জাহাঙ্গীর জানেন না, কী তাঁর অপরাধ

১৯ দিন আটকের পর মুক্তির আনন্দে জাহাঙ্গীর। ছবি: প্রথম আলো

কমল জোহা খান | আপডেট: ০৯:২৬, ফেব্রুয়ারী ০১, ২০১৪
‘ভাই, আমার অপরাধ কী আমি জানলাম না। কিন্তু ১৯ দিন আমারে আটকাইয়্যা রাখা হয়। কারা আটকাইছে তাও বুঝতে পারি নাই।’ গতকাল শুক্রবার দুপুরে টঙ্গীর ইজতেমার ময়দানে জুমার নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে কথাগুলো বলছিলেন ভ্যানচালক জাহাঙ্গীর আলম।
উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরে বেলা ১১টার দিকে নিজের টিনের ভাঙাচোরা ঘরের সমানে দাঁড়িয়ে এ কথা বলার সময় জাহাঙ্গীরের চোখেমুখে ছিল মুক্তির আনন্দ।
গত ১০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর বাসায় কাজ করার সময় মেহেদী মাসুদ নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে জাহাঙ্গীরকে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যান র্যাব পরিচয়ধারী কয়েক ব্যক্তি। এ ঘটনা সম্পর্কে ২৭ জানুয়ারি প্রথম আলো অনলাইনে ‘ভ্যানচালক জাহাঙ্গীরের হাদিস মিলছে না’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর পরই ওইদিন সন্ধ্যায় ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে বনানী থানায় নেওয়া হয় জাহাঙ্গীরকে। পর দিন ২৮ জানুয়ারি মঙ্গলবার নিম্ন আদালত থেকে মুক্তি পান তিনি।
আটক করে কোথায় নেওয়া হয়েছিল জানতে চাইলে বার বার আঁঁতকে উঠছিলেন ৩০ বছরের এই যুবক। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘উত্তরার হাউজ বিল্ডিংয়ের সামনে নেওয়ার পর মুখোশ লাগায়ে ফেলে। দু দিন পরে আমার চোখ খোলা হইছে।’
জাহাঙ্গীরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উত্তরা থেকে আটক করে মুখোশ পরিয়ে অনবরত ঘোরানো হয় তাঁকে। কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বুঝতে পারছিলেন না জাহাঙ্গীর। এ সময় ভয়ে সময়জ্ঞান ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য জাহাঙ্গীরের ধারণা, সাধারণ কোনো বাসায় তাঁকে নেওয়া হয়নি। লম্বা সিঁড়ি পার হয়ে হয়ে একটি ছোট ঘরে ঢোকানো হয় জাহাঙ্গীরকে।
জাহাঙ্গীর জানান, এ ঘরে কোনো জানালা বা বারান্দা ছিল না। ছিল না খাট কিংবা ফ্যান। মাথার ওপর শুধু একটি বাতি জ্বলত। বন্দিদশার প্রথম দু দিন আলোর দেখা পাননি তিনি। এ সময় তাঁর দু হাত বেধে কালো কাপড়ের মুখোশ পরিয়ে রাখা হয়। তিনি বলেন, ‘খাবারের সময় লোক এসে আমার মুখোশ খুইল্যা দিত। খাওয়া শেষ হইলে আবার মুখোশ পরাইয়্যা দিত।’
যে ব্যক্তিরা খাবার সরবরাহ করতেন জাহাঙ্গীরের কাছে তাঁদের সাধারণ লোকই মনে হয়েছে। খাবারের মান ভালোই ছিল। সকালে রুটি-ডাল, দুপুর ও রাতে ভাত-মাছ অথবা মাংস থাকত। সন্ধ্যা বেলায় মুড়ি খেতে দেওয়া হতো। প্রথম দিন জাহাঙ্গীরকে মাছ-ভাত ও আলু ভর্তা খেতে দেওয়া হয়েছিল।
বন্দিজীবনের আশপাশে কী ঘটছে তার কিছুই জানা ছিল না জাহাঙ্গীরের। যেন এক অজানা জগতে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল তাঁকে। চোখ দুটো বড় বড় করে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘চার দিকে শুধু ওয়াল আর ওয়াল। আলো-বাতাস কিছুই দেখি নাই। টিভির তো প্রশ্নই ওঠে না। আমার সঙ্গে আটক মেহেদী মাসুদের দেখাও হয়নি। তাঁর কোনো খবরও পাইনি।’
দীর্ঘ ১৯ দিন জাহাঙ্গীর কোন মারধর বা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। আটক করে রাখার কারণও ভয়ে জিজ্ঞেস করেননি জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতেও পারিনি কারা আমারে আটক করছে। র্যাব না পুলিশ কারা নিছে বুঝতে পারলে মনটারে বুঝাইতে পারতাম।’
এক কাপড় পরে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন জাহাঙ্গীর। কক্ষের ভেতর শৌচাগারে গোসল করতে হয়েছে। এ জন্য একটি পুরোনো গামছা দেওয়া হয় তাঁকে।
গত সোমবার রাতে জাহাঙ্গীরকে আবার মুখোশ পরানো হয়। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। থানা হাজতে ঢোকানোর পর মুখোশ খোলা হয়। হাজতি গো জিজ্ঞাস কইর্যা শুনছি আমারে বনানী থানায় আনা হইছে। পরে শুধু জানছি আমারে ৫৪ ধারায় আটক করা হইছে। কিন্তু আমার অপরাধ কী তা জানতে পারলাম না!
--------------------------------------------------------

ভ্যানচালক জাহাঙ্গীরের হদিস মিলছে না

কমল জোহা খান | আপডেট: ০৯:৩৫, জানুয়ারি ২৭, ২০১৪
ভ্যানচালক জাহাঙ্গীর আলমটানা দুই সপ্তাহ ধরে খোঁজ মিলছে না ভ্যানচালক জাহাঙ্গীর আলমের। পরিবারের অভিযোগ, র‌্যাব পরিচয়ে সবার সামনে দিয়ে ১০ জানুয়ারি  চার-পাঁচজনের একটি দল জাহাঙ্গীরকে তুলে নিয়ে গেছে। যদিও দেশের কোনো থানায় জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের খবর কেউ দিতে পারেনি।
ওই একই দিন উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টর থেকে মেহেদী মাসুদ নামের এক ব্যবসায়ীকেও একই দল তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ। জাহাঙ্গীরের বাবা নবর উদ্দিন শেখের দাবি, মালামাল সরবরাহের কাজে তাঁর ছেলে গিয়েছিলেন মেহেদী মাসুদের বাসায়।
ঘটনার চার দিন পর (১৪ জানুয়ারি) উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন জাহাঙ্গীরের  বাবা নবর উদ্দিন ও মাসুদের ভাই মশিউর রহমান। তবে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার রেজাউল হাসান গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জাহাঙ্গীর ও মাসুদের সন্ধানে কাজ করছি। কারা ওদের ধরেছে, সে ব্যাপারে এখনো কিছু জানা যায়নি।’ কিন্তু জাহাঙ্গীর ও মেহেদী মাসুদের নামে তাঁদের থানায় কোনো মামলা নেই বলেও নিশ্চিত করেছেন তিনি।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, মেহেদী মাসুদ ভিওআইপির অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাসুদকে র‌্যাব ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু জাহাঙ্গীরের দোষ কী, সে ব্যাপারে কেউ কোনো কথা বলছে না।
আর একই এলাকা থেকে দুজন নিখোঁজ হওয়ার খবর উত্তরায় বহুল প্রচারিত হলেও, র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এ টি এম হাবিবুর রহমান বলেছেন, ‘আমাদের কাছে এ ঘটনা সম্পর্কে কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ এলে খতিয়ে দেখা হবে।’
যেভাবে তুলে নেওয়া হলো জাহাঙ্গীরকে: মাস খানেক আগে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডের ১৮ নম্বর বাসার তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে আসবাব ওঠাতে জাহাঙ্গীর ও তাঁর বাবা নবর উদ্দিনের ভ্যান ভাড়া করেন মেহেদী। নবর উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ভাড়া বাসায় সব মালামাল ওঠানো হলেও একটি খাট বসানো হয়নি। খাটটি বসানোর জন্য ১০ জানুয়ারি বিকেলে মেহেদী মাসুদ জাহাঙ্গীরকে ফোন করেন। কিন্তু মাগরিবের নামাজের পর র‌্যাব পরিচয় দিয়ে পাঁচজন মাসুদ ও জাহাঙ্গীরকে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যায়। পাঁচজনের মধ্যে একজনের মাথার চুল বড় এবং বাকি চারজনের চুল ছোট করে কাটা। অস্ত্র না থাকলেও তাদের কয়েকজনের হাতে ওয়্যারলেস সেট ছিল। নবর উদ্দিন বলেন, ‘আমি পিছন পিছন নাইমা দেখি, মাসুদকে সাদা রঙ্গের তেলের ট্যাংকির মোটরসাইকেলে তুলা হইতেছে। আর জাহাঙ্গীরকে কালো মোটরসাইকেলে লইয়্যা যায়। জাহাঙ্গীরের কোনো দোষ থাকলে, আমারে লইলো না ক্যান?’
সরেজমিনে উত্তরার ১৩ ও ১২ নম্বর সেক্টর ঘুরে জানা গেছে, দীর্ঘ দিন ধরে জাহাঙ্গীর ও তাঁর ভাই আলমগীর হোসেনের সঙ্গে নবর উদ্দিন ভ্যান চালিয়ে আসছেন। পাশাপাশি চুক্তি ভিত্তিতে উত্তরার বিভিন্ন বাসার মালামাল পরিবহনের কাজ করেন তাঁরা।
ওই এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাইনি। এ কারণেই জাহাঙ্গীরের মা আলেমা খাতুন আমার ও পাশের কয়েকটি ফ্ল্যাটে কাজ করেন।’ জাহাঙ্গীরের স্ত্রী হেলেনা বেগমও বিভিন্ন ফ্ল্যাটে গৃহকর্মীর কাজ করে আসছেন।
উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের কয়েকজন রিকশাচালকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী,  ব্যাটারিচালিত রিকশা উচ্ছেদের সময় জাহাঙ্গীরের বড় ভাই আলমগীরকে বছর খানেক আগে আটক করে ট্রাফিক পুলিশ। তবে এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।
মেহেদী মাসুদের পরিবারের বক্তব্য: মেহেদী মাসুদের বড় ভাই মশিউর রহমানের দাবি, তাঁর ভাই বেঁচে আছেন। এ ছাড়া বিভিন্নভাবে খবর নিয়ে তাঁরা অনেকটাই নিশ্চিত মাসুদ ও জাহাঙ্গীরকে র‌্যাব হেফাজতে রাখা হয়েছে। তাঁর ধারণা, এক ব্যক্তির সঙ্গে মেহেদীর ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে সে অপহরণের ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকতে পারে। মেহেদী মাসুদ বগুড়া জেলার সোনাতলা উপজেলা যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এখন তিনি এলাকায় ঝুট ব্যবসা করেন।

Comments