ঢাকায় ডিভোর্সে এগিয়ে মেয়েরা

রুদ্র মিজান | ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, শনিবার(সৌজন্যে :মানবজমিন)

স্বামী আমার। ফোন করলে আমাকে ফোন করবে। কিন্তু তা না করে আগে তার ভাই-বোনকে ফোন করে কথা বলে। পরে আমার সঙ্গে। এটা স্ত্রীর প্রতি অবহেলা। এ অবহেলা মেনে নেয়া যায় না। তার সঙ্গে ঘর করা যায় না। অতএব ডিভোর্স। সামান্য এ কারণে একটি সংসার ভেঙে খান খান। এরকম তুচ্ছ ঘটনায় ভেঙে যাচ্ছে- অনেকের ঘর। এ ক্ষেত্রে মেয়ে পক্ষ থেকেই ডিভোর্সের ঘটনা ঘটছে বেশি। এমনই এক ঘটনা রাজধানীর এক তরুণ ব্যবসায়ীর। দু’বছর আগে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন বনানী এলাকার বাসিন্দা প্রেমিকাকে। বিদূষী সুন্দরী ওই স্ত্রীর কোনও চাওয়া অপূর্ণ রাখেনি তার স্বামী। হানিমুন করেছেন মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে। শপিংয়ের খরচ বাবদ প্রতি মাসে স্ত্রীকে মোটা অংকের টাকাও দিতেন। তবে ব্যবসায়িক কারণে সব সময় একসঙ্গে সময় কাটানো, ঘুরে বেড়ানো হতো না। এ থেকেই স্ত্রীর খারাপ ব্যবহারের শিকার হন ওই তরুণ। এ অবস্থায় ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে সালমার। সালমা চলে যান পিতার বাসা লালমাটিয়ায়। দীর্ঘদিন এভাবেই ঝুলে থাকে তাদের সম্পর্ক। একপর্যায়ে ডিভোর্সের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে এ সম্পর্কের। মানসিক নির্যাতন ও দূরত্ব, পরকীয়া, অর্থনৈতিক চাহিদা ইত্যাদি কারণে রাজধানীতে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে ডিভোর্সের হার। শতকরা ৬৬ ভাগ ডিভোর্সই দেয়া হচ্ছে স্ত্রীদের পক্ষে থেকে। ডিভোর্স বেশি ঘটছে উচ্চবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের মধ্যে। সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী গত বছর রাজধানীতে ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে ৮২১৪ দম্পতির। এর আগে ২০১২ সালে ৭৬৭২ দম্পতির মধ্যে ডির্ভোস হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৬১০ দম্পতির ডিভোর্স হয়েছে। তার মধ্যে ৪২৬ ডিভোর্সই ঘটেছে স্ত্রী কর্তৃক।
ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তরের গুলশান, বনানী, মহাখালী, বাড্ডা, মগবাজার, রামপুরা নিয়ে অঞ্চল-৩। এ এলাকায় গত বছরে ৫৯৮ দম্পতির মধ্যে ডিভোর্স হয়েছে। এর মধ্যে স্বামী ডিভোর্স দেয় ২৩৫ এবং স্ত্রী দেয় ৩৬৩টি। রাজধানীর সূত্রাপুর, বংশাল, নবাবপুর, কাপ্তান বাজার, নাজিরাবাজার ও লালবাগের অর্ধেক নিয়ে গঠিত ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণের অঞ্চল-৪। এই এলাকায় গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২৫৮ দম্পতির মধ্যে ডিভোর্স হয়েছে। এর মধ্যে স্ত্রীর পক্ষ থেকে ১৭৩ এবং ৮৫ ডিভোর্স হয়েছে স্বামীর পক্ষ থেকে। তার আগের বছর একই এলাকায় ২৯১ দম্পতির মধ্যে ডিভোর্স হয়েছে। এর মধ্যে ১৮৪ ডিভোর্স হয়েছে স্ত্রীর পক্ষ থেকে।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, মেয়েরা আগের চেয়ে অনেক স্বাধীন ও স্বনির্ভর হচ্ছে। তাই আগের মতো মুখ বুঝে নির্যাতন সহ্য করতে চান না বলেই বাড়ছে ডিভোর্সের সংখ্যা। ঢাকা সিটি করপোরেশন অঞ্চল-৪ এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুহাম্মদ রিয়াজুল হোসেন জানান, আঙ্কাজনকভাবে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটছে। বেশি সংসার ভাঙছে তুচ্ছ কারণেই। তা মেয়ের পক্ষ থেকেই বেশি ঘটছে। ডিভোর্সের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, নানা তথ্য। দীর্ঘ ২৭ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়েছেন রাজধানীর মগবাজারের  হলি ফ্যামেলি রেড ক্রিসেন্টের একজন কনসালট্যান্ট। দীর্ঘদিন থেকেই স্বামীর মানসিক নির্যাতনে অতিষ্ঠ ছিলেন তিনি। স্বামীর সন্দেহ প্রবণতা ছিল প্রখর। তাই শেষ পর্যন্ত সংসার ভাঙতে হয়েছে। ১৯৮৬ সালের ২৪শে ডিসেম্বর রাজধানীর বারিধারার পার্ক রোড এলাকার একজনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল এ চিকিৎসকের। তাদের সংসারে দুটি সন্তানও রয়েছে। ডিভোর্স প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য করতে চাননি এ চিকিৎসক। তবে তার এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী জানান, শুরু থেকেই মানসিকভাবে দু’জনের মধ্যে দূরত্ব ছিল। অন্যদিকে, স্বামীর পরকীয়া আসক্ততা, মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ এনে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ভেঙেছেন ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা রাফিজা ফারজানা। মেয়েদের পক্ষ বিবাহ-বিচ্ছেদ বেশি হওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন- ‘নারীরা আগের চেয়ে শিক্ষিত, সচেতন ও স্বনির্ভর। ফলে তাদের স্বাধীনতা বেড়েছে। আগে মুখ বুঝে স্বামীর নির্যাতন সহ্য করলেও এখন তারা করছেন না।’ এছাড়া পেশাগত কারণও রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নারীরা সারা দিন অফিসে বা কারখানায় কাজ করেন। আবার বাসার কাজও করেন। বাচ্চা দেখাশুনা করেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই স্বামীর কোন সহযোগিতা পান না। এতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তাই নারীরা হয়তো ভাবেন আলাদা থাকাই ভালো।’ স্ত্রীর পক্ষ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের আরও একটি কারণ দেনমোহর পরিশোধ সংক্রান্ত ভুল ধারণা। দু’বছর আগে স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছেন রাজধানীর মগবাজার এলাকার জেসিকা নওরিন। তিন বছরের সংসার জীবনে স্বামীর মানসিক নির্যাতনে অসহ্য হয়েই তিনি সংসার ভঙেন। নওরিন বলেন, ‘স্বামী কখনই ডিভোর্স দিতো না। কারণ, ডিভোর্স দিলেই তাকে দেনমোহরের টাকা গুণতে হতো। এজন্য আমিই ডিভোর্স দিয়েছি।’ এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘ডিভোর্স যেই দিক দেনমোহর স্বামীকে পরিশোধ করতে হবে। এজন্য পারিবারিক আদালতে স্ত্রীকে মামলা করতে হবে। এমনকি স্ত্রী ডিভোর্সের পর গর্ভজাত বাচ্চার ভরণপোষণ দাবি করতে পারবেন। এগুলো তার অধিকার।’ গত বছরের শেষ দিকে প্রবাসী স্বামীকে ডিভোর্স দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা। পারিবারিকভাবে বিয়ে হলেও স্বামীর পরিবারের অন্য সদস্যরা ওই শিক্ষিকাকে মেনে নেননি। বিয়ের পর কয়েক মাস স্বামীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। একপর্যায়ে শিক্ষিকা অনুভব করেন তার স্বামীও তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। দেশের বাইরে থেকে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তার স্বামীর নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ হলেও স্ত্রীর সঙ্গে হতো কম। এসব কারণেই ক্ষোভ বাড়তে থাকে স্ত্রীর। একপর্যায়ে প্রবাসী স্বামীকে ডিভোর্স দেন তিনি। আবার স্ত্রীর প্রতি অবাধ্যতা ও বেপরোয়া চলাফেরার অভিযোগ এনে ডিভোর্স দিয়েছেন উত্তরার তিন নম্বর সেক্টরের এক বাসিন্দা। তিনি অভিযোগ করেন, তার স্ত্রী বেপরোয়া চলাফেরা করতেন। ধর্মীয় অনুশাসনের তোয়াক্কা করতেন না। এ কারণেই গত ৮ই জানুয়ারি স্ত্রীকে ডিভোর্স দেন তিনি। প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে পারিবারিক সিদ্ধান্তে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার ফলেও ডিভোর্স দেয়ার ঘটনা ঘটছে। এরকম অভিযোগ এনে বিয়ের ৭-৮ মাসের মধ্যেই সংসার ভেঙেছেন কলাবাগানের গ্রীণ রোড এলাকার মনির। গত বছরের ৩রা ফেব্রুয়ারিতে বিয়ের পর ২৩শে নভেম্বর স্ত্রীকে ডিভোর্স দেন তিনি। স্ত্রীর পক্ষ থেকে ডিভোর্সের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অনেকেই স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুক ও মারধরের অভিযোগ করেন। গত বছরের ৭ই মে স্ত্রী নুরুন নাহারকে ডিভোর্সের নোটিশ দেন রাজধানীর দক্ষিণ খানের মধ্য আজমপুর জালাল আহমেদ স্মরণি এলাকার মকবুল হোসেন। স্ত্রীর প্রতি তার অভিযোগ স্বামীর অবাধ্য ও বেপরোয়া চলাফেরা। এ দম্পতির বিয়ে হয় ২০০১ সালের ২৯শে জানুয়ারি। ১৩ বছরের দাম্পত্য জীবনে তাদের রয়েছে এক পুত্র ও এক কন্যা। স্বামীর ডিভোর্সের নোটিশ পাওয়ার পর যৌতুক ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করেন নুরুন নাহার। তিনি দাবি করেন, বিয়ের সময় বর মকবুলকে নগদ দুই লাখ টাকাসহ মোট ১০ লাখ টাকা যৌতুক দিয়েছেন তার পরিবার। পরে জমি ক্রয় ও বাসা নির্মাণের জন্য ৮ লাখ টাকা দিয়ে সহযোগিতা করা হয় তাকে। পরে আরও যৌতুক দাবি করে তার স্বামী। যৌতুক দিতে অসম্মতি জানালেই তিনি তালাকের নোটিশ দেন। একপর্যায়ে গত বছরের  ২১শে আগস্ট আদালতের মাধ্যমে এ দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে

Comments