আবদারে কি সংবিধানভ্রষ্ট সরকারের টনক নড়বে?
সাদেক খান
১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, শনিবার,সৌজন্যে নয়দিগন্ত
১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, শনিবার,সৌজন্যে নয়দিগন্ত
বেঘোরে কেটেছে ২০১৩ ইংরেজি সালের সারা বছর। হিংসা-প্রতিহিংসার
রক্তপাত, জীবনহানি, সম্পদহানি, নিরাপত্তাহীনতায় সন্ত্রস্ত ছিল জনসমাজ। এক
দিকে সরকারপে মিথ্যা মামলা, গ্রেফতারবাণিজ্য, গুম, খুন, ক্রসফায়ার,
লাঠিচার্জ, নির্বিচার গুলি আর সরকারি প্রশ্রয়ে লুটতরাজ, ধর্ষণসহ নানা
সশস্ত্র অপরাধ এবং বাঁধা চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ, দখল-বাণিজ্যের দৌরাত্ম্যে
অভিশপ্ত ছিল নাগরিক জীবন। অন্য দিকে বিরোধী দলের হরতাল, অবরোধ, ঝটিকা
মিছিল, ককটেল নিপে, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ ও প্রতিরোধের
পৌনঃপুনিক কর্মসূচিতে আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ড ছিল অচলাবস্থা। এখন মাইক্রো বা
ব্যাষ্টিপর্যায়ে প্রায় দেউলিয়াপনার মুখোমুখি অনেক আত্মকর্মসংস্থাননির্ভর
স্বল্পবিত্ত নি¤œবিত্ত মানুষ, বিত্তহীন পরিবারগুলোর দুর্দশা অবর্ণনীয়।
বিশেষ করে মফস্বল শহরে শুধু নয়, সুদূর পল্লী এলাকার হাটবাজার নদীবন্দরেও
বর্তেছে অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যের অচলাবস্থা ও বেচাকেনা প্রায় বন্ধ
থাকার প্রতিকূল পরিণতি। শিল্প এলাকাগুলোতে এবং কলকারখানায় প্রায় সর্বত্র
শ্রম অসন্তোষ লক আউট ঘেরাও ভাঙচুর সংঘর্ষের অবতারণা ঘটিয়েছে।
অনেক পোশাক তৈরির কারখানাসহ ছোটবড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিপন্ন অবস্থায়
কোনোমতে টিকে আছে। গৃহনির্মাণ খাতের বেহাল অবস্থা, খেটে খাওয়া মানুষের জন্য
বস্তি বা মেসে মাথা গোঁজার জায়গা কিংবা সচ্ছল পরিবারের জন্যও বাড়িভাড়া
সাধ্যাতীত হয়ে পড়েছে। হাড়কাঁপানো শীতে মৃত্যু ঘটেছে কিছু মানুষের, তবে
পুলিশের হাতে, চুক্তি খুনি বা ডাকাতের হাতে, কিংবা রাজনৈতিক সংঘর্ষ বা
প্রতিরোধের কারণে নিত্যনৈমিত্তিক অপমৃত্যুর তুলনায় তেমন কারণে অপমৃত্যুর
সংখ্যা ছিল নগণ্য।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের য়তি ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। তবুও মাইক্রো বা
সমষ্টিগত-পর্যায়ে জাতীয় অর্থনীতির সব সূচক বিপজ্জনকভাবে নি¤œগামী। ২৫
জানুয়ারি প্রকাশিত বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা
সিপিডির একটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে কর আদায়
হ্রাস পেয়েছে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকিং খাতে পড়ে আছে ৮৬ হাজার
কোটি টাকার অলস তারল্য। রাজনৈতিক সহিংসতায় তিগ্রস্ত পোশাক খাতসহ কিছু খাতে
প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু গ্রামের কৃষকেরা যে তির মুখে পড়েছেন তাদের
জন্য কোনো সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়নি।
একইভাবে ছিল তিগ্রস্ত পরিবহন খাত। এই তি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার যে
নীতিসহায়তা দিচ্ছে, সেখানে কৃষি ও কৃষিজাত খাতের মতো পরিবহন খাতকেও
অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে গত ছয় মাসে চার খাতে
৪৯ হাজার ১৮ কোটি টাকার অর্থনৈতিক তি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই মাস থেকে
ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিবহন, কৃষি, তৈরী পোশাক ও পর্যটন খাতে ৪৯ হাজার ১৭
কোটি ৯২ লাখ টাকার আর্থিক তি হয়েছেÑ যা মোট দেশজ উৎপাদনের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
এর মধ্যে পরিবহনে ১৬ হাজার ৬৮৮ কোটি ৬৫ লাখ, কৃষিতে ১৫ হাজার ৮২৯ কোটি,
পোশাক খাতে ১৩ হাজার ৭৫০ কোটি এবং পর্যটন খাতে দুই হাজার ৭৫০ কোটি টাকার
লোকসান হয়েছে বলে সিপিডি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। আরো বলা হয়, অবশ্য
অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারের রাজস্ব আদায়, বিদেশী বিনিয়োগ, বৈদেশিক
অনুদানসহ বিভিন্ন খাতে ল্যমাত্রার তুলনায় আয় অনেক কম হলেও ব্যয়ের মাত্রা কম
থাকায় ঘাটতি নেই। কিন্তু এটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের সাথে
অসামঞ্জস্যপূর্ণ, কোনো শুভসংবাদ নয়। ফলে আয় এবং ব্যয়ের কাঠামো পুনর্গঠন করা
জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া যত দিন আস্থাভাজন নির্বাচন না হবে তত দিন পর্যন্ত
এই রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্পূর্ণভাবে কাটবে না। আর এটা যদি না হয় তবে দেশী
বা বিদেশী কোনো দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হবে না।
অন্য দিকে নতুন ইংরেজি সালে এসে বিরোধী দলের বয়কটের মধ্যে একটা
ভোটারবঞ্চিত একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে মতার কেতাবি উত্তরণ ঘটেছে। ওই
নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য আখ্যা দিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য
নির্বাচনের জন্য অবিলম্বে বিরোধী দলের সাথে সংলাপ ও মতৈক্যের মাধ্যমে
ভোটগ্রহণ ও নয়া পার্লামেন্ট গঠনের পরামর্শ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন
ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাব বলয়ভুক্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। রাশিয়া ও চীন
নয়া হাসিনা সরকারকে কূটনৈতিক সৌজন্যমূলক অভিনন্দন জানিয়ে অর্থনৈতিক
সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বার্তা দিলেও অভন্ত—রীণ স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক
উন্নয়নের স্বার্থে মতার রাজনীতিতে বিভক্ত দুই পকেই সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায়
পৌঁছানোর পরামর্শ দিয়েছে। ভারত সুস্পষ্ট সমর্থন দিয়েছে ৫ জানুয়ারির
ভোটারবঞ্চিত কেতাবি নির্বাচনকে, বলেছে সেটা ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ
সমাজব্যবস্থা ও সংবিধানের বাধ্যবাধকতা। তবে সমঝোতার মাধ্যমে বাংলাদেশে
সর্বজনগ্রাহ্য একটা মধ্যবর্তী নির্বাচন ভারতের নিরাপত্তাস্বার্থ ও
প্রতিবেশিসুলভ সুসম্পর্কের জন্যই বাঞ্ছনীয়, এ কথা ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও
ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভারতশক্তির অঘোষিত বার্তা
হিসেবে প্রচারিত হচ্ছে। বিতর্কিত দশম সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণের পর খালেদা
জিয়া আর সংসদীয় বিরোধী দলনেতা নন। তা সত্ত্বেও ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার
১৮ দলীয় জোট নেত্রী ও বিএনপি সভানেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে সাাৎ করে
বিতর্কিত নির্বাচনের পরিপ্রেেিত সমঝোতার ভিত্তিতে একটা মধ্যবর্তী নির্বাচনে
‘বিএনপি’ মতাসীন হলে ভারতের শুভেচ্ছা ও সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে এই বার্তা
পৌঁছে দিয়েছেন। সরাসরি না হলেও সংবাদভাষ্য ও আধা সরকারি ভূ-রাজনৈতিক
বিশ্লেষণের মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগতপর্যায়ে বিরোধী জোটভুক্ত নেতাদের সাথে
একান্ত আলোচনায় ভারত সরকারের তরফে বিএনপি নেতৃত্বকে এ কথাও জানিয়ে দেয়া
হয়েছে যে, ১৮ দলীয় জোটে জামায়াত ও হেফাজত সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দের সঙ্গ ত্যাগ
না করেও সংশ্লিষ্টতা শিথিল করলে ভারতশক্তি বিএনপির মতারোহণের বিপে তার
আঞ্চলিক প্রভাব খাটাবে না। দশম পার্লামেন্টের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
সরাসরি বলেছেন, জামায়াত-হেফাজতের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করলেই মাত্র সবার
অংশগ্রহণে একটা মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়ার ল্েয বিএনপি সভানেত্রীর সাথে এবং
অন্যান্য ‘ধর্মনিরপেতাবাদী’ রাজনৈতিক দলকে শামিল করে সাংবিধানিক ফর্মুলা
আবিষ্কারের সংলাপ শুরু হতে পারে।
ইতঃপূর্বে ৫ জানুয়ারি ভোটার বঞ্চনার নির্বাচনের পরের দিনই
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নবম সংসদের বিরোধী দল নেতা খালেদা জিয়ার সাথে
সাাৎ করেন। অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনলব্ধ কেতাবি দশম সংসদের মেয়াদ সংপ্তি করে
অবিলম্বে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন
অনুষ্ঠানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র মতাসীন সরকারকে চাপ দেবে বলে আশ্বাস দেন এবং
১৮ দলীয় বিরোধী জোট নেত্রীকে কঠোর কর্মসূচি থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ পাশ্চাত্য
দেশগুলোর তরফে একই বার্তা দেয়া হয় খালেদা জিয়াকে। চীনের রাষ্ট্রদূতও নবম
সংসদের মেয়াদ অবসানের আগে বিরোধী দলনেতা বেগম জিয়ার সাথে শেষ আনুষ্ঠানিক
বৈঠক করে সব দলের অংশগ্রহণে নয়া নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক মীমাংসার সংলাপে
চীনের সমর্থন ব্যক্ত করেন।
এমন একটা ভূ-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার গুঞ্জনে সম্ভবত কিছুটা বিব্রত বোধ
করেই শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে নবম সংসদের মেয়াদপূর্তির আগেই দশম সংসদের গেজেট
ঘোষণা, শপথগ্রহণ ও নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পদপে অনুমোদন করেন। তাতে তারই
উদ্যোগে গৃহীত পঞ্চম সংশোধনী নির্দেশিত ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’র সমূহ
লঙ্ঘন ঘটেছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বেশির
ভাগ আইনবিদ। ও দিকে সরকারপে বলা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গেজেট ঘোষণা
মোতাবেক দশম জাতীয় সংসদের বিতর্কিত নির্বাচনলব্ধ সংসদ সদস্যরা শপথ নিলে এবং
দশম সংসদ ডাকলেই নবম সংসদ আপনাআপনি বিলুপ্ত হবে। অথচ সংবিধান বলেছে, শুধু
দু’ভাবে সংসদ লুপ্ত হবে। প্রথমত প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শে রাষ্ট্রপতির
আদেশে। দ্বিতীয়ত, প্রথম বৈঠক থেকে পাঁচ বছরের মেয়াদ পুরো হলে। এটা পুরো
হতো ২৪ জানুয়ারি। সে জন্য অপো না করে তড়িঘড়ি করে ৯ জানুয়ারি নতুন
নির্বাচনের ফল সরকারি বিজ্ঞপ্তি দ্বারা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন
সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের তিন দফার শর্ত নির্দিষ্টভাবে লঙ্ঘন করেছে।
স্পিকার শপথ পড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে তার শপথও লঙ্ঘন করেছেন। কারণ সংবিধানে বলা
হয়েছে : “১২৩ (৩) সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে (ক)
মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার েেত্র ভাঙ্গিয়া যাইবার
পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে: এবং (খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে
সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার েেত্র ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে:
তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে
নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত
সংসদ-সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।” দশম সংসদ নির্বাচন ওই (ক) উপদফা
মতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা আরো যুক্তি দিচ্ছেন : (সংবিধানের)
১৪৮(২ক) বলেছে, ‘১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফার অধীন অনুষ্ঠিত সংসদ সদস্যদের
সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপিত হওয়ার তারিখ থেকে
পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে’ শপথ পড়াতে হবে। এই অনুচ্ছেদেরই ৩ উপদফা বলেছে,
শপথ মাত্রই কার্যভার গ্রহণ। এভাবে নবম সংসদের জীবদ্দশাতেই দশম সংসদ সদস্যরা
কার্যভার গ্রহণ করে দ্বৈত সংসদের সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টি করেছে। তারপরও
রাষ্ট্রপতি যদি সরকার করার আমন্ত্রণ জানাতে আরো ১৫ দিন সময় নিতেন, তাহলে
সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ বেঁচে যেত। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ২৪ জানুয়ারির আগেই
দশম সংসদের আস্থাভাজন নেত্রীকে প্রধানমন্ত্রী হতে আমন্ত্রণ জানিয়ে
সংবিধানের ১২৩ ও ৫৬ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘনের দায়ে অভিশংসনের ত্রে সৃষ্টি করেছেন।
আর শেখ হাসিনা পাতানো সংসদেও কোনো বিরোধী দলের ভূমিকা না রেখে বাকশালী
কায়দায় নয়া সর্বদলীয় মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ করে কার্যত সংবিধানকে নিরর্থক
প্রতিপন্ন করেছেন।
এ দিকে ১৮ দলীয় জোটনেত্রী আপাতদৃষ্টিতে পাশ্চাত্য কূটনীতিবিদদের
পরামর্শ গ্রহণ করে ‘কঠোর কর্মসূচি’ থেকে বিরত থেকেছেন। অবরোধকাতর দেশবাসীকে
কিঞ্চিৎ রেহাই দিয়েছেন। অন্য দিকে ‘কঠোর দমননীতি’ কঠোরতর করেছে মতাসীন নয়া
সরকার। রাজধানীর সড়ক দখলে রাখার প্রয়োজন কমেছে, বেড়েছে মফস্বলে
র্যাব-পুলিশ-বিজিবি যৌথ অভিযানে চিহ্নিতদের লাশ ফেলার কর্মসূচি।
বিচ্ছিন্নভাবে কোনো-না-কোনো জেলা-উপজেলায় পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ প্রতিবাদ
কর্মসূচি স্থানীয় হরতাল লেগেই আছে।
১৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে ১৮ দলীয় জোটের তরফে জনগণকে অভিনন্দিত
করেছেন ৫ জানুয়ারি ‘প্রহসনের নির্বাচন’ বর্জন করে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা
লঙ্ঘনের ‘নীরব বিপ্লব’ সাধনের জন্য। ধারণা দিয়েছেন, ওই ‘নীরব বিপ্লব’ যেন
তাকে আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করে সংলাপের মাধ্যমেই বিতর্কিত সংসদ ও অবৈধ
সরকারের অবসান ঘটিয়ে জনমতের চাপে (ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূ-রাজনৈতিক
সহায়তায়) সাংবিধানিক সমঝোতা ও ধারাবাহিকতাপুষ্ট একটি গ্রহণযোগ্য
নির্বাচনানুষ্ঠান ও মতার উত্তরণ ঘটানোর সুযোগ করে দিয়েছে। ২০ জানুয়ারি
সরকারের শর্ত মেনে জামায়াতকে বাদ দিয়ে বিএনপি, ইসলামপন্থী ছাড়া ১৮ দলীয়
জোটের অন্যান্য শরিক এবং খণ্ডিত জাতীয় পার্টির কাজী জাফরকে নিয়ে তিনি বিশাল
জনসভা করেছেন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখানে উদাত্ত ভাষণে তিনি
বলেছেন : ‘বর্তমান সরকার মতায় আছে জনগণের ভোটে নয়, অস্ত্রের জোরে। এরা
স্বৈরাচারের বাপ। দুই স্বৈরাচার (শেখ হাসিনা ও এরশাদ) এক হয়ে এখন দেশকে
গিলতে বসেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে, গায়ের জোরে
ভোট করা যায় না। অস্ত্রের জোরে বেশি দিন মতায় থাকা যায় না। অতি অল্প সময়ের
মধ্যে এই সরকার বিদায় নেবে ও জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। সরকারকে বলব,
তাদের ২, ৩ বা ৪ শতাংশ ভোট আছে। এ জনসমর্থন বজায় রাখতে হলে দ্রুত নির্বাচন
দিন। নইলে এ সমর্থনও হারাবেন। জনগণ অন্যায়ের প্রতিবাদ করে নির্দলীয় সরকারের
অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য করবে।’ একই দিনে নির্বাচন-পূর্ব সহিংস সঙ্ঘাত ও
যৌথ অভিযানে ‘রক্তাক্ত’ সাতীরায় আওয়ামী লীগের জনসভায় নয়া সরকারের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন : ‘বিএনপি গত ৫ জানুয়ারির
নির্বাচনে না এসে যে ভুল করেছে, সে জন্য আগামী পাঁচ বছর এ ভুলের খেসারত
দিতে হবে। তিনি (খালেদা জিয়া) এখন জামায়াতের আমিরের দায়িত্বভার গ্রহণ
করেছেন। বিএনপি নেত্রী যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা
দিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। যারা হরতাল অবরোধের নামে রাস্তা কেটে, গাছ কেটে,
সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সর্বস্বান্ত করেছে তাদের এ
কর্মকাণ্ডের বিচার বাংলার মাটিতেই হবে। বাংলার মাটিতে তাদের কোনো স্থান
নেই।’
এভাবে শেখ হাসিনা এরই মধ্যে সুর পাল্টেছেন। ইতঃপূর্বে মার্কিন
রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলেছিলেন, এ বছর জুনের মধ্যেই একটি বিশ্বাসযোগ্য
নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রয়োজন যেখানে ‘বাংলাদেশের জনগণ অবাধে মত প্রকাশের
সুযোগ পাবে।’ রাজনৈতিক অস্থিরতাজনিত অর্থনৈতিক সঙ্কটের হিসাব থেকেও একই
ধরনের মন্তব্য এসেছে ২৫ জানুয়ারি প্রকাশিত সিপিডির মাইক্রো ইকোনমিক
পারফরম্যান্স ২০১৩-১৪ পর্যবেণ প্রতিবেদনে। সিপিডি বলেছে সবার কাছে
গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান না হলে আস্থার সঙ্কট কাটবে না। এটা
জনপ্রত্যাশা। প্রবৃদ্ধি অর্জনের তাগিদেই সমঝোতার মাধ্যমে অবিলম্বে একটি
নির্বাচনের সুপারিশ করেছে সিপিডি। সেটি সম্ভব না হলে সরকার বাজেট পর্যন্ত
বাধাহীনভাবে যেতে পারবে কি না এমন সন্দেহ প্রকাশ করেছে ওই গবেষণা সংস্থা।
শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ পালন করে আবারো একটি
নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসা হতে পারে। কিন্তু খালেদা জিয়া
অবরোধের রণেভঙ্গ দিয়ে ১৮ দলীয় জোটের ‘ধর্ম নিরপেতাবাদী’ সংস্কারে মৌন
সম্মতির লণ ব্যক্ত করায় শেখ হাসিনা ভাবছেন, বাজিমাত হয়ে গেছে। আরো পাঁচ বছর
প্রধানমন্ত্রিত্বের তৃতীয় মেয়াদ পূর্ণ করেই তিনি মতা ছাড়বেন। দিল্লির
তরফেও একইভাবে একরকম ভূ-রাজনৈতিক হাওয়া বদলের লণ থেকে হাসিনা সরকারকে আরো
বেশ কিছু দিন টিকিয়ে রাখা যাবে মনে করে সরকারের সন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ ঘটছে
ভারতীয় বিশ্লেষক ও সংবাদ ভাষ্যকারদের মন্তব্য ও কৌশলপত্রে। উদাহরণ হিসেবে
কলকাতার ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ‘জটিল বিজয়’ শিরোনামে বিবিসির
পূর্বভারতীয় সংবাদদাতা সুবীর ভৌমিক রচিত প্রতিবেদন উদ্ধৃত করছি। সুবীর
লিখেছেন :
‘তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রিত্ব নেয়ার সময় শেখ হাসিনা ওয়াজেদ তার
সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তাই তিনি বিরোধী দলের সাথে একটি সংলাপের
প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বলেছেন, সমঝোতা হওয়ার পর পরই যত তাড়াতাড়ি একটি অবাধ
নির্বাচন হবে। এবারের নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্যতার চেয়ে কম বলে আখ্যায়িত
করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
‘এ নির্বাচনকে একদলীয় বলে আখ্যায়িত করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কমনওয়েলথ।
তারাও সুষ্ঠু একটি নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী
ভারত সমর্থন দেয় শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে।
‘কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে শেখ হাসিনার জন্য পাল্টে গেছে পরিস্থিতি।
তার সরকারকে সমর্থন দিয়েছে রাশিয়া। তারা বলেছে, বাংলাদেশের নতুন সরকারের
সাথে গঠনমূলক অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতামূলক কাজ করতে চায়।
‘ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি চুন বরাবরই চুপচাপ থাকেন। কিন্তু
এবার ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ
আহ্বান করেন, যাতে সহিংসতার বিরুদ্ধে বিচণতা জয়ী হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা
তৃতীয়বারের মতো মতা নিয়ে গঠন করেছেন মন্ত্রিসভা। এ সময়ে তিনি একটি বার্তা
পেয়েছেন চীনা প্রধানমন্ত্রী লি খেছিয়াং-এর কাছ থেকে। তাতে বলা হয়েছে, চীন ও
বাংলাদেশের মধ্যে সমন্বিত ও সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বকে নতুন এক উচ্চতায়
নিয়ে যেতে শেখ হাসিনার সরকারের সাথে হাত মেলাতে তার সরকার উদগ্রীব।
লি’র ওই চিঠিতে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা বা এর একদলীয় প্রকৃতির
উল্লেখ করা দূরের কথা নির্বাচন প্রসঙ্গই অনুপস্থিত। পশ্চিমাদের, বিশেষ করে
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এর মাধ্যমে চীন একটি পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে। তাতে
বোঝানো হয়েছে ঢাকার সরকারের কাছেই গণতন্ত্র ও সুশাসনের বিষয়টি ছেড়ে দেয়া
ভালো। ডিসেম্বরে খুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় বিসিআইএম-এর মিটিং। ওই বৈঠকে ভারত ও
বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের কাছে চীন জানায় যে, তারা কলকাতা ও খুনমিংয়ের
অর্থনৈতিক সংযোগ করিডোর উন্নয়নে দিল্লি ও ঢাকার সাথে কাজ করতে উদগ্রীব হয়ে
আছে। চীন জানায়, এতে ‘আমাদের সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নতুন
অধ্যায়ের সূচনা’ হবে।
‘এটা এমন এক সময়ে ঘটছে যখন ভারতীয় কূটনীতিক দেবযানী খোবরাগাড়ে ঘটনায়
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সর্বনি¤œ পর্যায়ে চলে এসেছে। এর আগে ভারতীয়
কূটনীতিকদের কাছে চীন একটি ইঙ্গিত দিয়েছে, কক্সবাজার উপকূলে সোনাদিয়ায় তারা
যে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে তা ভারতের
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সাথে ভারতের যোগাযোগে সহায়ক হবে। (এভাবে)
ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের কব্জা থেকে বের করে আনতে ভীষণভাবে তৎপর পেইচিং। তা
করতে এখনকার চেয়ে ভালো সময় আর কখন? শেখ হাসিনাকে দেখা হয় ভারতের খুব ঘনিষ্ঠ
হিসেবে। তাই তার প্রতি চীনের সমর্থনকে দেখা হয় এক ঢিলে দুই পাখি শিকার
হিসেবে।
‘যে নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হতে পারত তা থেকে সরে এসে তারা বড় একটি
ভুল করেছে এটা বুঝতে পেরে হরতাল-অবরোধ, যা তারা নির্বাচনের আগে ব্যাপক
আকারে করেছে তা অব্যাহতভাবে করার মুডে নেই বিএনপি।
‘বাংলাদেশে নির্বাচনে মতাসীনদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভোটাররা
প্রস্তুত ছিলেন তাকে ভোট দিতে। দেশকে সুপথে রাখার জন্য এটা বিএনপির জন্য
একটি সুযোগই ছিল না, একই সাথে এটা ছিল দেশ রার জন্য একটি নিশ্চিত সুযোগ।
(কিন্তু) গণ-আন্দোলন বেগবান করার পরিবর্তে বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর
নির্বাচন বর্জনের সন্ত্রাসী কৌশলকে সমর্থন দেয়। এ নির্বাচন শেষ হয়েছে শেখ
হাসিনা ওয়াজেদের বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এতে তার আত্মতুষ্টির কোনো
কারণ নেই। মন্ত্রিসভায় তিনি বহু দলকে ঠাঁই দিয়েছেন। তিনি হয়তো আন্দাজ করতে
পেরেছেন সামনেই তাকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।’
পাকা সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক। তার তথ্য পরিবেশন ও বিশ্লেষণ বহুলাংশে
অভিপ্রায়দুষ্ট তথা অনেকখানি মনগড়া হলেও পরিস্থিতির জটিলতাকে তিনি খাটো করে
দেখেননি। আসলে উঁচুতলার দেশী-বিদেশী খেলোয়াড় কিংবা পর্যবেকেরা হয়তো এখনো
বুঝে উঠতে পারছেন না যে, গত এক বছরে প্রতিহিংসার রাজনীতি ও দমননীতিপীড়িত
বিরোধের অস্থিরতা আর অর্থনৈতিক ব্যভিচার এ দেশের আনাচে-কানাচে প্রচণ্ড
ােভের আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। একটা নয়া আর্থরাজনৈতিক মননের গতিবেগ সৃষ্টি
হয়েছে এ দেশের জনসমাজে। খালেদা জিয়া তাকে ‘নীরব বিপ্লব’ বলে অভিহিত করলেও
হয়তো তার তাৎপর্য এখনো পুরোপুরি উপলব্ধি করছেন না; কারণ রাজধানীতে তার
সম্যক প্রতিফলন ঘটেনি। কিন্তু মফস্বল এলাকা থেকে ক্রমেই এই অভ্যন্তরীণ
গতিশীলতা বা ইন্টারনাল ডায়নামিকস্ সুবিধাভোগী নাগরিক বৃত্তের কাচের দেয়াল
অভিমুখী।
সাধারণ জ্ঞান থেকেই লোকে বলছে, তৃতীয় হাসিনা সরকার অবৈধ, খোদ হাসিনাই
সৃষ্টি করেছে এক সাংবিধানিক শূন্যতার ভ্রষ্টাচার। আবদার করে অবৈধ সরকারের
পতন ঘটে না, ঘটে অবৈধ সরকারের কর্তৃত্ব অমান্য করে, ‘অসহযোগিতা’ করে। কিংবা
‘কঠোর’ আন্দোলনকে কঠোরতর করে ‘কঠোর দমননীতি’র মোকাবেলা করে। কিংবা
রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের
অভ্যন্তরে সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণের কর্তব্যবোধ ও দেশাত্মবোধ থেকে
জাগ্রত বিবেকের বিদ্রোহ দিয়ে। তা না হলে ভারতে যেমন লাল করিডোরে দীর্ঘ
সংগ্রামের প্রস্তুতি নিয়ে অবদমিত উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সশস্ত্র
গেরিলাযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনি পরিণতির দিকে ধাবিত হবে এ দেশেরও অনেক
প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবদমিত জনগোষ্ঠী।
প্রবীণ সাংবাদিক, কলামিস্ট
Comments
Post a Comment