ফিরে দেখা ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ ?

বাংলা একাডেমিতে প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে ব্যাপক ভাংচুর অগ্নিসংযোগ
শহীদুল ইসলাম : চলমান রাজনৈতিক সংকটের মূল বিষয় হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সবদলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রার্থী ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় জেঁকে বসা সরকারকে অবৈধ এবং জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন সরকার বলে অভিহিত করেছে ২০ দলীয় জোট। এজন্য এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার অবরোধ এবং পাশাপাশি হরতালের কর্মসূচিও চলছে। গোটা দেশ অচল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থা, আমদানি, রফতানি, ব্যবসা, বাণিজ্য ও শিক্ষার ওপর প্রভাব পড়েছে বেশি। এই আন্দোলন দমনে সরকার দেখামাত্র গুলীসহ চরম জুলুম-নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। স্বাভাবিক মিছিল, মিটিং, পিকেটিং করতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে বিচ্ছিন্নভাবে গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। হতাহত হচ্ছে প্রতিদিন। আর এসবের জন্য দায়ী করা হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটকে। তবে ২০ দলের অভিযোগ-সরকারিদলের লোকেরাই এসব করছে ২০ দলীয় জোটের বদনাম করার জন্য। কিছু বুদ্ধিজীবী আওয়ামী লীগের অতীতের কথা হয়তো জাতিকে ভুলিয়ে দিতে চায়। মনে হয় হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ তারা করেনি। আমরা যদি ১৯৯৬ সালের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব তখন গণতান্ত্রিক উপায়ে মিছিল, মিটিং, সভা, সমাবেশ, মাইকিং সব কিছু করার সুযোগ থাকার পরও লাগাতার হরতাল অবরোধ, অসহযোগ হয়েছে। তখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চলছিল আন্দোলন। তবে তখন আন্দোলনের মাঠে ছিলেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি। আর সরকারে ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি। ঐ আন্দোলনের চিত্র কি ছিল তা ফিরে দেখা প্রয়োজন। ১৯৯৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তখনকার চলমান আন্দোলনে যা যা ঘটেছিল তার বিবরণ পুরাতন পত্রিকায়ই রয়েছে।
২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টসমূহের কিছু কিছু অংশ থেকে নীচে তুলে ধরা হলো-
প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গুলী, বোমাবাজি ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ সময়ে ক্যাম্পাসে ৭০ থেকে ৮০টি বিস্ফোরণ ঘটে। প্রধানমন্ত্রীর আগমনে ক্যাম্পাসে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে পুলিশ ও বিডিআর-এর সদস্যরা পুরো ক্যাম্পাস ঘিরে ফেলে। বিশেষ করে জগন্নাথ হল এলাকায় পুলিশ সকাল থেকেই কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে পুলিশ-বিডিআর সদস্যরা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ব্যবহার বজায় রাখে।
সকাল দশটায় ঢাঃ বিঃ শিক্ষক সমিতির মৌন মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শুরু হয়। কালো পতাকাবাহী মিছিলটি বাংলা একাডেমি অভিমুখে যাওয়ার সময় রোকেয়া হলের সামনে পুলিশ বাধা দিলে শিক্ষকদের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। কিন্তু অপ্রীতিকর কোন ঘটনা ঘটেনি।
পুলিশের বাধা পেয়ে শিক্ষক সমিতি সদস্যরা প্রথমে ডাসের সামনে ও পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে। এ সময় সমিতির নেতৃবৃন্দ বলেন, ভিসির অনুমতি নিয়ে পুলিশ-বিডিআর সদস্যরা ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। বিশ্ববিদ্যিালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষক মিছিলে বাধা প্রদান করে শিক্ষকদের মৌলিক মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে। তারা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের জন্য এটা লজ্জাজনক যে, একজন শিক্ষকের রক্ত পায়ে দলে প্রধানমন্ত্রী ক্যাম্পাসে আসছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তাব্যক্তি সেই আগমনে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ এ জাতির সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি সন্তান নুবান আহমেদ হত্যাকারীদের বিচার ও গ্রেফতার চায়।
সকাল সাড়ে ১০টায় মুজিববাদী ছাত্র লীগের একটি মিছিল ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। কালো পতাকাবাহী এই মিছিলের ছাত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর নামে অকথ্য গালিগালাজ করতে থাকে, তাছাড়া মিছিলের  শ্লোগানের ভাষাও ছিল উস্কানিমূলক। মিছিলটি ডাস ও রোকেয়া হলের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একটি মিছিলের মুখোমুখি হয়। শিক্ষক সমিতি ভিসি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যিালয় ক্যাম্পাসে প্রধানমন্ত্রীর আগমন নিয়ে প্রায় সবকটি ছাত্র সংগঠন পৃথক পৃথক সমাবেশ করেছে। ডাকসু ভবনের সামনে ছাত্রদলের সমাবেশ থেকে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর আগমন ক্যাম্পাস পরিবেশকে প্রাণবন্ত করেছে। গণতন্ত্র চর্চার মাতৃগৃহ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতেও কখনো গণতন্ত্রীদের রোখা যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না।
টিএসসি চত্বরে ছাত্রলীগের সমাবেশে সভাপতি এনামুল হক শামীম বলেছেন, ক্যাম্পাসে প্রধানমন্ত্রীর আগমনে পরিবেশ কলঙ্কিত হয়েছে। ক্যাম্পাসে প্রবেশের কোন অধিকার প্রধানমন্ত্রীর নেই। ছাত্রলীগ সমাবেশ থেকে আজ শুক্রবার বিক্ষোভ মিছিল, ৩রা ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট ও ৪ঠা ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী প্রতিবাদ সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে।
ডাকসুর পক্ষ থেকে ডাকসু ভিপি আমান উল্লাহ আমান ও এজিএস খায়রুল কবির খোকন প্রধানমন্ত্রীর বই মেলা উদ্বোধনের সহায়তা দানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার ও বাংলা একাডেমির সদস্যবৃন্দসহ দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে গতকাল বিবৃতি দিয়েছেন।
ঐদিন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশের দিনভর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পুলিশ ছাত্র-জনতার ওপর লাঠিচার্জ ও প্রচুর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা নগরীর বিভিন্ন স্থানে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং প্রায় শতাধিক গাড়ি ভাংচুর করে। পুলিশ ১৩ জনকে গ্রেফতার করে। বাংলা একাডেমিতে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আগমন এবং আগের দিন বুধবার জগন্নাথ হলে পুলিশী হামলার ঘটনার জের ধরে নগরীতে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ ও বিক্ষুব্ধ জনতা গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।

Comments