বিএনপির সামনে বহু চ্যালেঞ্জ

মূল সমস্যা কেন্দ্রে, নজর তৃণমূলে; আন্দোলনে ‘দুর্বল’ ঢাকা মহানগর; 
মঈন উদ্দিন খান
১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, শনিবার,সৌজন্যে নয়াদিগন্ত 
৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনের পর দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি সরকারেও নেই, নেই বিরোধী দলেও। তিন মাসের টানা আন্দোলনে সারা দেশে দলটির তিন লক্ষাধিক নেতাকর্মী এখন মামলার জালে। কারাবন্দী অসংখ্য, অনেকেই ঘরবাড়ি ছাড়া। নির্বাচনের পর বিভিন্ন স্থানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একের পর এক নেতাকর্মী নিহত হওয়ায় দলটির তৃণমূলে দেখা দিয়েছে নতুন করে আতঙ্ক। অন্য দিকে বিএনপির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলন ‘শক্ত’ হাতে মোকাবেলা করেই আবারো সরকার গঠন করেছে। দিনকে দিন তারা অবস্থান শক্ত করে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিএনপির আগামী দিনের ‘কর্মপন্থা’ কী হবে, দ্রুত নির্বাচনের দাবি আদায়ে আন্দোলন কোন পথে এগোবে এবং নির্দেশনাহীন তৃণমূলকে আস্থায় এনে সংগঠনকে কিভাবে গোছানো হবে, তা ঠিক করাই দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মূল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে। 
রাজনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত পাঁচ বছরে মাঠপর্যায়ের আন্দোলনের ‘দাবানল’ কেন্দ্রে এসে নিভে যাওয়ার কারণে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারেনি বিএনপি। ফলে চূড়ান্তভাবে সফলও হতে পারেনি তারা। 
নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর এক মাস পার হতে চলল। জানা গেছে, দলের তৃণমূল এখনো নির্দেশনাহীন। কেন্দ্রের আগামী দিনের ভাবনা সম্পর্কে কোনো বার্তা এখনো তাদের কাছে পৌঁছেনি। নির্বাচনের পর কেন্দ্র থেকে আবারো তৃণমূল ‘চাঙ্গা’ করার যে উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে, তাতে স্থানীয় নেতারা হতাশা ও ুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। মূল সমস্যা কেন্দ্রে রেখে শুধু তৃণমূলের দিকে নজর দেয়া কার্যকর ফল বয়ে আনবে না বলে তারা মনে করছেন। চট্টগ্রাম বিএনপির এক নেতা নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘নির্বাচনের পর নেতাকর্মীদের ভূমিকা কী হবে, তা আমরা কিছুই জানি না। হাইকমান্ড কী করতে চায়, তা স্পষ্ট নয়। দিনকে দিন তারা মনোবল হারিয়ে ফেলছেন।’
দীর্ঘ আন্দোলন সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ আবারো সরকার গঠন করায় মাঠের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা চলে এসেছে। একই সাথে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি হঠাৎ করে স্থগিত করায় তৃণমূলের সাংগঠনিক গতি কমে গেছে। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সরকারের বিরুদ্ধে ফের আন্দোলন বেগবান ও মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে বিএনপি চেয়ারপারসন নিজেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জেলা সফর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সারা দেশে বৃহত্তর ১৯টি জেলায় সফরের প্রস্তুতি নিতে সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে। প্রথম দিকে সাতক্ষীরা, যশোর, ময়মনসিংহ, রাজবাড়ী, ঠাকুরগাঁও এবং নাটোরে যাওয়ার বিষয়টিও প্রায় চূড়ান্ত। 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তৃণমূলকে চাঙ্গা করতে উদ্যোগ নিলেও কেন্দ্রীয় বিএনপিকে চাঙ্গা করতে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিএনপি। কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে আছেন এখনো আত্মগোপনে। আর অনেকে আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে এলেও চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে হাজিরা দেয়ার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। আর ঢাকা জেলা ও ঢাকা মহানগর বিএনপির কোনো কার্যক্রম নেই বললেই চলে। 
ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা এখন আছেন কারাগারে। আর সদস্যসচিব আব্দুস সালামসহ অন্য যুগ্ম আহবায়কেরা এখনো দলীয় কার্যক্রমে পুরোপুরি সক্রিয় হতে পারেননি। বিএনপির তৃণমূল নেতারা মনে করেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা মহানগর পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। মহানগরের দায়িত্বে থাকা নেতারা নিজেদেরকে ‘সুবিধাজনক’ অবস্থায় রেখে দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে তাদের সাথে নেতাকর্মীদের যোগাযোগ ছিল বিচ্ছিন্ন। আত্মগোপন অবস্থায় থেকে তারা দলকে সঠিক নির্দেশনাও দিতে পারেননি। কেউ কেউ মনে করছেন, মহানগর কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না করাই ‘কাল’ হয়েছে। আন্দোলন চাঙ্গা করতে ঢাকাকে ৮ ভাগে ভাগ করার বিষয়টিও ছিল মহানগরের মূল নেতাদের দায়িত্ব এড়ানোর কৌশলমাত্র। 
জানা গেছে, ঢাকা মহানগর বিএনপির ‘প্রভাবশালী’ একটি অংশ এখনো বর্তমান নেতৃত্বকে মেনে নিতে পারছে না। যার কারণে আন্দোলনের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ‘ক্রেডিট’ অন্যরা পাবেÑ এই বিবেচনায় তারা মাঠে নামেনি। 
নির্বাচনের পর গত ২০ জানুয়ারি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির প্রথম গণসমাবেশ আয়োজনের দায়িত্বও দেয়া হয়নি ঢাকা মহানগর ইউনিটকে। সদস্যসচিবসহ তিন যুগ্ম আহবায়ক গণসমাবেশে থাকলেও তারা ছিলেন এক রকম দর্শকের ভূমিকায়। 
মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব আব্দুস সালাম নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে বলেন, ঢাকা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। সরকার এটা ভালোভাবে জানে বলেই, হাজার হাজার র‌্যাব-পুলিশ দিয়ে দমন-পীড়ন চালিয়ে ঢাকা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। বিএনপি কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। নেতাকর্মীদের দেখামাত্রই গুলির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ রকম একটি অবস্থায় মাঠে নামতে হলে অস্ত্র নিয়েই নামতে হয়। কিন্তু বিএনপি তো লড়াই করার দল নয়, গণতান্ত্রিক দল। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বিরোধী দলের ডাকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে পরাজয় মনে হলেও পরাজয় নয়। 
নেতাদের আত্মগোপন নিয়ে তিনি বলেন, যেখানে দেখামাত্রই গুলির নির্দেশ, সেখানে বহু মামলা নিয়ে নেতারা কিভাবে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াবেন। আত্মাগোপনে থাকলেও নেতাকর্মীরা ‘নির্দেশনাহীন’ ছিল না বলে মনে করেন তিনি। 
গত পাঁচ বছরের তৃণমূল ও কেন্দ্রের কার্যক্রম তুলনা করলে দেখা যায়Ñ গুলি, মামলা-হামলা, ঘরবাড়িতে আগুন, গ্রেফতারসহ পুলিশি ও সরকারদলীয় লোকজনদের হাতে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হতে হবে, এসব জেনেই দাবানলের মতো জ্বলে উঠেছিল দলের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা। কিন্তু সেই আন্দোলনের দাবানল কেন্দীয় পর্যায়ে এসে নিভে যায়। গুম, অপহরণ, হত্যা, হামলা-ভাঙচুর, মামলা- গ্রেফতারসহ নজিরবিহীন নির্যাতনের মধ্যেও হরতাল অবরোধসহ বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচি জীবন দিয়ে সফল করার চেষ্টা করেছে তৃণমূল কর্মীরা। অন্য দিকে কেন্দ্রীয় কিছু নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেÑ বিএনপির রাজনীতি করলেও ভেতরের কাজে-কর্মে তারা সরকারের। রাজনৈতিক আদর্শ এক সময় তাদের কাছে মুখ্য থাকলেও নামে-বেনামে গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড় রক্ষায় ‘ত্যাগ’ স্বীকারে আগ্রহ দেখায়নি তারা। গুরুত্বপূর্ণ পদ বহন করা অনেক নেতার বিরুদ্ধে মামলাও হয়নি, তারা ছিলেন সরকারের নেক নজরে। অনেকে ব্যবসায় করছেন সরকারদলীয় নেতাদের সাথে যৌথভাবে। 
এত কিছুর পরও চূড়ান্ত আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’র ডাক দেন বিএনপি প্রধান। জানা গেছে, অনুমতির তোয়াক্কা না করে তিনি সবাইকে নয়াপল্টনে যাওয়ার নির্দেশ দিলে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঠিকই ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনা না পাওয়ায় তারা নয়াপল্টনে যেতে পারেননি। 
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্বাচনের পর বিএনপির তণমূলকে চাঙ্গা করতে বিএনপি চেয়ারপারসনের নতুন উদ্যোগে সন্তুষ্ট নন মাঠপর্যায়ের কর্মীরা। তাদের ক্ষোভের জায়গাটি হচ্ছেÑ আগে তৃণমূল কেন? আগে কেন্দ্র ঠিক করে এরপর সুসংগঠিত তৃণমূলকে আরো শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়া উচিত দলের হাইকমান্ডের। কিন্তু তা না করে কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শে তৃণমূলের দিকে দৃষ্টি দিয়ে আবারো কেন্দ্রের জন্য বিএনপিকে বেকায়দায় পড়তে হবে বলে তাদের ধারণা। অনেক তৃণমূল নেতার মতে, কেন্দ্র পুনর্গঠনের একটি প্রাথমিক ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়ে এরপর জেলা সফরে আসা উচিত খালেদা জিয়ার। 
তৃণমূলপর্যায়ের নেতারা জানান, রোডমার্চসহ বিভিন্ন কর্মসূচি অনেক জেলা ও বিভাগীয় শহরে হয়েছে। ওইসব কর্মসূচিতে ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তৃণমূল নেতাকর্মীরা সফল করেছেন। তারা বলছেন, বিগত সময়ের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনই কেন্দ্রীয় ইউনিটগুলো পুনর্গঠন আর কাউন্সিল করে ‘অকেজো’ জাতীয় কেন্দ্রীয় নেতাদের বাদ দেয়া উচিত। তারা আরো বলছেন, গত কয়েক মাসে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চালের পাল্টা চাল দিতেও বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। 
বিএনপির এক সিনিয়র নেতা জানান, দুই-তিন মাসের মধ্যে কাউন্সিল করার চেষ্টা চলছে। সেখান থেকেই কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠিত হবে। আন্দোলন সফলে ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না কেন্দ্রীয় নেতারা এটা ঠিক। এর পরও আপাতত তৃণমূল থেকেই পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
৫ জানুয়ারি বিরোধী দলবিহীন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও আত্মবিশ্লেষণের জন্য এখন পর্যন্ত বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটি বা দলীয় অন্য কোনো ফোরামের বৈঠক ডাকা হয়নি। আলোচনা হয়নি কিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে চায় বিএনপি। তৃণমূলেও যায়নি কোনো নির্দেশনা। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন পেশাজীবী নেতাদের সাথে ইতোমধ্যে মতবিনিময় শুরু করেছেন। সিনিয়র নেতারা অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় কেউ কেউ বলছেন, কাউন্সিলের মাধ্যমে দল পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা। কারো মতে, জামায়াত ও হেফাজতের সঙ্গ ছাড়তে হবে। কেউ বা আবার ‘সঙ্গ ছাড়া’র এই চাপকে বিএনপির জন্য আরেকটি ‘ফাঁদ’ বলে মনে করছে। তাদের মতে, বৃহৎ দু-একটি শক্তির ইন্ধনে মতাসীন মহল মূলত বিএনপিকে ধ্বংস করতে চায়। এরই কৌশল হিসেবে এবার বিএনপিকে একঘরে করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি এই দু’টি দলের সাথে বিএনপি যোগাযোগ কিছুটা কমিয়ে এনেছে । যদিও উভয়ের তরফ থেকে এটা কৌশলগত অবস্থান বলে জানানো হয়েছে। 
জানা গেছে, আন্দোলনের পথে দলকে ফের এক মেরুতে আনার ‘চ্যালেঞ্জ’ নিয়েই আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং বর্তমান করণীয় নিয়ে নতুন করে অনেক কিছু ভাবতে শুরু করেছেন দলটির সিনিয়র নেতারা। দলকে ঢেলে সাজাতে বেশকিছু সংস্কার দরকার বলেও মনে করছেন তারা। দলের মহাসচিব পদসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে শতভাগ রাজনীতিক নেতার দাবি উঠেছে দলে। আন্দোলনের মাঠে নিষ্ক্রিয় নেতাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন কেউ কেউ।

Comments