ভেঙে পড়ছে বাংলাদেশ
ক্যাথরিন অ্যালেক্সিফ | ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, শনিবার, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরও নিকৃষ্ট হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাসগুলোতে রাজনৈতিক সহিংসতায় শত শত লোক নিহত হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের কারাগারে রাখা হয়েছে। অনেকে গৃহবন্দি হয়েছেন কিংবা তাদের অনেকে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করেছে। ভোটের হার কম, মাত্র ২০ শতাংশ। তাই নির্বাচনী ফলাফলকে ব্যাপকভাবে অবৈধ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ কখনোই গণতান্ত্রিক গুণাবলীর প্রতীক ছিল না। সন্দেহপূর্ণ নির্বাচন এবং চলমান সহিংসতা দেশটিকে বিপর্যয়ের কিনারে ঠেলছে। অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে হুমকিগ্রস্ত করে তুলেছে। যথেষ্ট কম মজুরি এবং কারখানাগুলোর নিরাপত্তাহীনতা ইতিমধ্যেই বিরাট সমালোচনার সম্মুখীন। সহিংসতা হ্রাস পাওয়া কিংবা স্থিতিশীলতা প্রত্যাবর্তনের কোন লক্ষণ নেই। বাংলাদেশ ২০১৪ সালে সর্পিল বাঁক নিয়ে নিচের দিকে নামতে থাকবে বলে প্রতীয়মান হয় এবং শেষ পর্যন্ত আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান কিংবা সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার দিকে এগুতে থাকবে।
চলতি পরিস্থিতির জন্য সঙ্গতভাবে দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার মধ্যকার বিরোধকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তাদের সাধারণত দুই বেগম হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা বিগত ২০ বছর ধরে বাংলাদেশকে শাসন করছেন। তারা দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে রয়েছেন এবং তারা উভয়ে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং তাদের মধ্যকার তিক্ত বিরোধ দেশটিকে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় পৌঁছে দিচ্ছে।
তাদের অতীত বিবেচনায় নিলে এটা অত্যন্ত অসম্ভব ব্যাপার যে, তারা কখনই একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাবেন। গত কয়েক মাসে একটি মধ্যপন্থা বেছে নিতে তারা বহু ধরনের সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তা গ্রহণ করতে তারা অস্বীকার করেছেন। এর পরিবর্তে পরস্পরের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি করাটাকেই বেছে নিয়েছেন। নির্বাচনের আগে তারা তাদের নিজেদের অবস্থান থেকে এক ইঞ্চি সরতে আগ্রহী ছিলেন না। সেটা তারা পারলে সহিংসতার মাধ্যমে দেশটাকে খুবলে খাওয়া থেকে বাঁচাতে সাহায্য করতে পারতেন। তাদের কার্যক্রম প্রমাণ করছে যে বাংলাদেশকে শাসন করা কিংবা সহিংসতা বন্ধ করার চেয়ে তাদের কাছে জয়লাভ করাটাই বড়।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য কয়েকটি ভাল বিকল্প রয়েছে। নির্বাচনের পর থেকে শেখ হাসিনা অস্থিতিশীলতার পথ থেকে সরে না আসা পর্যন্ত বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করতে অস্বীকার করে আসছেন। আর ‘অস্থিতিশীলতা’ বলতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ থেকে শুরু করে একটি সরাসরি সন্ত্রাসী হামলাকেও বুঝিয়ে থাকে। এটা অসম্ভব যে নিকট ভবিষ্যতে শেখ হাসিনা বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। এর কারণ তিনি যা চেয়েছিলেন, তা তিনি ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছেন। আর সেটা হলো ক্ষমতায় আরেক মেয়াদ থাকতে ভারতের কাছ থেকে অব্যাহত সমর্থন এবং অবশিষ্ট বিশ্বের কাছ থেকে ক্ষীণস্বরে নিন্দামন্দ শোনা।
কিন্তু তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের অধীনে এক দলীয় শাসন খুব শিগগিরই স্থিতিশীলতা দেবে না। বিরোধী দলের সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে এবং বিএনপি পিছু হটার কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছে না। আসলে স্থিতিশীল একদলীয় শাসন শুরু করাই সম্ভব হবে না, যতক্ষণ বিরোধী দলকে যথেষ্ট মাত্রায় দমন করা সম্ভব হয়। যতক্ষণ না তারা আর সরকারের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত না হয়। এবং বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল এখনই ভেঙে পড়ার অবস্থা থেকে অনেক দূরে।
উপরন্তু শেখ হাসিনার প্রতি যে জনপ্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিল সেটা ধূলিসাৎ হতে শুরু করেছে। গত নির্বাচনে ভোটারদের নিম্ন উপস্থিতি তারই ইঙ্গিতবহ। ২০ থেকে ৩০ ভাগ ভোটারের ভোটদান কেবল এই অর্থ বহন করে না যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেন। কিন্তু এটা ইঙ্গিত দেয় যে, তার প্রতি জনপ্রিয় সমর্থনের মেরুদণ্ডটা ক্ষুদ্র। একটি স্বৈরশাসনের নড়বড়ে ভিত্তি হচ্ছে একটি ব্যাপকভিত্তিক উদাসীন জনগোষ্ঠী এবং একটি যুদ্ধংদেহী বিরোধী দল। এ ধরনের শাসনের প্রতি দরকার অব্যাহত সামরিক এবং পুলিশি পৃষ্ঠপোষকতা। আর এটা এমন একটা বিষয় শেখ হাসিনা যার ওপরে ভরসা করতে পারেন না।
এই পটভূমিতে সামরিক বাহিনী পদক্ষেপ নিতে পারে এবং একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী সর্বশেষ ২০০৭ সালে বেসামরিক সরকার থেকে নিয়ন্ত্রণ ভার গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ তখন একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। ওই সময় বিএনপি প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচনের হোতা ছিল। এবং রাজনৈতিক সহিংসতার কারণেই সামরিক বাহিনী বেসামরিক নেতাদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল।
২০০৭ সালের মতো একটি সামরিক অভ্যুত্থান স্বল্পমেয়াদে রাজনৈতিক মতবিরোধ এবং সহিংসতা অবদমন করতে পারে। কিন্তু তারা বর্তমান সঙ্কটের মূল কারণ দূর করতে সক্ষম হবে না। চলতি সঙ্কটের মূলে রয়েছে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার মধ্যকার বৈরিতা। একইসঙ্গে তাদের উভয়ের মানসিকতা হচ্ছে নির্বাচনী বিজয়ের অর্থ হচ্ছে বিজয়ী পক্ষ পরাজিতদের বিচার করবে। ৬ বছর আগে দেশটি যেভাবে বিভক্ত ছিল, তার চেয়ে বেশি না হলেও ঠিক তেমনটিই রয়ে গেছে। নিকৃষ্ট দৃশ্যপট হচ্ছে বাংলাদেশ গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়তেই থাকবে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির অগ্রগতিকে চলমান সিরীয় গৃহযুদ্ধের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। সেখানে একটি পূর্ণাঙ্গ গৃহযুদ্ধ গতিলাভ করার আগে প্রতিবাদ রূপান্তরিত হয়েছে সশস্ত্র বিরোধিতায়। এরপর উত্থান ঘটেছে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর।
বাংলাদেশ বর্তমানে প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের মধ্যবর্তী অবস্থানে রয়েছে। সরকার চলমান প্রতিবাদের ওপর দমনপীড়ন চালাচ্ছে। কিন্তু বিরোধী দল এখনও পর্যন্ত কতটা জঙ্গিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে তা অস্পষ্ট। বিরোধী দলগুলোর অন্যতম প্রধান হচ্ছে জামায়াত ইসলামী। ইসলামি এই দলটি হিন্দু সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেছে। তাদের হামলা এখনও পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে না। কিন্তু তেমন একটি রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের হিন্দুরা প্রধানত ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে থাকে।
এসব হামলা থেকে আরও পরিষ্কার যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ভঙ্গুর নিরাপত্তার মূলে রয়েছে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাশূন্যতা। গৃহযুদ্ধ সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যকার একটি সাধারণ সংঘাত হিসেবে দেখাটা বিরল। এ রকম অবস্থায় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বেড়ে যায়। কারণ, তাদের সুরক্ষা প্রদানের ক্ষমতা যাদের হাতে, তা এতটাই ঠুনকো যে তা তাদের কাজে লাগে না।
দুটি মন্দ বিকল্প
বর্তমান ডামাডোলের মধ্যে ক্ষমতা শেখ হাসিনার করায়ত্ব থাকাটা বেশি দিন স্থায়ী নাও হতে পারে। যদি বিরোধী দলের প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে তাহলে দেশটির সামনে দুটি খারাপ বিকল্প আসবে। একটি হলো সামরিক অভ্যুত্থান, যার ফলে রাজনৈতিক উত্তেজনা সাময়িক অবদমিত হবে কিন্তু তার কোন সমাধান হবে না। খালেদা-হাসিনার দ্বন্দ্বের চেয়েও বাংলাদেশের মতাদর্শগত বিরোধিতার জায়গাটি আরও প্রকট ও গভীরে রয়ে যেতে পারে। কারণ বিএনপি বাংলাদেশকে প্রাথমিকভাবে একটি ইসলামি জাতি হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতিসত্ত্বার ভিত্তিতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র আকাঙক্ষা করে থাকে। সুতরাং একটি সামরিক অভ্যুত্থান এই উত্তেজনার যেহেতু সমাধান দেয়া শুরু করতে পারবে না, তাই বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলেও মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে আবারও দেশটি একই ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে।
অন্য বিকল্প হচ্ছে গৃহযুদ্ধ। সেটা ভয়ঙ্কর মূল্যে আসবে। এর সম্ভাবনার মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু। ভারতে ব্যাপক ভিত্তি উদ্বাস্তু স্রোত এবং বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নির্মূল অভিযান। দেশটি এসবের মধ্যে যে কোনটির দিকেই যাত্রা শুরু করুক না কেন, ২০১৪ সালটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত খারাপ বছর হিসেবেই গণ্য হতে পারে।
সূত্র: মার্কিন সাময়িকী ‘ফরেন পলিসি’ (৩০ জানুয়ারি, ২০১৪)। ক্যাথরিন অ্যালেক্সিফ: জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিরাপত্তা বিষয়ে ’স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন। মিস ক্যাথরিন আটলান্টিক কাউন্সিলের দক্ষিণ এশীয় সেন্টারে কর্মরত।
Comments
Post a Comment