে ১৯ দলীয় জোট। এই নির্বাচন সরকারের জন্য অ্যাসিড টেস্ট। নির্বাচন যদি মোটামুটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, তাহলে প্রথম পর্বের ৯৭টি উপজেলার মধ্যে বিএনপি ও ১৯ দলীয় জোটের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিজয়ী হবেন কমপক্ষে ৭০ থেকে ৭৫টিতে। অন্যদিকে সরকার যদি ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা প্রহসনের নির্বাচনের অপচেষ্টা চালায়, তবে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই বিএনপি তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলবে। কোনো ছাড় দেয়া হবে না।
সূত্র মতে, চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামীকাল বুধবার ৯৭ উপজেলা নির্বাচনের সংশ্লিষ্ট উপকরণ ইতোমধ্যে নির্বাচনী এলাকায় পৌঁছেছে বলে নিশ্চিত করেছেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আশফাকুর রহমান। ইসি সূত্র জানায়, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ব্যালট, বক্স ও অন্যান্য উপকরণ নেয়া শুরু হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রতিনিধির মাধ্যমে এসব উপজেলায় উপকরণ পাঠানো হয়েছে। আইনশৃংখলা রক্ষায় নির্বাচনী উপজেলাগুলোতে বিজিবি মোতায়েনের পাশাপাশি সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য বাহিনী ভোটারদের নিরাপদে ভোট দেয়ার জন্য মাঠে কাজ করবে বলে ইসি সূত্র জানিয়েছে।
ইসির তথ্যানুযায়ী ৯৭টি উপজেলায় ১ হাজার ২৭৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান প্রার্থী রয়েছেন ৪৩২ জন। ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ৫১৩ জন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ৩২৯ জন। এসব এলাকায় মোট ভোটার সংখ্যা ১ কোটি ৬৪ লাখ ৭৮ হাজার ১৭২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৮১ লাখ ৯১ হাজার ৫৩৭ জন আর নারী ভোটার ৮২ লাখ ৮৬ হাজার ৬৩৫ জন। ৯৭টি উপজেলায় মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৬ হাজার ৯৯৫টি ও ভোটকক্ষ ৪৩ হাজার ২৯০টি। পোলিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ৮৬ হাজার ৫৮০ জন। নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী, নির্বাচনী কর্মী বা ভোটাদের আইন লংঘনে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিতে ৯৭ উপজেলায় ৩৮৮ জন নির্বাহী ও ৯৭ জন বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। মোবাইল টিমের দায়িত্বে থাকা এসব ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আচরণবিধি লংঘনের জন্য সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয়দ- দিতে পারবেন। অপরদিকে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটরা নির্বাচনপূর্ব অনিয়ম তদন্তে সামারি ট্রায়ালের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিক সাজা ও অর্থদ- দিতে পারেন। এসব কর্মকর্তারা নির্বাচনী এলাকায় নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করবেন।
Comments
Post a Comment