ভারতের করপোরেটগুলোতে মুসলমানদের জায়গা নেই
|
প্রফেসর মুশিরুল হাসান ভারতের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ। তার বাবা মুহিবুল
হাসানও ছিলেন খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ। জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৫ আগস্ট। আলিগড় মুসলিম
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ করেন ১৯৬৯ সালে। পরে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে
পিএইচডি করেন। কর্মজীবনে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। ছিলেন দিল্লির
বিশ্ববিদ্যালয় জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়ার ভাইস চ্যান্সেলর। ২০১০ সালে
ন্যাশনাল আরকাইভস অব ইন্ডিয়ার মহাপরিচালক করা হয় তাকে। তিনি পদ্মশ্রী। ভারত
বিভাগ নিয়ে মুশিরুল হাসানের কাজ উল্লেখ করার মতো। সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে তার
লেখা রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ভারতের প্রখ্যাত এই ইতিহাসবিদ প্রফেসর মুশিরুল হাসান ভারতে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন। সম্প্রতি সেখানকার এক দৈনিকের সঙ্গে দেয়া সাক্ষাত্কারে এ অভিযোগ করে বলেন, কলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত বড় বড় এলাকার দিকে একবার তাকান। এভাবে কি মানুষ বাস করতে পারে? পৃথিবীর কোথাও করে? তাদের জন্য আজ পর্যন্ত কোনো সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত করা হয়েছে? মোটেই হয়নি। কারণ তারা মুসলমান এবং গরিব মুসলমান। বাস্তব এটাই যে, মুসলমান এলাকায় নাগরিক সেবা প্রায় নেই বললেই চলে। একই শ্রেণীর
মুসলমান ও হিন্দুরা যেভাবে বসবাস করেন তার মধ্যে তুলনা করুন—তা হলেই পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন। বহু শহরেই এটা আমি দেখেছি, এ নিয়ে আমি পড়াশোনা করেছি, লিখেওছি। তবে কলকাতা নিয়ে এ ধরনের কথা আগে বলিনি।
এ দেশের করপোরেট দুনিয়া বরাবরই প্রতিক্রিয়াশীল ও অত্যন্ত গোঁড়া এবং বলতেই পারি তারা অত্যন্ত মুসলমানবিরোধী। বড় করপোরেটগুলোতে মুসলমানদের সংখ্যা দেখুন। প্রায় নেই বললেই চলে। কাজেই করপোরেট সেক্টর মোদিকে বেশ পছন্দ করে। সংবাদমাধ্যমও সেটাই করছে। অনেক কিছু ঘটছে তার কারণ, সংবাদমাধ্যমের ওপর করপোরেট দুনিয়ার ব্যাপক প্রভাব। কাজেই যে মূল কথাটা আমি বলতে চাই তা হলো, সংবাদমাধ্যম আর করপোরেট সেক্টরের একটা গাঁটছড়া, যেটা গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে এই দুইয়ের মতাদর্শগত অবস্থানের একটা মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, এ দেশের করপোরেট দুনিয়া বরাবরই প্রতিক্রিয়াশীল এবং অত্যন্ত গোঁড়া। বলতেই পারি তারা অত্যন্ত মুসলমানবিরোধী। বড় করপোরেটগুলোতে মুসলমানদের সংখ্যা দেখুন। প্রায় নেই বললেই চলে।
ভারতের আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী যাকে ভাবা হচ্ছে, বিজেপির সেই নেতা নরেন্দ্র মোদিকে তিনি আধা ফ্যাসিস্ট হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসার পর নরেন্দ্র মোদি যেসব বক্তব্য রেখেছেন, আমার এই ধারণাকে আরও বদ্ধমূল করেছে। আপনি যদি তার বক্তব্য, তার কাজের ধরন, তার দম্ভ, ভারতীয় সংবিধানে উল্লিখিত মূল্যবোধগুলো তার অস্বীকার করার প্রবণতা ভালো করে দেখেন, সেগুলো পর্যালোচনা করেন, তা হলেই বুঝতে পারবেন তার মতাদর্শগত চিন্তার মধ্যে একটা আধা ফ্যাসিবাদ রয়েছে।
ভারতের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা, মুসলমান সমাজের সমস্যা, বামপন্থার ব্যর্থতা ইত্যাদি নিয়ে তার একটি সাক্ষাত্কার গতকাল প্রকাশিত হয়েছে ভারতের একটি দৈনিকে। প্রফেসর মুশিরুল হাসানের সাক্ষাত্কারটি এখানে তুলে ধরা হলো :
প্রশ্ন : আমরা কি বলতে পারি ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ও রাজনীতি সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নটির মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সেটাই এই উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর সামনে একটা বড় বিপদ?
মুশিরুল হাসান : আমি আপনার সঙ্গে একমত নই। আমি মনে করি, ভারতের সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা মোটামুটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ। নরেন্দ্র মোদি ও দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদীদের উত্থান সত্ত্বেও আমি এটাই মনে করি। দেখুন ভারত বিশাল দেশ। তা ছাড়া এ মুহূর্তে এ দেশের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটছে। তার ওপর ভিত্তি করে কোনো সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হবে না। আমার মনে হয়, ২০১৪-র (লোকসভা) নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
প্রশ্ন : কিন্তু বাংলাদেশ যদি দেখি, সেখানে কিছু মানুষের ফাঁসির দাবিকে কেন্দ্র করে মূলত একটা শহুরে আন্দোলন তৈরি হয়েছে এবং যার প্রতিক্রিয়ায় গ্রামে ও মফস্বলে ইসলামি মৌলবাদীদের শক্তি একাট্টা হচ্ছে। হিন্দু-বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা হচ্ছে। পাকিস্তানে উগ্র ইসলামি শক্তির সমর্থন পেয়েছে নওয়াজ শরীফ সরকার। ভারতে নরেন্দ্র মোদি বিজেপির হাল ধরেছেন। সব মিলিয়ে আমরা কি একটা উদ্বেগজনক সাম্প্রদায়িক ভবিষ্যতের দিকে চলেছি?
মুশিরুল হাসান : এই যে ক’টি প্রবণতার উল্লেখ আপনি করলেন, তার সবক’টিই নিশ্চিতভাবে অশুভ। দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদ, দক্ষিণপন্থী ইসলামি শক্তি বা শ্রীলঙ্কায় দক্ষিণপন্থী বৌদ্ধদের উত্থান—এ সবই অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু দেখুন, আমাদের এসব সমাজে সরকার পরিচালনার গুণগত মান উন্নত না হলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। বিগত পঞ্চাশ-ষাট বছরের সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতাকেই আমি এসব সমস্যার মূল হিসেবে দেখি। এবং এই ব্যর্থতার অঙ্গ অবশ্যই এসব সমাজে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য। দরিদ্রের অবস্থার একেবারেই উন্নতি হয়নি। আর তা যখন হয় না, তখন তাদের হতাশা এসব প্রবণতার রূপ নিয়ে প্রকাশ পায়।
প্রশ্ন : আপনি এই প্রবণতাগুলোকে মানুষের দারিদ্র্যের সঙ্গে যুক্ত করছেন?
মুশিরুল হাসান : এবং তার সঙ্গে সরকারি ব্যর্থতা।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনার কি মনে হয় না এর ফলে বামপন্থী শক্তিগুলোর একটা সার্বিক উত্থান হওয়া উচিত ছিল? কিন্তু আমরা বামপন্থীদের পশ্চাত্পসরণ দেখেছি।
মুশিরুল হাসান : সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। আমি দুটি বিষয়কে জুড়তে চাইছি। প্রথমত, এই সরকার পরিচালনার ব্যর্থতা ও অধিকাংশ মানুষের দুর্দশা সত্ত্বেও মূলধারার বামপন্থীরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন এবং তার ফলেই উগ্র বামপন্থার উত্থান।
প্রশ্ন : আপনার কী মত?
মুশিরুল হাসান : আমি মনে করি তারা (মূলধারার বামেরা) বেশ কিছু ভুল করেছেন। সে কথা তারা স্বীকারও করেছেন। এর মধ্যে কৌশলগত ভুল আছে। এর মধ্যে আছে ভ্রান্ত ধারণা, যার ওপর ভিত্তি করে তারা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভারতীয় বামপন্থীদের ক্ষেত্রে আমি বলব, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যাকে বলা যায় বামপন্থী বিশ্ব কাঠামোর পতন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে বামপন্থা হয়তো জোরদারভাবে বেঁচে থাকত, যদি একটা আন্তর্জাতিক বামপন্থী আন্দোলন জীবিত থাকত।
প্রশ্ন : দক্ষিণ আমেরিকায় তো আছে।
মুশিরুল হাসান : হ্যাঁ, ওখানে বামপন্থার পুনরুত্থান ঘটেছে। তবে আমি মনে করি, ভারতে বামপন্থার ভাগ্য অন্য অনেক দলের সঙ্গে বা সমাজের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। লাতিন আমেরিকায় কিন্তু (বামপন্থীদের সঙ্গে অন্য দলের) প্রতিযোগিতার জায়গাটা বিশেষ ছিল না। তা ছাড়া সেখানে বামপন্থার উত্থানের একটা কারণ অবশ্যই মার্কিন নীতি।
প্রশ্ন : আপনি বলছেন দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের প্রধান কারণ সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে সরকারের ব্যর্থতা এবং গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির বিভিন্ন তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। যেমন?
মুশিরুল হাসান : ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোও বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক শক্তির নানা দাবির মুখে কিছু কিছু বিষয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। এমনকি বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে তারা আলাপ-আলোচনাও চালিয়েছে। যাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি বলা যেতে পারে, তাদের সঙ্গেও তারা (ধর্মনিরপেক্ষ দলেরা) যোগাযোগ রেখেছে। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করেছে তাদের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসা প্রয়োজন।
প্রশ্ন : সেটা কি তাহলে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতার ইঙ্গিতবাহী?
মুশিরুল হাসান : না। তা আমি বলব না। এর অন্য অনেক জোরের জায়গা আছে। সার্বিকভাবে এই সমাজ অসাম্প্রদায়িক, যদি ধর্মনিরপেক্ষ নাও হয়।
প্রশ্ন : একটা বিষয়ের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করি—ফতোয়া। আমার মনে পড়ছে, ধরুন মহান আমির খুসরুর সেই লাইন : আমি প্রেমের কাফের, মুসলমানিতে আমার কোনো কাজ নেই। বা কবিদের কবি বলে পরিচিত মীর তকি মীর-এর সেই পঙিক্তর কথা : মন্দিরের দুয়ারে বসে তিলক কেটেছি, কবেই তো ছেড়েছি ইসলাম। তাদের বিরুদ্ধে, তাদের শুধরে দিতে ফতোয়া জারি হয়েছে এমন তো কখনও শুনিনি। ফতোয়ার ব্যাপারটা আসলে কী?
মুশিরুল হাসান : প্রথম কথা এসব (ফতোয়ার খবর) এখন অনেক বেশি প্রকাশিত হচ্ছে। এবং সেসব খুব বাড়িয়ে বাড়িয়ে লেখা হয়। কে যে কী জারি করছে কার হয়ে, আমরা জানতে পারি না। মুসলমানদের সমালোচনা করার একটা অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ফতোয়া। আমি বলছি না ফতোয়া দেয়া হয় না। এর মধ্যে কিছু কিছু ফতোয়া জারি করা যে উচিত হয়নি তা-ও নয়। কিন্তু আমি মনে করি এই বিষয়টাকে মুসলমানদের সমালোচনা করার জন্য, তাদের খারাপভাবে দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। আমাদের সমাজে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা আরএসএসের মতো সংগঠনও আছে। তারা কী প্রচার করেন এবং কার্যক্ষেত্রে কী করেন তা খেয়াল করুন। কিন্তু ফতোয়ার মতো এমন কোনো বিভাগ নেই যা এক কথায় তাদের মৌলবাদ, তাদের গোঁড়ামি প্রকাশ করতে পারে। আছে কি? (হাসতে হাসতে) সে রকম একটা কিছু তৈরি করতে পারলে বেশ হয়। আমার মনে হয়, প্রত্যেক সমাজেই আধ ডজন খানেক পাগল থাকে। এই ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে কিছু ছিটগ্রস্ত মানুষ আছেন, যারা ফতোয়ার কার্যকারিতায় বিশ্বাস করেন। আমি মনে করি না এদের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। এবং গোটা (মুসলমান) সম্প্রদায়কে এই দিয়ে বিচার করা উচিত নয়।
প্রশ্ন : মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এর গুরুত্ব কতটা?
মুশিরুল হাসান : আমার মনে হয় না খুব একটা গুরুত্ব আছে। দেখুন, মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে এভাবে বাঁচে না। ভারতীয় সংবিধানের সব ধারা কি কেউ তার প্রাত্যহিক জীবনে মেনে চলেন? চলেন না। কিছু মানুষ কোনো স্থানীয় মোল্লার ফতোয়া মেনে চলতে পারেন। কিন্তু বাগদাদ বা কায়রোতে জারি করা ফতোয়ার (এখানে) অধিকাংশ মানুষের কাছে কোনো মানেই হয় না। একেবারে ধর্মীয় বিষয়ে (ফতোয়া) হলে হয়তো কিছুটা মানে আছে। আবার এটাও ঠিক যে, মুসলমান সমাজ বিভিন্ন স্তরে এত বিভক্ত, যেমন আপনি যদি শিয়া হন, আল আজহারের ফতোয়ার কোনো মানেই নেই। আপনি যদি হানাফি হন, তাহলে কোম-এর ফতোয়ার কোনো মানেই নেই। বরেলভিরা আলাদা। দেওবন্দিরা আলাদা। এই সূক্ষ্ম বিষয়গুলো ভুললে চলবে না।
প্রশ্ন : এ প্রসঙ্গে বলি, সালমান রুশদি নিজেই বলেছেন যে তাকে গত বছর এখানে বইমেলায় আসতে দেয়া হয়নি। এবং তার পরেই অনেকে এখানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে মুসলমান তোষণের অভিযোগ তুলেছেন...
মুশিরুল হাসান : ঠিক সেই কথাই তো আমি বলছিলাম। মুসলমান সম্প্রদায় সম্পর্কে এবং তাদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে রাজনৈতিক নেতাদের কিছু কিছু ধারণা আছে। এই ধারণাগুলোকে এবার আমাদের চ্যালেঞ্জ করা দরকার। কারণ ধারণাগুলো ভ্রান্ত। আপনি মনে করেন সালমান রুশদি ভারতে এলে মুসলমানরা অপ্রসন্ন হবেন। চেষ্টা করে দেখুন। তাকে আসতে দিন। ঝুঁকিটা নিন। হয়তো দেখবেন কিছুই হয়নি। দশজন বা কুড়িজন বা একশ’জনও বিক্ষোভ দেখালে, সেটাতে রাজনীতিকরা অভ্যস্ত। কিন্তু এ থেকে অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হন, সেটা ভুল।
প্রশ্ন : মুসলমানদের প্রতি কি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়?
মুশিরুল হাসান : অবশ্যই করা হয়। কলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত বড় এলাকাগুলোর দিকে একবার তাকান। এভাবে কি মানুষ বাস করতে পারে? পৃথিবীর কোথাও করে? তাদের জন্য আজ পর্যন্ত কোনো সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত করা হয়েছে? মোটেই হয়নি। কারণ তারা মুসলমান এবং গরিব মুসলমান। বাস্তব এটাই যে, মুসলমান এলাকায় নাগরিক সেবা প্রায় নেই বললেই চলে। একই শ্রেণীর মুসলমান ও হিন্দুরা যেভাবে বসবাস করেন, তার মধ্যে তুলনা করুন—তা হলেই পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন। বহু শহরেই এটা আমি দেখেছি, এ নিয়ে আমি পড়াশোনা করেছি, লিখেওছি। তবে কলকাতা নিয়ে এ ধরনের কথা আগে বলিনি।
প্রশ্ন : পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইমামদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করেছেন। সরকারের এই সিদ্ধান্তে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
মুশিরুল হাসান : এসব রাজনৈতিক সুবিধাবাদী পদক্ষেপ। এতে মুসলমান সম্প্রদায়ের কোনো উপকার হবে না। শুধু ইমামদের জন্য ভাতা কেন? মুসলমান মহিলাদের জন্য নয় কেন? রাষ্ট্রের কাছ থেকে তাদের তো অনেক বেশি সাহায্য দরকার। যদি সত্যি কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়, তা হলে তা দেয়া উচিত মুসলমান মেয়েদের। তাদের শিক্ষার জন্য। সে কাজটা করুন। ইমামদের ভাতা দেয়া মুসলমান সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়ার সমস্যার কোনো সমাধান হতে পারে না।
প্রশ্ন : গুজরাটে নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক সাফল্য এবং তার ভিত্তিতেই জাতীয় স্তরে তার উত্থান। এ বিষয়টিকে আপনি কী চোখে দেখছেন?
মুশিরুল হাসান : দেখুন, এ দেশের করপোরেট দুনিয়া বরাবরই প্রতিক্রিয়াশীল ও অত্যন্ত গোঁড়া এবং বলতেই পারি তারা অত্যন্ত মুসলমানবিরোধী। বড় করপোরেটগুলোতে মুসলমানদের সংখ্যা দেখুন, প্রায় নেই বললেই চলে। কাজেই করপোরেট সেক্টর মোদিকে বেশ পছন্দ করে। সংবাদমাধ্যমও সেটাই করছে। অনেক কিছু ঘটছে তার কারণ, সংবাদমাধ্যমের ওপর করপোরেট দুনিয়ার ব্যাপক প্রভাব। কাজেই যে মূল কথাটা আমি বলতে চাই তা হলো, সংবাদমাধ্যম আর করপোরেট সেক্টরের একটা গাঁটছড়া, যেটা গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে, এই দুইয়ের মতাদর্শগত অবস্থানের একটা মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে।
প্রশ্ন : আপনার মতে, নরেন্দ্র মোদির মতাদর্শগত অবস্থানটা কী?
মুশিরুল হাসান : আমি নরেন্দ্র মোদিকে আধা ফ্যাসিস্ট মনে করি। বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসার পর নরেন্দ্র মোদি যেসব বক্তব্য রেখেছেন, আমার এই ধারণাকে আরও বদ্ধমূল করেছে। আপনি যদি তার বক্তব্য, তার কাজের ধরন, তার দম্ভ, ভারতীয় সংবিধানে উল্লিখিত মূল্যবোধগুলো অস্বীকার করার তার প্রবণতা ভালো করে দেখেন, সেগুলো পর্যালোচনা করেন, তা হলেই বুঝতে পারবেন তার মতাদর্শগত চিন্তার মধ্যে একটা আধা ফ্যাসিবাদ রয়েছে। কাজেই আমি তার কাছ থেকে খুব একটা সঙ্গতিপূর্ণ কোনো বিশ্ববীক্ষণ আশাও করি না। দেখুন ইউরোপে কী হচ্ছে, উগ্র দক্ষিণপন্থা ফিরে আসছে। সেই প্রবণতা এদেশেও দেখা যাচ্ছে। আমি আশা করি, মানুষ এই বিভেদমূলক রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করবেন। আশা করি, ‘মোদি ফেনোমেনা’ বলে যেটা চালানো হচ্ছে তা প্রত্যাখ্যান করার মতো শক্তি ও দায়বদ্ধতা রাজনৈতিক দলগুলোরও রয়েছে। আমি মনে করি, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সমাজে সংবাদমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময় সংবাদমাধ্যম সমাজের মধ্যে ঐক্য স্থাপনে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এখন তা ক্রমাগত বিভেদ সৃষ্টি করার কাজে নিয়োজিত হচ্ছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ক্ষতিসাধন করছে। আপনি যদি সংবাদমাধ্যমের অতীত ও বর্তমান ভূমিকা তুলনা করে দেখেন, তা হলেই পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন।
প্রশ্ন : রাজনৈতিক প্রসঙ্গে আসি, একদিকে ইউপিএ সরকার, যার বিরুদ্ধে সরকারি ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার অভিযোগ; অন্যদিকে বিজেপি যার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ। আর একদিকে বেশকিছু ছোট ছোট রাজনৈতিক দল, যাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই চরম দুর্নীতির অভিযোগ। ভারতীয় ভোটারদের সামনে বিকল্পটা কী?
মুশিরুল হাসান : যা-ই বলুন না কেন, স্থানীয় দলগুলোর নেতারা নিজের নিজের এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। জাত-পাত ও স্থানীয় রাজনীতির ওপর ভিত্তি করা একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিকল্প কী হতে পারে, সেটা আপনি বা আমি ঠিক করব না। সে বিকল্প খুব সোজাসাপটাও হবে না। এই জোট রাজনীতির যুগে বিকল্পের মধ্যে বৈচিত্র্য প্রতিফলিত হতে বাধ্য। দেখুন নীতিশ কুমারের সরকারের সঙ্গে কিন্তু বিজেপির বহু দিন একটা জোট ছিল। মুসলমানরা সেটাকে খুব একটা খারাপ চোখে নেয়নি। আশা করি, নির্বাচন এবার মোদির সব আশা চিরকালের মতো শেষ করে দেবে।
প্রশ্ন : মূলধারার বামপন্থীদের অবস্থা খারাপ কিন্তু আমরা দেখছি রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের একটা বড় জায়গাজুড়ে মাওবাদী উগ্র বামপন্থীরা নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে। আপনার প্রতিক্রিয়া?
মুশিরুল হাসান : দেখুন, এ সবই বৈষম্যজনিত ক্ষোভের প্রকাশ। রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা কোনো কাজের কথা নয়। রাষ্ট্র একটা বাস্তব। সেই বাস্তবকে মেনে নিতে শিখতে হবে। রাষ্ট্রের সঙ্গে দরাদরি করতে হবে। নিজেদের অনুগামীদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলার এর থেকে ভালো আর কোনো পদ্ধতি নেই।
প্রশ্ন : একটা অভিযোগ প্রায়ই ওঠে। মুসলমানরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় কাজ করতে পারেন না। অনেকের মতে, তত্ত্বে যা-ই বলা থাক না কেন, দু-একটি রাষ্ট্র ছাড়া বাস্তবেও এটাই দেখা গেছে। আপনার কী প্রতিক্রিয়া?
মুশিরুল হাসান : আমার প্রতিক্রিয়া হবে একটি পাল্টা প্রশ্ন— মুসলমানদের কি কখনও গণতান্ত্রিক কাঠামোতে কাজ করতে দেয়া হয়েছে? ঔপনিবেশিক সরকার তো আর গণতন্ত্র দিতে পারে না। ১৯৫০-এর দশক অবধি বহু মুসলমান রাষ্ট্রই ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ছিল। কাজেই আমরা খুব বেশি হলে পঞ্চাশ বছরের কথা বলছি তাই নয় কি? মাত্র ছয় দশকের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে এত বড় একটা কথা বলা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, ঔপনিবেশিক শাসন ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ধরনও বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ছিল। ইসলাম ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে না—এ কথাটা সর্বৈব মিথ্যা। মালয়েশিয়ায় গণতন্ত্র কাজ করে, ইন্দোনেশিয়ায় করে, বাংলাদেশে করে। ইরানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ক্ষতি করেছে। মিসরে গামাল আবদুন নাসের গণতান্ত্রিক নেতা ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানেও সমস্যার সৃষ্টি করেছে। ঐতিহাসিক কারণেই আরব দেশগুলোকে এর মধ্যে ধরছি না। কারণ, সেগুলো তৈরি হয়েছে আদিবাসী সমাজ থেকে অথবা রাজতন্ত্র থেকে। এখন আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের আগলে রেখেছে। সৌদি আরবে গণতন্ত্রের কোনো সম্ভাবনাই নেই। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আছে। কাজেই আমরা এই প্রশ্নগুলো কেন তুলি না? কেবল ভুল প্রশ্নগুলো তুলি। প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক সমাজ সৌদি আরব বা কুয়েতের মতো দেশকে কখনও গণতান্ত্রিক হতে দেবে কি না। যতক্ষণ পর্যন্ত এসব রাজ্যে তেল আছে, ততক্ষণ অন্তত নয়।(natunbarta)
ভারতের প্রখ্যাত এই ইতিহাসবিদ প্রফেসর মুশিরুল হাসান ভারতে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন। সম্প্রতি সেখানকার এক দৈনিকের সঙ্গে দেয়া সাক্ষাত্কারে এ অভিযোগ করে বলেন, কলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত বড় বড় এলাকার দিকে একবার তাকান। এভাবে কি মানুষ বাস করতে পারে? পৃথিবীর কোথাও করে? তাদের জন্য আজ পর্যন্ত কোনো সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত করা হয়েছে? মোটেই হয়নি। কারণ তারা মুসলমান এবং গরিব মুসলমান। বাস্তব এটাই যে, মুসলমান এলাকায় নাগরিক সেবা প্রায় নেই বললেই চলে। একই শ্রেণীর
মুসলমান ও হিন্দুরা যেভাবে বসবাস করেন তার মধ্যে তুলনা করুন—তা হলেই পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন। বহু শহরেই এটা আমি দেখেছি, এ নিয়ে আমি পড়াশোনা করেছি, লিখেওছি। তবে কলকাতা নিয়ে এ ধরনের কথা আগে বলিনি।
এ দেশের করপোরেট দুনিয়া বরাবরই প্রতিক্রিয়াশীল ও অত্যন্ত গোঁড়া এবং বলতেই পারি তারা অত্যন্ত মুসলমানবিরোধী। বড় করপোরেটগুলোতে মুসলমানদের সংখ্যা দেখুন। প্রায় নেই বললেই চলে। কাজেই করপোরেট সেক্টর মোদিকে বেশ পছন্দ করে। সংবাদমাধ্যমও সেটাই করছে। অনেক কিছু ঘটছে তার কারণ, সংবাদমাধ্যমের ওপর করপোরেট দুনিয়ার ব্যাপক প্রভাব। কাজেই যে মূল কথাটা আমি বলতে চাই তা হলো, সংবাদমাধ্যম আর করপোরেট সেক্টরের একটা গাঁটছড়া, যেটা গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে এই দুইয়ের মতাদর্শগত অবস্থানের একটা মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, এ দেশের করপোরেট দুনিয়া বরাবরই প্রতিক্রিয়াশীল এবং অত্যন্ত গোঁড়া। বলতেই পারি তারা অত্যন্ত মুসলমানবিরোধী। বড় করপোরেটগুলোতে মুসলমানদের সংখ্যা দেখুন। প্রায় নেই বললেই চলে।
ভারতের আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী যাকে ভাবা হচ্ছে, বিজেপির সেই নেতা নরেন্দ্র মোদিকে তিনি আধা ফ্যাসিস্ট হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসার পর নরেন্দ্র মোদি যেসব বক্তব্য রেখেছেন, আমার এই ধারণাকে আরও বদ্ধমূল করেছে। আপনি যদি তার বক্তব্য, তার কাজের ধরন, তার দম্ভ, ভারতীয় সংবিধানে উল্লিখিত মূল্যবোধগুলো তার অস্বীকার করার প্রবণতা ভালো করে দেখেন, সেগুলো পর্যালোচনা করেন, তা হলেই বুঝতে পারবেন তার মতাদর্শগত চিন্তার মধ্যে একটা আধা ফ্যাসিবাদ রয়েছে।
ভারতের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা, মুসলমান সমাজের সমস্যা, বামপন্থার ব্যর্থতা ইত্যাদি নিয়ে তার একটি সাক্ষাত্কার গতকাল প্রকাশিত হয়েছে ভারতের একটি দৈনিকে। প্রফেসর মুশিরুল হাসানের সাক্ষাত্কারটি এখানে তুলে ধরা হলো :
প্রশ্ন : আমরা কি বলতে পারি ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ও রাজনীতি সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নটির মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সেটাই এই উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর সামনে একটা বড় বিপদ?
মুশিরুল হাসান : আমি আপনার সঙ্গে একমত নই। আমি মনে করি, ভারতের সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা মোটামুটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ। নরেন্দ্র মোদি ও দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদীদের উত্থান সত্ত্বেও আমি এটাই মনে করি। দেখুন ভারত বিশাল দেশ। তা ছাড়া এ মুহূর্তে এ দেশের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটছে। তার ওপর ভিত্তি করে কোনো সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হবে না। আমার মনে হয়, ২০১৪-র (লোকসভা) নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
প্রশ্ন : কিন্তু বাংলাদেশ যদি দেখি, সেখানে কিছু মানুষের ফাঁসির দাবিকে কেন্দ্র করে মূলত একটা শহুরে আন্দোলন তৈরি হয়েছে এবং যার প্রতিক্রিয়ায় গ্রামে ও মফস্বলে ইসলামি মৌলবাদীদের শক্তি একাট্টা হচ্ছে। হিন্দু-বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা হচ্ছে। পাকিস্তানে উগ্র ইসলামি শক্তির সমর্থন পেয়েছে নওয়াজ শরীফ সরকার। ভারতে নরেন্দ্র মোদি বিজেপির হাল ধরেছেন। সব মিলিয়ে আমরা কি একটা উদ্বেগজনক সাম্প্রদায়িক ভবিষ্যতের দিকে চলেছি?
মুশিরুল হাসান : এই যে ক’টি প্রবণতার উল্লেখ আপনি করলেন, তার সবক’টিই নিশ্চিতভাবে অশুভ। দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদ, দক্ষিণপন্থী ইসলামি শক্তি বা শ্রীলঙ্কায় দক্ষিণপন্থী বৌদ্ধদের উত্থান—এ সবই অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু দেখুন, আমাদের এসব সমাজে সরকার পরিচালনার গুণগত মান উন্নত না হলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। বিগত পঞ্চাশ-ষাট বছরের সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতাকেই আমি এসব সমস্যার মূল হিসেবে দেখি। এবং এই ব্যর্থতার অঙ্গ অবশ্যই এসব সমাজে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য। দরিদ্রের অবস্থার একেবারেই উন্নতি হয়নি। আর তা যখন হয় না, তখন তাদের হতাশা এসব প্রবণতার রূপ নিয়ে প্রকাশ পায়।
প্রশ্ন : আপনি এই প্রবণতাগুলোকে মানুষের দারিদ্র্যের সঙ্গে যুক্ত করছেন?
মুশিরুল হাসান : এবং তার সঙ্গে সরকারি ব্যর্থতা।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনার কি মনে হয় না এর ফলে বামপন্থী শক্তিগুলোর একটা সার্বিক উত্থান হওয়া উচিত ছিল? কিন্তু আমরা বামপন্থীদের পশ্চাত্পসরণ দেখেছি।
মুশিরুল হাসান : সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। আমি দুটি বিষয়কে জুড়তে চাইছি। প্রথমত, এই সরকার পরিচালনার ব্যর্থতা ও অধিকাংশ মানুষের দুর্দশা সত্ত্বেও মূলধারার বামপন্থীরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন এবং তার ফলেই উগ্র বামপন্থার উত্থান।
প্রশ্ন : আপনার কী মত?
মুশিরুল হাসান : আমি মনে করি তারা (মূলধারার বামেরা) বেশ কিছু ভুল করেছেন। সে কথা তারা স্বীকারও করেছেন। এর মধ্যে কৌশলগত ভুল আছে। এর মধ্যে আছে ভ্রান্ত ধারণা, যার ওপর ভিত্তি করে তারা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভারতীয় বামপন্থীদের ক্ষেত্রে আমি বলব, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যাকে বলা যায় বামপন্থী বিশ্ব কাঠামোর পতন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে বামপন্থা হয়তো জোরদারভাবে বেঁচে থাকত, যদি একটা আন্তর্জাতিক বামপন্থী আন্দোলন জীবিত থাকত।
প্রশ্ন : দক্ষিণ আমেরিকায় তো আছে।
মুশিরুল হাসান : হ্যাঁ, ওখানে বামপন্থার পুনরুত্থান ঘটেছে। তবে আমি মনে করি, ভারতে বামপন্থার ভাগ্য অন্য অনেক দলের সঙ্গে বা সমাজের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। লাতিন আমেরিকায় কিন্তু (বামপন্থীদের সঙ্গে অন্য দলের) প্রতিযোগিতার জায়গাটা বিশেষ ছিল না। তা ছাড়া সেখানে বামপন্থার উত্থানের একটা কারণ অবশ্যই মার্কিন নীতি।
প্রশ্ন : আপনি বলছেন দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের প্রধান কারণ সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে সরকারের ব্যর্থতা এবং গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির বিভিন্ন তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। যেমন?
মুশিরুল হাসান : ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোও বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক শক্তির নানা দাবির মুখে কিছু কিছু বিষয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। এমনকি বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে তারা আলাপ-আলোচনাও চালিয়েছে। যাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি বলা যেতে পারে, তাদের সঙ্গেও তারা (ধর্মনিরপেক্ষ দলেরা) যোগাযোগ রেখেছে। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করেছে তাদের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসা প্রয়োজন।
প্রশ্ন : সেটা কি তাহলে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতার ইঙ্গিতবাহী?
মুশিরুল হাসান : না। তা আমি বলব না। এর অন্য অনেক জোরের জায়গা আছে। সার্বিকভাবে এই সমাজ অসাম্প্রদায়িক, যদি ধর্মনিরপেক্ষ নাও হয়।
প্রশ্ন : একটা বিষয়ের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করি—ফতোয়া। আমার মনে পড়ছে, ধরুন মহান আমির খুসরুর সেই লাইন : আমি প্রেমের কাফের, মুসলমানিতে আমার কোনো কাজ নেই। বা কবিদের কবি বলে পরিচিত মীর তকি মীর-এর সেই পঙিক্তর কথা : মন্দিরের দুয়ারে বসে তিলক কেটেছি, কবেই তো ছেড়েছি ইসলাম। তাদের বিরুদ্ধে, তাদের শুধরে দিতে ফতোয়া জারি হয়েছে এমন তো কখনও শুনিনি। ফতোয়ার ব্যাপারটা আসলে কী?
মুশিরুল হাসান : প্রথম কথা এসব (ফতোয়ার খবর) এখন অনেক বেশি প্রকাশিত হচ্ছে। এবং সেসব খুব বাড়িয়ে বাড়িয়ে লেখা হয়। কে যে কী জারি করছে কার হয়ে, আমরা জানতে পারি না। মুসলমানদের সমালোচনা করার একটা অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ফতোয়া। আমি বলছি না ফতোয়া দেয়া হয় না। এর মধ্যে কিছু কিছু ফতোয়া জারি করা যে উচিত হয়নি তা-ও নয়। কিন্তু আমি মনে করি এই বিষয়টাকে মুসলমানদের সমালোচনা করার জন্য, তাদের খারাপভাবে দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। আমাদের সমাজে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা আরএসএসের মতো সংগঠনও আছে। তারা কী প্রচার করেন এবং কার্যক্ষেত্রে কী করেন তা খেয়াল করুন। কিন্তু ফতোয়ার মতো এমন কোনো বিভাগ নেই যা এক কথায় তাদের মৌলবাদ, তাদের গোঁড়ামি প্রকাশ করতে পারে। আছে কি? (হাসতে হাসতে) সে রকম একটা কিছু তৈরি করতে পারলে বেশ হয়। আমার মনে হয়, প্রত্যেক সমাজেই আধ ডজন খানেক পাগল থাকে। এই ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে কিছু ছিটগ্রস্ত মানুষ আছেন, যারা ফতোয়ার কার্যকারিতায় বিশ্বাস করেন। আমি মনে করি না এদের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। এবং গোটা (মুসলমান) সম্প্রদায়কে এই দিয়ে বিচার করা উচিত নয়।
প্রশ্ন : মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এর গুরুত্ব কতটা?
মুশিরুল হাসান : আমার মনে হয় না খুব একটা গুরুত্ব আছে। দেখুন, মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে এভাবে বাঁচে না। ভারতীয় সংবিধানের সব ধারা কি কেউ তার প্রাত্যহিক জীবনে মেনে চলেন? চলেন না। কিছু মানুষ কোনো স্থানীয় মোল্লার ফতোয়া মেনে চলতে পারেন। কিন্তু বাগদাদ বা কায়রোতে জারি করা ফতোয়ার (এখানে) অধিকাংশ মানুষের কাছে কোনো মানেই হয় না। একেবারে ধর্মীয় বিষয়ে (ফতোয়া) হলে হয়তো কিছুটা মানে আছে। আবার এটাও ঠিক যে, মুসলমান সমাজ বিভিন্ন স্তরে এত বিভক্ত, যেমন আপনি যদি শিয়া হন, আল আজহারের ফতোয়ার কোনো মানেই নেই। আপনি যদি হানাফি হন, তাহলে কোম-এর ফতোয়ার কোনো মানেই নেই। বরেলভিরা আলাদা। দেওবন্দিরা আলাদা। এই সূক্ষ্ম বিষয়গুলো ভুললে চলবে না।
প্রশ্ন : এ প্রসঙ্গে বলি, সালমান রুশদি নিজেই বলেছেন যে তাকে গত বছর এখানে বইমেলায় আসতে দেয়া হয়নি। এবং তার পরেই অনেকে এখানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে মুসলমান তোষণের অভিযোগ তুলেছেন...
মুশিরুল হাসান : ঠিক সেই কথাই তো আমি বলছিলাম। মুসলমান সম্প্রদায় সম্পর্কে এবং তাদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে রাজনৈতিক নেতাদের কিছু কিছু ধারণা আছে। এই ধারণাগুলোকে এবার আমাদের চ্যালেঞ্জ করা দরকার। কারণ ধারণাগুলো ভ্রান্ত। আপনি মনে করেন সালমান রুশদি ভারতে এলে মুসলমানরা অপ্রসন্ন হবেন। চেষ্টা করে দেখুন। তাকে আসতে দিন। ঝুঁকিটা নিন। হয়তো দেখবেন কিছুই হয়নি। দশজন বা কুড়িজন বা একশ’জনও বিক্ষোভ দেখালে, সেটাতে রাজনীতিকরা অভ্যস্ত। কিন্তু এ থেকে অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হন, সেটা ভুল।
প্রশ্ন : মুসলমানদের প্রতি কি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়?
মুশিরুল হাসান : অবশ্যই করা হয়। কলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত বড় এলাকাগুলোর দিকে একবার তাকান। এভাবে কি মানুষ বাস করতে পারে? পৃথিবীর কোথাও করে? তাদের জন্য আজ পর্যন্ত কোনো সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত করা হয়েছে? মোটেই হয়নি। কারণ তারা মুসলমান এবং গরিব মুসলমান। বাস্তব এটাই যে, মুসলমান এলাকায় নাগরিক সেবা প্রায় নেই বললেই চলে। একই শ্রেণীর মুসলমান ও হিন্দুরা যেভাবে বসবাস করেন, তার মধ্যে তুলনা করুন—তা হলেই পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন। বহু শহরেই এটা আমি দেখেছি, এ নিয়ে আমি পড়াশোনা করেছি, লিখেওছি। তবে কলকাতা নিয়ে এ ধরনের কথা আগে বলিনি।
প্রশ্ন : পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইমামদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করেছেন। সরকারের এই সিদ্ধান্তে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
মুশিরুল হাসান : এসব রাজনৈতিক সুবিধাবাদী পদক্ষেপ। এতে মুসলমান সম্প্রদায়ের কোনো উপকার হবে না। শুধু ইমামদের জন্য ভাতা কেন? মুসলমান মহিলাদের জন্য নয় কেন? রাষ্ট্রের কাছ থেকে তাদের তো অনেক বেশি সাহায্য দরকার। যদি সত্যি কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়, তা হলে তা দেয়া উচিত মুসলমান মেয়েদের। তাদের শিক্ষার জন্য। সে কাজটা করুন। ইমামদের ভাতা দেয়া মুসলমান সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়ার সমস্যার কোনো সমাধান হতে পারে না।
প্রশ্ন : গুজরাটে নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক সাফল্য এবং তার ভিত্তিতেই জাতীয় স্তরে তার উত্থান। এ বিষয়টিকে আপনি কী চোখে দেখছেন?
মুশিরুল হাসান : দেখুন, এ দেশের করপোরেট দুনিয়া বরাবরই প্রতিক্রিয়াশীল ও অত্যন্ত গোঁড়া এবং বলতেই পারি তারা অত্যন্ত মুসলমানবিরোধী। বড় করপোরেটগুলোতে মুসলমানদের সংখ্যা দেখুন, প্রায় নেই বললেই চলে। কাজেই করপোরেট সেক্টর মোদিকে বেশ পছন্দ করে। সংবাদমাধ্যমও সেটাই করছে। অনেক কিছু ঘটছে তার কারণ, সংবাদমাধ্যমের ওপর করপোরেট দুনিয়ার ব্যাপক প্রভাব। কাজেই যে মূল কথাটা আমি বলতে চাই তা হলো, সংবাদমাধ্যম আর করপোরেট সেক্টরের একটা গাঁটছড়া, যেটা গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে, এই দুইয়ের মতাদর্শগত অবস্থানের একটা মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে।
প্রশ্ন : আপনার মতে, নরেন্দ্র মোদির মতাদর্শগত অবস্থানটা কী?
মুশিরুল হাসান : আমি নরেন্দ্র মোদিকে আধা ফ্যাসিস্ট মনে করি। বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসার পর নরেন্দ্র মোদি যেসব বক্তব্য রেখেছেন, আমার এই ধারণাকে আরও বদ্ধমূল করেছে। আপনি যদি তার বক্তব্য, তার কাজের ধরন, তার দম্ভ, ভারতীয় সংবিধানে উল্লিখিত মূল্যবোধগুলো অস্বীকার করার তার প্রবণতা ভালো করে দেখেন, সেগুলো পর্যালোচনা করেন, তা হলেই বুঝতে পারবেন তার মতাদর্শগত চিন্তার মধ্যে একটা আধা ফ্যাসিবাদ রয়েছে। কাজেই আমি তার কাছ থেকে খুব একটা সঙ্গতিপূর্ণ কোনো বিশ্ববীক্ষণ আশাও করি না। দেখুন ইউরোপে কী হচ্ছে, উগ্র দক্ষিণপন্থা ফিরে আসছে। সেই প্রবণতা এদেশেও দেখা যাচ্ছে। আমি আশা করি, মানুষ এই বিভেদমূলক রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করবেন। আশা করি, ‘মোদি ফেনোমেনা’ বলে যেটা চালানো হচ্ছে তা প্রত্যাখ্যান করার মতো শক্তি ও দায়বদ্ধতা রাজনৈতিক দলগুলোরও রয়েছে। আমি মনে করি, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সমাজে সংবাদমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময় সংবাদমাধ্যম সমাজের মধ্যে ঐক্য স্থাপনে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এখন তা ক্রমাগত বিভেদ সৃষ্টি করার কাজে নিয়োজিত হচ্ছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ক্ষতিসাধন করছে। আপনি যদি সংবাদমাধ্যমের অতীত ও বর্তমান ভূমিকা তুলনা করে দেখেন, তা হলেই পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন।
প্রশ্ন : রাজনৈতিক প্রসঙ্গে আসি, একদিকে ইউপিএ সরকার, যার বিরুদ্ধে সরকারি ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার অভিযোগ; অন্যদিকে বিজেপি যার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ। আর একদিকে বেশকিছু ছোট ছোট রাজনৈতিক দল, যাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই চরম দুর্নীতির অভিযোগ। ভারতীয় ভোটারদের সামনে বিকল্পটা কী?
মুশিরুল হাসান : যা-ই বলুন না কেন, স্থানীয় দলগুলোর নেতারা নিজের নিজের এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। জাত-পাত ও স্থানীয় রাজনীতির ওপর ভিত্তি করা একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিকল্প কী হতে পারে, সেটা আপনি বা আমি ঠিক করব না। সে বিকল্প খুব সোজাসাপটাও হবে না। এই জোট রাজনীতির যুগে বিকল্পের মধ্যে বৈচিত্র্য প্রতিফলিত হতে বাধ্য। দেখুন নীতিশ কুমারের সরকারের সঙ্গে কিন্তু বিজেপির বহু দিন একটা জোট ছিল। মুসলমানরা সেটাকে খুব একটা খারাপ চোখে নেয়নি। আশা করি, নির্বাচন এবার মোদির সব আশা চিরকালের মতো শেষ করে দেবে।
প্রশ্ন : মূলধারার বামপন্থীদের অবস্থা খারাপ কিন্তু আমরা দেখছি রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের একটা বড় জায়গাজুড়ে মাওবাদী উগ্র বামপন্থীরা নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে। আপনার প্রতিক্রিয়া?
মুশিরুল হাসান : দেখুন, এ সবই বৈষম্যজনিত ক্ষোভের প্রকাশ। রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা কোনো কাজের কথা নয়। রাষ্ট্র একটা বাস্তব। সেই বাস্তবকে মেনে নিতে শিখতে হবে। রাষ্ট্রের সঙ্গে দরাদরি করতে হবে। নিজেদের অনুগামীদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলার এর থেকে ভালো আর কোনো পদ্ধতি নেই।
প্রশ্ন : একটা অভিযোগ প্রায়ই ওঠে। মুসলমানরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় কাজ করতে পারেন না। অনেকের মতে, তত্ত্বে যা-ই বলা থাক না কেন, দু-একটি রাষ্ট্র ছাড়া বাস্তবেও এটাই দেখা গেছে। আপনার কী প্রতিক্রিয়া?
মুশিরুল হাসান : আমার প্রতিক্রিয়া হবে একটি পাল্টা প্রশ্ন— মুসলমানদের কি কখনও গণতান্ত্রিক কাঠামোতে কাজ করতে দেয়া হয়েছে? ঔপনিবেশিক সরকার তো আর গণতন্ত্র দিতে পারে না। ১৯৫০-এর দশক অবধি বহু মুসলমান রাষ্ট্রই ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ছিল। কাজেই আমরা খুব বেশি হলে পঞ্চাশ বছরের কথা বলছি তাই নয় কি? মাত্র ছয় দশকের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে এত বড় একটা কথা বলা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, ঔপনিবেশিক শাসন ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ধরনও বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ছিল। ইসলাম ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে না—এ কথাটা সর্বৈব মিথ্যা। মালয়েশিয়ায় গণতন্ত্র কাজ করে, ইন্দোনেশিয়ায় করে, বাংলাদেশে করে। ইরানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ক্ষতি করেছে। মিসরে গামাল আবদুন নাসের গণতান্ত্রিক নেতা ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানেও সমস্যার সৃষ্টি করেছে। ঐতিহাসিক কারণেই আরব দেশগুলোকে এর মধ্যে ধরছি না। কারণ, সেগুলো তৈরি হয়েছে আদিবাসী সমাজ থেকে অথবা রাজতন্ত্র থেকে। এখন আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের আগলে রেখেছে। সৌদি আরবে গণতন্ত্রের কোনো সম্ভাবনাই নেই। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আছে। কাজেই আমরা এই প্রশ্নগুলো কেন তুলি না? কেবল ভুল প্রশ্নগুলো তুলি। প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক সমাজ সৌদি আরব বা কুয়েতের মতো দেশকে কখনও গণতান্ত্রিক হতে দেবে কি না। যতক্ষণ পর্যন্ত এসব রাজ্যে তেল আছে, ততক্ষণ অন্তত নয়।(natunbarta)
Comments
Post a Comment