ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে সুজাতা সিংকে বরখাস্ত করা নিয়ে সে দেশের গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক মহলে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভারত সফর শেষ হওয়ার ঠিক এক দিনের মাথায় তাকে আকস্মিক বরখাস্তের কারণে বিষয়টিকে অনেকেই নিছক কোনো ঘটনা হিসেবে দেখছে না।

বরখাস্তের সময় বিবেচনায় অনেকে এটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বলে মনে করছেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিক মহলের বরাত দিয়ে দেশটির গণমাধ্যম সুজাতার বরখাস্তের নেপথ্য কারণ তুলে ধরার চেষ্টা করছে। অনেকে মেলাতে শুরু করেছেন নানা ধরনের অঙ্কের হিসাব। 
টাইমস অব ইন্ডিয়া গতকাল সুজাতাকে বরখাস্তের পেছনে তিনটি সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখ করেছে। এর একটি হলো ড্যানিশ প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর বাতিল হওয়া প্রসঙ্গ। গত ১১-১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ভাইব্রান্ট (চনমনে) গুজরাট সামিট। এতে আমন্ত্রণ জানানো হয় ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রীকে। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী আসতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতায়। 
একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কোনো দেশে সফর করতে হলে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে প্রাথমিক পর্যায়ে যোগাযোগ স্থাপনসহ অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। করতে হয় বহুমাত্রিক গ্রাউন্ড ওয়ার্ক। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ডেনমার্ক কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়া হয়, কিম ডেভি ইস্যু সুরাহা না করা পর্যন্ত উচ্চপর্যায়ের কোনো যোগাযোগ স্থাপন করা যাবে না। 
প্রসঙ্গত, ১৯৯৫ সালে ১৭ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় বিমান থেকে অস্ত্র নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ডেনমার্কের নাগরিক কিম ডেভি। কিম ডেভির অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী সরকারকে অপসারণে এটা ছিল কেন্দ্রীয় সরকার, গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ও এমআইফাইভের একটি সম্মিলিত ষড়যন্ত্র। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাকে আশ্বস্ত করেছিল নিরাপদে ডেনমার্ক প্রত্যাবর্তনে। তবে এ ঘটনার প্রকৃত কারণ যাই থাক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন আনন্দ মার্গ গ্রুপ দাবি করেছে এ অস্ত্র তাদের কাছে আসছিল। ভারতের একটি আদালতও এর পক্ষে মত দেয় তখন।
ডেনমার্ক বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ অবস্থান ও অসহযোগিতায় বাতিল হয়ে যায় ড্যানিশ প্রধানমন্ত্রীর গুজরাট সফর। এতে সম্পর্কের বেশ অবনতি ঘটে দুই দেশের মধ্যে। এ ঘটনায় বেশ ুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কারণ ডেনমার্ক তার কাছে অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। 
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে উল্লেখ কর হয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ কারোর সাথেই প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অর্থপূর্ণ কোনো যোগাযোগ ছিল না। যদিও সুজাতা সিং ও সুষমা স্বরাজের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পররাষ্ট্র বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতিনির্ধারণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এভাবে কার্যত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীতল সম্পর্কের পেছনে সুজাতার অনাগ্রহ বা অনচ্ছিাকে দায়ী বলে মনে করা হয়। 
সুজাতার ওপর নরেন্দ্র মোদির নাখোস হওয়ার পেছনে টাইমস অব ইন্ডিয়া আরেকটি কারণ উল্লেখ করেছে। তা হলো ইসরাইল ইস্যু। ইসরাইলের ক্ষেত্রে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দীর্ঘ দিন ধরে প্রথাগত যে সম্পর্ক বজায় রেখে আসছিল তার সাথে একমত নন মোদি। বলা যায়, মোদির অবস্থান এর বিপরীত। মোদির অগ্রাধিকার তালিকায় ইসরাইলও রয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে মোদি সাক্ষাৎ করে দুই দেশের সম্পর্ক আরো জোরদারের উদ্যোগ নেন। 
টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, ছয় মাস ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সুজাতা সিংয়ের ওপর ক্রমাগতভাবে ুব্ধ হচ্ছিলেন মোদি। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদির আকক্সক্ষা, অগ্রাধিকার ও বৃহত্তর স্বার্থের সাথে সম্পূর্ণ তালমিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হয়েছে মন্ত্রণালয়। 
অন্য দিকে আনন্দবাজার পত্রিকা গতকাল লিখেছে, সুজাতাকে সরিয়ে দেয়ায় বেশ চটেছেন সুষমা স্বরাজ। তিনি বেশ ুব্ধ। এমনকি বৃহস্পতিবার দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনী জনসভাও তিনি বাতিল করেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা আরো উল্লেখ করেছে অতীতে মোদিবিরোধী হিসেবে সুজাতার রেকর্ড রয়েছে। তবে স্বরাজ এখন চেষ্টা করছেন মোদিবিরোধী আদভানিসহ অন্য কারোর সাথে যোগাযোগ না রাখতে। তিনি তার দায়িত্ব নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চাচ্ছেন। 
এ দিকে সুজাতা সিং বরখাস্তের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও একটি ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচনা করছেন অনেকে। বিশেষ করে দেবযানি ইস্যু। দেবযানি নিউ ইয়র্কে ভারতের কনসুলেট জেনারেল অফিসে ডেপুটি কনসাল জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র তাকে আটক করে। তার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট জালিয়াতি ও নিজ বাসায় নিযুক্ত গৃহকর্মী সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অভিযোগ আনা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে স্ট্রিপ সার্চ (বিবসনা করে দেহ তল্লাশি) করা হয়। এ ঘটনাকে ভারত গোটা জাতির জন্য অত্যন্ত সম্মানহানিকর ও অমর্যাদাকর হিসেবে বিবেচনা করে। দেবযানি ইস্যুতে ভারত অত্যন্ত শক্ত অবস্থান নেয়। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান কূটনৈতিক সম্পর্ক তখন নাজুক অবস্থার সম্মুখীন হয়। 
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার ভারত সফর শেষের ঠিক একদিন পরেই পররাষ্ট্র সচিব সুজাতাকে বরখাস্তের ঘটনার সাথে অনেকে দেবযানি ইস্যুকে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় কংগ্রেস নেতা মনিশ তেওয়ারির অভিযোগ থেকে। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় পরিবেশিত খবরে বলা হয়েছে সাবেক এ তথ্য এবং সম্প্রচার মন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, সুজতা সিংকে বরখাস্ত করে দেবযানি ইস্যুর প্রতিশোধ নেয়া হয়েছে। কারণ দেবযানি ইস্যুতে ভারতের শক্ত অবস্থানের পেছনে তখন সুজাতা সিং জোরাল ভূমিকা পালন করেন। 
সুজাতা সিং বরখাস্ত ঘটনার নেপথ্যে উঠে এসেছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ভারত সফর করেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা। কূটনৈতিক সূত্র মতে, ড্যান মজিনা ভারতের আমন্ত্রণে তখন দিল্লি সফর করেননি। বরং ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তেই দিল্লি যান তিনি। বাংলাদেশে তখন তীব্র রাজনৈতিক সঙ্কট বিরাজমান ছিল। ভারতের কংগ্রেস সরকার বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগের পক্ষে তাদের শক্ত অবস্থানের কথা ব্যক্ত করে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশে রাজনৈতিক সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান ও সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য কূটনৈতিকপর্যায়ে চেষ্টা চালায়। তাই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের ঠিক দুই মাস আগে ড্যান মজিনার ওই দিল্লি সফর নিয়ে ঢাকায় বেশ গুঞ্জন সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ করে ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থান অবহিত হওয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরা ও বাংলাদেশের তখনকার ইস্যুতে দুই দেশ মিলে একটি অবস্থানে আসা যায় কি না এসব বিষয়কে সামনে রেখেই মজিনা তখন দিল্লি সফর করেন বলে অনেকে মনে করেন। 
কূটনৈতিক সূত্র আরো জানায়, ড্যান মজিনার এ সফরের পরও ভারতের কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের সমর্থন জোরালভাবেই ধরে রাখে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাত্র এক মাস আগে ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকা সফরে এসে সুজাতা সিং একতরফা নির্বাচনের পক্ষে কংগ্রেস সরকারের অবস্থান জানিয়ে দেন। এমনকি তিনি একতরফা নির্বাচনে অংশ নিতে এরশাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। এরশাদ তা সাথে সাথে ফাঁস করে দেন। অনেকের মতে, এভাবে কার্যত গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও সে সময় আওয়ামী লীগ শুধু ভারতের একনিষ্ঠ সমর্থনের ওপর দাঁড়িয়ে বিরোধী দলসহ বিভিন্ন মহলের সব দাবি উপেক্ষা করে একটি একতরফা জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায় ও তা সম্পন্ন করে। বাংলাদেশে সঙ্ঘাত নিরসন করে একটি শান্তিপূর্ণ স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য আরো অনেক দেশ ও সংস্থার সব চেষ্টা মূলত ব্যর্থ হয়ে যায়, বাংলাদেশ বিষয়ে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের অনমনীয় অবস্থান এবং আওয়ামী লীগের প্রতি অন্ধ সমর্থনের কারণে। তাই কারো কারো মতে, সুজাতা বরখাস্তের পেছনে বাংলাদেশের ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পূর্ব অবস্থারও যোগসাজশ থাকতে পারে। 
ভারতের পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে আরো পরিবর্তন আসছে দ্রুত 
মোদি সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গত ছয় মাসে ভারতে রাষ্ট্রদূত পর্যায়েও কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পরিবর্তনের প্রস্তাব করে ফাইল পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু মোদি তাতে অনুমোদন দেননি। নরেন্দ্র মোদি চাইছিলেন সবার আগে ঘরের ভেতর থেকে অর্থাৎ মন্ত্রণালয় থেকেই পরিবর্তনের সূচনা করতে। এরপর রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার পর্যায়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। এ খবর দিয়েছে ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া। 
টাইমস অব ইন্ডিয়া বৃহস্পতিবারই লিখেছে, জয়শঙ্করের নিয়োগের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দ্রুত নতুন পরিবর্তনের সূচনা ঘটিয়েছে। সুজাতাকে সরিয়ে দেয়ার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে পরিবর্তন শুরু হবে। 
সুজাতাকে অপসারণের মধ্য দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দ্রুত পরিবর্তনের সূচনা হবে বলে আশা করা হয়েছে ভারতের গণমাধ্যমসহ কূটনৈতিক মহল থেকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এসব পরিবর্তন বৈদেশিক সম্পর্কের ওপরও যে প্রভাব ফেলবে ও নতুন মাত্রা পাবে তা অনেকটা স্পষ্ট। 
ভারতের ফরেন সার্ভিসের ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ আরো অদল-বদলের ফলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজে যেমন গতি আসবে; তেমনি পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও নতুন সরকারের আশা-আকাক্সক্ষা অনুযায়ী পরিবর্তন আসবে এমনটাই প্রত্যাশা সবার। 
সুজাতা সিংকে বরখাস্ত ও রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে অদল-বদলের খবরে ঢাকায়ও অনেকে কৌতূহলি হয়ে উঠেছেন এখানে ভারতীয় দূতাবাসে কোনো পরিবর্তন হবে কি না সে বিষয়ে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে বুধবার রাতে বরখাস্ত করা হয় সুজাতা সিংকে ও তার স্থলে নিয়োগ দেয়া হয় সুব্রামনিয়ামস জয়শঙ্করকে।

Comments